প্রশংসা জগৎসমূহের একমাত্র প্রতিপালক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলার জন্য নিবেদিত। আমরা একমাত্র তাঁরই ‘ইবাদাত করি এবং শুধু তাঁরই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ পথের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা বিশ্বনাবী মুহাম্মাদ -এর প্রতি দরূদ ও সালাম।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন:
رَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُوْمُ الْحِسَابُ
“হে আমাদের প্রতিপালক। যেদিন হিসাব অনুষ্ঠিত হবে সেদিন আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে এবং মু’মিনগণকে ক্ষমা করো।" (সূরা ইব্রাহীম ১৪: ৪১)
প্রথম যুগে ধর্মের শিক্ষা লাভ এবং শিক্ষা প্রদানের কাজটি ছিল অত্যন্ত সহজ। সে যুগের বিদ্বানগণ নাবী (সাঃ)-এর সুন্নাতের সঙ্গে আগে পরিচয় লাভ করতেন। নিজেরা সে সুন্নাতের উপর ‘আমাল করতেন, তারপর সে সুন্নাতের বাস্তব নমুনা উম্মাতের সম্মুখে তুলে ধরতেন। তাঁরা যখন লোকদেরকে সুন্নাতের উপর 'আমাল করার আহ্বান জানাতেন, তখন স্বভাবতই সে আহ্বানে কাজ হ’ত। কারণ যা বলা হ’ত তার বাস্তব নমুনা তারা সামনেই দেখতে পেত। তারা অভিভূত হ’ত, প্রভাবিত হ’ত, ফলে সহজেই উপদেশ ফলপ্রসূ হ’ত। শ্রোতারা শুনে এবং দেখে সুন্নাতের অনুসরণ শুরু করে দিত, এবং রাসূল-এর অনুসরণের পথে কোন বাধাই অন্তরায় হয়ে দাঁড়াত না।
সে সময় ধর্মের বিধিবিধান মেনে চলার কাজটি উম্মাতের জন্য খুবই সহজসাধ্য ছিল। কেননা প্রথমতঃ ইসলামের বিধি বিধানগুলোই তো সহজসাধ্য ও কল্যাণপ্রদ ব্যাপার। দ্বিতীয়তঃ সে যুগের আলিমদের বাস্তব জীবনের নমুনা ছিল অত্যন্ত প্রভাববিস্তারী। তাঁদের কথায় উৎসাহ ও উদ্দীপনা উদ্দীপ্ত হ’ত, সুফল-দিত। কারণ তারা যা বলতেন, তা তারা করতেন। ‘আলিমদের ‘আমাল দেখে এবং তাদের অকপটতা ও অকৃত্রিমতা বুঝতে পেরেই দর্শক মনে তাদের অনুসরণের একটা অনুরাগ ও অনুপ্রেরণা সৃষ্টি হয়ে যেতো। পরক্ষণেই তারা তাদের অনুকরণ ও অনুসরণে নিয়োজিত হ’ত। সে সময়ের ‘আলিমরা ছিলেন রাসূলুল্লাহ-এর সত্যিকারের উত্তরাধিকারী-তাঁর যথার্থ স্থলাভিষিক্ত এবং সঙ্গে সঙ্গে উম্মাতের জন্য আদর্শ ও নমুনাস্বরূপ।
ধর্ম এবং ধর্মীয় কার্যবিধি সেদিন থেকে কঠিন এবং জটিল হয়ে পড়েছে যেদিন থেকে আলিম সমাজ নাবী(সাঃ)-এর অনুসৃত কর্মপদ্ধতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ফিকাহর কিতাবসমূহের বিতর্কিত বিষয়সমূহ এবং বিভিন্ন পণ্ডিত ব্যক্তির উক্তি ও অভিমতকেই প্রাধান্য দিয়ে চলেছে। মতভেদের আধিক্যের ফলে একের পর এক ফিরকা, দল ও উপদলের সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্যেক দল নিজ নিজ দলের সমর্থনে অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছে। শুধু মূল গ্রন্থকেই যথেষ্ট মনে না করে সেগুলোর ব্যাখ্যা গ্রন্থ প্রস্তুত করেছে ; সে ব্যাখ্যার পাশে পুনঃটীকা সংযোজিত করেছে, আবার টীকার নিচে পাদটীকা পর্যন্ত লাগিয়েছে।
এখানেই তাঁরা ক্ষান্ত হননি। নিজেদেরকেও তারা ভাগ ভাগ করে ফেলেছেন, দর্জা ও মর্তবা অনুসারে নিজেদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যেমন কারোর নাম দেয়া হয়েছে-মুজতাহিদে মতলক, কারোর মুজতাহিদে মাযহাব, কাউকে বলা হয়েছে মুফতিয়ে মাযহাব, মুযাজ্জিহে মাযহাব অথবা মুকাল্লিদে মাযহাব।
তারপর জুলমের কথা হচ্ছে এই যে, তারা আল্লাহর বান্দাদেরকে এই ব’লে বাধ্য করতে লেগেছেন যে, দীনকে কেবলমাত্র ফিকাহর নির্দিষ্ট কিতাব থেকে গ্রহণ করতে হবে আর সেসব শর্ত, বাধ্যবাধকতা এবং দুর্বোধ্যতাকে বিনা বাক্যে মেনে নিতে হবে যা তাঁরা নিজেদের রায় ও ব্যক্তিগত অভিমত অনুসারে ঠিক করে রেখেছেন। শর্তাবলী এবং বাধ্যবাধকতা এত অধিক যে, তা দেখলেই যে কেউ দিশেহারা হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা সৃষ্টি হবে। মতের বিভিন্নতা আর পথের আধিক্য থেকে এটা খুঁজে বের করা খুবই দুঃসাধ্য যে, কোনটি হক আর কোনটি বাতিল।
দীন বা ধর্মকর্ম কঠিন হয়ে পড়ার বড় কারণ হচ্ছে এই যে, দীনের ‘ইলম বা ধর্মজ্ঞান অর্জন করা সেসব মোটা মোটা গ্রন্থ পাঠের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে যার ভিতরে রয়েছে পরস্পর বিরোধী উক্তি, জটিল সমস্যাবলী এবং অসংখ্য শর্ত ও বন্ধনীর সমাবেশ। ফলতঃ তাতে আছে ফার, ওয়াজিব, মুস্তাহাব, মুবতিলাত এবং মাকরূহাতের সীমাহীন সিলসিলা, তার উপর আরও দেখতে পাওয়া যাবে কিরাহাতে তাহরিমী, কিরাহাতে তানযিহী, মাকরূহ বা অপছন্দনীয় কাজের ভিন্ন ভিন্ন বিবরণ, মোট কথা ফিকাহর কিতাবগুলোতে এ ধরনের অসংখ্য বিশিষ্টার্থক শব্দে (ইসতিলাহাতে) ভরপুর হয়ে আছে। ওযুর অধ্যায় হোক অথবা সালাতের অধ্যায়, বিবাহের অধ্যায় হোক অথবা তালাকের অধ্যায়-প্রত্যেক জায়গায় এমন অসংখ্য বিশিষ্টার্থক শব্দ দৃষ্টিগোচর হবে যার দ্বারা মস্তিষ্কটাকে গুলিয়ে দেয়া ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না। এছাড়া এসব গ্রন্থে এমন ধরনের মাসআলা-মাসায়িল সন্নিবেশিত হয়েছে যা একান্তভাবেই দুর্লভ, কোন সময়েই যা সংঘটিত হয় না। ওগুলো কেবলমাত্র নিজস্ব কল্পনায়, মন ও মস্তিষ্কের অদ্ভূত ও উদ্ভট আবিষ্কার মাত্র। এসবের দ্বারা জ্ঞানের পরিধি বিন্দুমাত্র বিস্তৃত না হলেও বেচারা মস্তিষ্কটা শ্রান্ত ও ক্লান্ত এবং হৃদয় মন উদ্ভ্রান্ত ও বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠতে বাধ্য হয়। সাধারণ জনসাধারণ না এগুলো বুঝতে সমর্থ হয়, না তার উপর 'আমাল করতে সক্ষম।
আর সব চাইতে বড় কথা, সেগুলো না আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের হুকুম এবং না সেগুলোর উপর ‘আমাল করতে শারী‘আত কোন নির্দেশ প্রদান করেছে। বস্তুতঃ শরী‘আত রয়েছে কুরআন এবং সুন্নাতে নাববীর ভিতরে বিদ্যমান।
দুনিয়ার মানব সমাজের হিদায়াতের জন্য আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন কুরআন মাজীদ অবতীর্ণ করেছেন এবং আদেশ দিয়েছেন:
﴿اتَّبِعُوا مَا أُنزِلَ إِلَيْكُم مِّن رَّبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوا مِن دُونِهِ أَوْلِيَاءَ ۗ قَلِيلًا مَّا تَذَكَّرُونَ﴾
“তোমাদের প্রভু পরোয়ারদিগারের তরফ থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে, তারই অনুসরণ কর- এছাড়া অন্য কোন অভিভাবকের অনুসরণ করো না। উপদেশের অতি অল্পই তোমরা স্মরণ রাখ।”
(সূরা আল আ'রাফ ৭:৩)
তিনি আরও ইরশাদ করেছেন:
﴿وَاتَّبِعُوا أَحْسَنَ مَا أُنزِلَ إِلَيْكُم مِّن رَّبِّكُم مِّن قَبْلِ أَن يَأْتِيَكُمُ الْعَذَابُ بَغْتَةً وَأَنتُمْ لَا تَشْعُرُونَ-أَن تَقُولَ نَفْسٌ يَا حَسْرَتَا عَلَىٰ مَا فَرَّطتُ فِي جَنبِ اللَّهِ وَإِن كُنتُ لَمِنَ السَّاخِرِينَ-أَوْ تَقُولَ لَوْ أَنَّ اللَّهَ هَدَانِي لَكُنتُ مِنَ الْمُتَّقِينَ-أَوْ تَقُولَ حِينَ تَرَى الْعَذَابَ لَوْ أَنَّ لِي كَرَّةً فَأَكُونَ مِنَ الْمُحْسِنِينَ-بَلَىٰ قَدْ جَاءَتْكَ آيَاتِي فَكَذَّبْتَ بِهَا وَاسْتَكْبَرْتَ وَكُنتَ مِنَ الْكَافِرِينَ﴾
“আর যে অতি উত্তম বাণী তোমাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে তোমাদের প্রভু পরোয়ারদিগারের তরফ থেকে, সকলে তোমরা তার অনুসরণ করে চলবে-তোমাদের প্রতি হঠাৎ শান্তি সমাগত হওয়ার পূর্বে-তোমাদের অনবহিত অবস্থায়, যেন তখন কেউ না বলে, আল্লাহর নিকট আমি যে ত্রুটি করেছি এবং (সত্যের প্রতি) আমি যে ঠাট্টা বিদ্রুপ করে এসেছি সেজন্য আমার প্রতি আক্ষেপ! এ কথাও যেন কেউ না বলে যে, আল্লাহ আমাকে হিদায়াত করলে আমি নিশ্চয় মুত্তাকীদের অন্যতম হতে পারতাম। অথবা আযাবের সাক্ষাৎলাভের পর কেউ যেন এ কথা না বলে যে, আর একটি বার যদি আমি অবকাশ পেতাম তাহলে (দুনিয়ায় গিয়ে) আমি সৎকর্মশীল লোকদের একজন হয়ে আসতাম। (উত্তরে আসবে) হ্যাঁ! (হে অবাধ্য উদ্ধত ব্যক্তি!) আমার আয়াতগুলো তো তোমার কাছে পৌঁছে গিয়েছিল কিন্তু সেগুলোকে তুমি মিথ্যে বলে উড়িয়ে দিয়েছিলে, আর দাম্ভিকতা প্রকাশ করেছিলে আর তুমি ছিলে কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত।”
(সূরা আয যুমার ৩৯: ৫৫-৫৯)
তিনি আরও বলেছেন:
﴿فَبَشِّرْ عِبَادِ * الَّذِينَ يَسْتَمِعُونَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُونَ أَحْسَنَهُ ۚ أُولَٰئِكَ الَّذِينَ هَدَاهُمُ اللَّهُ ۖ وَأُولَٰئِكَ هُمْ أُولُو الْأَلْبَابِ﴾
“হে রাসূল!) আপনি সুসংবাদ পৌছিয়ে দিন আমার সেসব বান্দাকে যারা সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে, তারপর তার মধ্যে যা সুন্দরতম সুসঙ্গত তারই অনুসরণ করে চলে, এরাই হচ্ছে সে সমস্ত লোক যাদেরকে আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেছেন; এবং এই যে লোকগুলো-এরাই হচ্ছে সুষ্ঠু বিচারবোধ সম্পন্ন লোক।”(সূরা আয যুমার ৩৯: ১৭-১৮)
তিনি আরও বলেছেন:
﴿اللَّهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيثِ كِتَابًا مُّتَشَابِهًا مَّثَانِيَ تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُودُ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ ثُمَّ تَلِينُ جُلُودُهُمْ وَقُلُوبُهُمْ إِلَىٰ ذِكْرِ اللَّهِ ۚ ذَٰلِكَ هُدَى اللَّهِ يَهْدِي بِهِ مَن يَشَاءُ ۚ وَمَن يُضْلِلِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ هَادٍ﴾
“আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন, উৎকৃষ্টতম বাণী (অর্থাৎ) এ কিতাবকে, (যার এক অংশ অপর অংশের) পরস্পর সদৃশ এবং (যার উপদেশগুলো) পুনঃ পুনঃ বর্ণিত, যার (পাঠে অথবা শ্রবণের) ফলে নিজেদের প্রভু-পরোয়ারদিগারের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত ব্যক্তিদের দেহ রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে, তারপর তাদের দেহ ও মন নম্র হয়ে যায় আল্লাহর যিকির-আযকারের দিকে, এটাই হচ্ছে আল্লাহর হিদায়াত যার মাধ্যমে তিনি যাকে ইচ্ছা, সুপথে পরিচালিত করেন, বস্তুতঃ আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তার জন্য কেউ নেই পথপ্রদর্শক।”
(সূরা আয যুমার ৩৯: ২৩)
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন আবার বলেছেন:
﴿وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِن مُّدَّكِرٍ﴾
“বস্তুত কুরআনকে আমি সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণ করার জন্য, কিন্তু আছে কি কেউ উপদেশ গ্রহণকারী?” (সূরা আল ক্বামার ৫৪: ১৭, ২২, ৪০)
আল্লাহ রাব্বুল 'আলামীন অন্যত্র বলেছেন:
﴿فَإِنَّمَا يَسَّرْنَاهُ بِلِسَانِكَ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ﴾
“নিশ্চয় (হে রাসূল!) আমি এ কুরআনকে আপনার ভাষায় সহজ করে দিয়েছি-যেন তারা উপদেশ গ্রহণ করে।” (সূরা আদ দুখান ৪৪: ৫৮)
তিনি আরও বলেছেন:
﴿قُرْآنًا عَرَبِيًّا غَيْرَ ذِي عِوَجٍ لَّعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ﴾
আরবী ভাষায় (অবতীর্ণ) কুরআন, কোনই বক্রতা নেই এর ভিতরে, (উদ্দেশ্য হচ্ছে) যেন তারা সংযত (সাবধান) হয়ে চলে।” (সূরা আয যুমার ৩৯: ২৮)
অতঃপর আল্লাহ রাব্বুল 'আলামীন সকলের উপর ফরয (অপরিহার্য) করে দিয়েছেন যে, তাঁরা যেন রাসূলুল্লাহ-এর সুন্নাত থেকে পথের সন্ধান গ্রহণ করে। কারণ, এ সুন্নাতই হচ্ছে আল্লাহর কালামের ব্যাখ্যাকারী ও ভাষ্যকার।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা'আলা ইরশাদ করেছেন:
﴿وَأَنزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ﴾
“আপনার নিকট উপদেশ (সম্বলিত কুরআন) অবতীর্ণ করেছি যেন আপনি জনসাধারণের প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তা তাদেরকে পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করতে পারেন, যেন তারা ঐ নিয়ে চিন্তা-ভাবনার সুযোগ লাভ করে।”(সূরা আন্ নাহল ১৬:৪৪)
তিনি আরও বলেছেন:
﴿وَمَا أَنزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ إِلَّا لِتُبَيِّنَ لَهُمُ الَّذِي اخْتَلَفُوا فِيهِ ۙ وَهُدًى وَرَحْمَةً لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ﴾
“আমি আপনার প্রতি (হে রাসূল!) এ গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি একমাত্র এ উদ্দেশে যে, আপনি তাদের নিকট পরিষ্কার করে দেবেন সেসব বিষয় যেগুলো নিয়ে তারা মতভেদ করেছে এবং এজন্য যে, এটা হবে-মু'মিনদের জন্য পথপ্রদর্শন ও রহমাত স্বরূপ।”(সূরা আন্ নাহল ১৬: ৬৪)
তিনি আরও বলেন:
﴿وَيَوْمَ نَبْعَثُ فِي كُلِّ أُمَّةٍ شَهِيدًا عَلَيْهِم مِّنْ أَنفُسِهِمْ ۖ وَجِئْنَا بِكَ شَهِيدًا عَلَىٰ هَٰؤُلَاءِ ۚ وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَانًا لِّكُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً وَبُشْرَىٰ لِلْمُسْلِمِينَ﴾
“এবং সেদিন আমি উত্থিত করব প্রত্যেক উম্মাতের উপর একজন সাক্ষ্যদাতা তাদের মধ্য থেকে এবং উপস্থাপিত করব আপনাকে (হে রাসূল।) এ উম্মাতের উপর। আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি আল-কিতাব (কুরআন মাজীদ) যা হচ্ছে প্রত্যেক বিষয়ের বিশদ বর্ণনাকারী এবং যা হচ্ছে হিদায়াত, রহমাত এবং সুসংবাদ (বর্ণনাকারী) (আত্মসমর্পিত) মুসলিমদের জন্য।”(সূরা আন নাহল ১৬: ৮৯)
তিনি আরও বলেছেন:
﴿مَا كَانَ حَدِيثًا يُفْتَرَىٰ وَلَٰكِن تَصْدِيقَ الَّذِي بَيْنَ يَدَيْهِ وَتَفْصِيلَ كُلِّ شَيْءٍ وَهُدًى وَرَحْمَةً لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ﴾
“কুরআন এমন বস্তু নয় যা জাল করে রচিত বরং এ হচ্ছে সত্যায়নকারী সেসব বিষয়ের যা পূর্বে আগত হয়েছে (পূর্ব প্রেরিত গ্রন্থসমূহের মাধ্যমে) এবং এ হচ্ছে প্রত্যেক বিষয়ের বিশদ বিবরণ (সম্বলিত) আর মু'মিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমাত স্বরূপ।”(সূরা ইউসুফ ১২: ১১১)
তিনি আরও বলেছেন।
﴿هُوَ الَّذِي يُنَزِّلُ عَلَىٰ عَبْدِهِ آيَاتٍ بَيِّنَاتٍ لِّيُخْرِجَكُم مِّنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ ۚ وَإِنَّ اللَّهَ بِكُمْ لَرَءُوفٌ رَّحِيمٌ﴾
“সে তো তিনি তাঁর বান্দার প্রতি অবতীর্ণ করেছেন সুস্পষ্ট আয়াতগুলো যাতে করে সেই রাসূল তোমাদেরকে অন্ধকারপুঞ্জের মধ্যে থেকে বের করে আনবেন আলোকপানে, বস্তুতঃ আল্লাহ হচ্ছেন তোমাদের প্রতি কৃপাশীল ও করুণানিধান।”(সূরা আল হাদীদ ৫৭: ৯)
তিনি আরও বলেছেন:
﴿إِنَّا أَنزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللَّهُ﴾
“আমি (হে রাসূল।) আপনার প্রতি অবতীর্ণ করেছি আল-কিতাব (কুরআন মাজীদ) সত্য সহকারে যেন আপনি আল্লাহর দেয়া হিদায়াতের আলোকে লোকদের মধ্যে বিচার কাজ সম্পন্ন করতে পারেন।”(সূরা আন নিসা ৪: ১০৫)
তিনি অন্যত্র আবার বলেছেন:
﴿قُلْ إِنَّمَا أَتَّبِعُ مَا يُوحَىٰ إِلَيَّ مِن رَّبِّي ۚ هَٰذَا بَصَائِرُ مِن رَّبِّكُمْ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ﴾
“আপনি ঘোষণা করে দিন (হে রাসূল!) যে, আমি তো অনুসরণ করে থাকি শুধু সেই বস্তুর যা আমার প্রভু-পরোয়ারদিগারের নিকট থেকে আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়ে থাকে, এ হচ্ছে তোমাদের প্রভু পরোয়ারদিগারের পক্ষ থেকে প্রেরিত আলোকপুঞ্জ এবং পথনির্দেশ আর হিদায়াত ও রাহমাত মু'মিন সমাজের জন্য।” (সূরা আল আ'রাফ ৭: ২০৩)
তিনি আবার বলেছেন:
﴿لَّقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ﴾
“তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম নমুনা, সুন্দরতম আদর্শ রাসূলুল্লাহর জীবন মাঝে।”
"(সূরা আল আহযাব ৩৩: ২১)
তিনি আরও বলেছেন:
﴿وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلَىٰ يَدَيْهِ يَقُولُ يَا لَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُولِ سَبِيلًا-يَا وَيْلَتَىٰ لَيْتَنِي لَمْ أَتَّخِذْ فُلَانًا خَلِيلًا-لَّقَدْ أَضَلَّنِي عَنِ الذِّكْرِ بَعْدَ إِذْ جَاءَنِي ۗ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِلْإِنسَانِ خَذُولًا-وَقَالَ الرَّسُولُ يَا رَبِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوا هَٰذَا الْقُرْآنَ مَهْجُورًا﴾
“আর সেদিন যালিম ব্যক্তি (দুঃখ জ্বালায়) নিজের হাত কামড়াতে থাকবে এবং বলবে, হায়। যদি আমি রাসূলের সঙ্গে সোজা পথ ধরতাম। হায়, দুর্ভোগ। যদি অমুককে আমার বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম। সে (আল্লাহর) উপদেশ আমার নিকট সমাগত হওয়ার পর তার স্মরণ থেকে আমাকে বিপথগামী করেছে আর শয়তান হচ্ছে মানুষের জন্য এক চরম বিশ্বাসঘাতক। তখন রাসূল বলবেন, প্রভু হে। আমার (না ফরমান) সম্প্রদায় এ কুরআনকে (উপেক্ষার সঙ্গে) পরিত্যাগ করেছিল।” (সূরা আল ফুরকান ২৫: ২৭-৩০)
তিনি আরও বলেছেন:
﴿فَكَيْفَ إِذَا جِئْنَا مِن كُلِّ أُمَّةٍ بِشَهِيدٍ وَجِئْنَا بِكَ عَلَىٰ هَٰؤُلَاءِ شَهِيدًا-يَوْمَئِذٍ يَوَدُّ الَّذِينَ كَفَرُوا وَعَصَوُا الرَّسُولَ لَوْ تُسَوَّىٰ بِهِمُ الْأَرْضُ وَلَا يَكْتُمُونَ اللَّهَ حَدِيثًا﴾
“কী অবস্থা ঘটবে তখন, যখন আমি প্রত্যেক উম্মাতের মধ্য হতে একজন সাক্ষী আনয়ন করব এবং আপনাকে (হে রাসূল।) আনয়ন করব এ উম্মাত সম্বন্ধে সাক্ষী হিসেবে। যারা কুফরী করেছে এবং রাসূলকে অমান্য করেছে সেদিন তারা কামনা করবে (হায়।) তাদের নিয়ে যমীন যদি আজ সমতল হয়ে যেতো (অথবা তারা যদি যমীনে দাফন হয়ে যেতো)। তারা সে দিবস আল্লাহর নিকট কোন কথাই গোপন রাখতে পারবে না।” (সূরা আন নিসা ৪: ৪১-৪২)
তিনি আরও সোজা ও স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশ দিয়েছেন:
﴿وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۖ إِنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ﴾
“(হে মু'মিনগণ।) রাসূল তোমাদেরকে যা প্রদান করেন, তা গ্রহণ করো আর যে সম্বন্ধে তোমাদেরকে নিষেধ করেন তাথেকে বিরত থাকো, আর আল্লাহ সম্বন্ধে তোমরা সংযত হয়ে চলো, আল্লাহ হচ্ছেন (কঠিন পাপে) কঠিন দণ্ডদাতা।”
(সূরা আল হাশর ৫৯:৭)
তিনি আরও বলেছেন:
﴿الَّذِي يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَكَلِمَاتِهِ وَاتَّبِعُوهُ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ﴾
“যে আল্লাহ ও তাঁর বাণীতে ঈমান আনে এবং তোমরা তাঁর (রাসূলকে) অনুসরণ করে চলো-যাতে করে তোমরা হিদায়াত লাভ করতে পার।” (সূরা আল আ'রাফ ৭: ১৫৮)
তিনি আরও বলেছেন:
﴿وَأَنَّ هَٰذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ ۖ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَن سَبِيلِهِ ۚ ذَٰلِكُمْ وَصَّاكُم بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ﴾
“নিশ্চয় এটাই হচ্ছে-আমার সোজা রাস্তা এ পথেই চল, অন্য কোন পথের দিকে ধাবিত হয়ো না, যদি হও তাহলে তাঁর (সোজা) পথ থেকে তোমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে, আল্লাহ তোমাদেরকে এ উপদেশই দিচ্ছেন যেন তোমরা সংযমশীল-মুত্তাকী হ'তে পার।” (সূরা আল আন'আম ৬: ১৫৩)
আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে সোজা রাস্তায়-সিরাতে মুসতাকীমে চলার নির্দেশ দিয়েছেন, আর সেসব পথে ধাবিত হতে নিষেধ করেছেন-যেসব পথে চললে মানুষ বিভ্রান্ত হয়, পদস্খলিত হয়, আর সঠিক পথ দৃষ্টির বাইরে চলে যায়।
উপরের উল্লেখিত আয়াতগুলো পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দিয়েছে সোজা পথ কোনটি, সিরাতে মুসতাকীম কাকে বলে।এ পথ আর কোন পথ নয়, এ পথ আমাদের নাবীর পথ, নাবীর আদর্শ জীবন পথ। দীনের তাৎপর্য যদি হৃদয়ঙ্গম করতে চাও- তবে তাঁর আদর্শের অনুসরণ কর। এই পন্থা অবলম্বন ছাড়া দীনের রহস্য উদঘাটনের অন্য আর কোন উপায় নেই। এ পথ পরিষ্কার-অতি পরিষ্কার। এ পথ সোজা, এতে নেই কোন বক্রতা, এ পথ সমতল, এতে নেই বন্ধুরতা, এ পথ সরল পথ, এতে নেই কোন জটিলতা। এ পথের পথিকদের পরস্পর মিলে-মিশে ভ্রাতৃত্বভাবে চলতে হয়, কাঁধের সাথে কাঁধ মিলিয়ে, পায়ের সঙ্গে পা মিলিয়ে এক হয়ে চলতে হয়। বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত হয়ে এ পথে অগ্রসর হওয়া যায় না।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা'আলা বলেছেন:
﴿إِنَّ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا لَّسْتَ مِنْهُمْ فِي شَيْءٍ ۚ إِنَّمَا أَمْرُهُمْ إِلَى اللَّهِ ثُمَّ يُنَبِّئُهُم بِمَا كَانُوا يَفْعَلُونَ﴾
“যারা নিজেদের ধর্মকে ভাগ ভাগ করে পৃথক পৃথক দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে (হে রাসূল।) আপনার কোন সম্পর্ক নেই তাদের সঙ্গে। তাদের বিষয় আল্লাহর হাতে, তারা যা করেছে তিনি তাদেরকে (কিয়ামাত দিবসে তার তাৎপর্য) জানিয়ে দেবেন।” (সূরা আল আন'আম ৬: ১৫৯)
আফসোস! আমাদের যুগের আলিম সমাজ উম্মাতের পথ প্রদর্শন ও নেতৃত্ব প্রদানের কর্তব্যটি সম্পূর্ণভাবে পাশ কাটিয়ে চলেছেন। তারা নিজেরাই নিজেদের উপর অক্ষমতা ও অযোগ্যতার সীল মোহর মেরে দিয়েছেন। তাকলীদকেই (অন্ধ অনুসরণ) তারা তাদের একমাত্র অবলম্বনরূপে আঁকড়ে ধরেছেন। শ্রমবিমুখতা এবং দেহের আরামপ্রিয়তাই তাদের হৃদয়ের একমাত্র কামনার বস্তুতে পরিণত হয়েছে। এজন্য শ্রম স্বীকারের পরিবর্তে এসব প্রাচীন কিতাবগুলোকেই তারা যুগ-চাহিদার কিবলা বানিয়ে রেখেছেন। তাঁরা চিন্তার জড়তা ও বুদ্ধির স্থবিরতায় নিজেদের মন-মানসকে শিকল পরিয়ে এমনভাবে বন্দী করে রেখেছেন যে, স্বাধীন মননশীলতা ও মুক্ত চিন্তার নামটি উচ্চারণ ও শ্রবণ করতেও তাঁরা অক্ষম। বলতে দুঃখ হয়, আমাদের আলিম সমাজ নিজেরা অধঃপতিত হয়েছেন, জাতিকে অধঃপতনের দিকে টেনে নিচ্ছেন-আর নিজেদের সংকীর্ণ মানসিকতা ও অদূরদর্শিতার কারণে খোদ ইসলাম ধর্মকেই খাটো করে ফেলছেন।
আজ এ কথা তিক্ত হলেও সত্য যে, মাত্র চৌদ্দ শতকের ব্যবধানে অনুসারীদের গাফলতির কারণে ইসলামের আলো নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছে। এক কালের বিশ্বজয়ী মুসলিম জাতি ঈমান-'আমালের দুর্বলতা, কর্মবিমুখতা, জ্ঞানের স্বল্পতা ও নৈতিক অবক্ষয়ের এক কলঙ্কময় ইতিহাস রচনা করে চলছে। তারা ভুলে গেছে নিজেদের আলোক উদ্ভাসিত সোনালী ইতিহাস, হারিয়ে ফেলেছে গৌরবময় ঐতিহ্য, হারিয়ে ফেলেছে আকাশ ছোঁয়া হিম্মত, দৃঢ়চেতা মন ও সতেজ ঈমান। হতাশা ও আত্মবিস্মৃতি আজ পুরো জাতিকে গ্রাস ও অবশ করে দিয়েছে। এক সময়কার সিংহ-শার্দুলের এখন আকৃতিই বাকি রয়েছে- প্রকৃত নেই। দেহটাই আছে- শুধু আত্মা নেই। দুনিয়া জুড়ে ইসলামের বিজয় কেতন ওড়ানোর মহৎ উদ্যোগ তাদের নেই। নেই তাদের হৃত ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের কোন শুভ চিন্তা ও চেতনা। অধিকন্তু বেশিরভাগ মুসলিমই ইসলামের পুনঃপ্রতিষ্ঠা নিয়ে দারুন সন্দিহান ও চরম হতাশ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তারা যেন এ ধারণা বদ্ধমূল করে নিয়েছে যে, ‘এ যুগ ফিৎনাহ্-ফাসাদের যুগ, মুসলিম জাতির পতনের যুগ।অথচ আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন অমোঘ ঘোষণা হল:
﴿وَلَا تَهِنُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَنتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ﴾
“তোমরা হীনবল হইও না এবং দুঃখিতও হইও না; তোমরাই বিজয়ী যদি তোমরা মু‘মিন হও।”
(সূরা আল-‘ইমরান ৩: ১৩৯)
আল্লাহ তা'আলার এ চিরন্তন ঘোষণা সর্বকালের জন্য, সর্বযুগের মু'মিনদের জন্য প্রযোজ্য।
সুতরাং এখনও যদি আমরা নিজেদেরকে প্রকৃত মু‘মিন প্রমাণ করতে পারি, তাহলে বিজয় অবশ্যই আমাদের পদচুম্বন করবে।
আজ মুসলিম জাতির অধঃপতনের কথা যদি বিশ্লেষণ করতে চাই তাহলে এ কথা বলতে হয়, মূলতঃ তা আমাদের ঈমানের দুর্বলতা, হীনমন্যতা, হতাশা, সংশয়-সন্দেহ তথা মানসিক বিপর্যয় থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। নচেৎ প্রথম যুগের মুসলিমদের চাইতে আমাদের বাহ্যিক শক্তি-উপকরণ বহু গুণে আজ বেশি। আমাদের রয়েছে ৫৬টি স্বাধীন রাষ্ট্র, ১৩০ কোটি জনগণ, অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ ও অর্ধেকের বেশি তেল সম্পদ- যার উপর নির্ভর করে আধুনিক বিশ্ব আজ চরম উৎকর্ষতা লাভ করছে- তা সত্ত্বেও আমাদের এ চরম বিপর্যয়ের কী কারণ থাকতে পারে? উন্নতি-অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির এতগুলো বাহ্যিক উপকরণের সাথে যদি আমরা শুদ্ধ ঈমান, বিশুদ্ধ ‘আমাল, পূর্ণ বিশ্বাস ও দৃঢ় মনোবলের অধিকারী হতাম; হতাশা, হীনমন্যতা ঝেড়ে ফেলে দীন প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করতাম, তাহলে অবশ্যই আমরা পৃথিবীতে ইসলামের বিজয়ী ঝাণ্ডা উড্ডীন করতে সক্ষম হতাম। কাজেই এ মুহূর্তে খুবই প্রয়োজন হতাশা, হীনমন্যতা ও মানসিক বিপর্যয়ের কারণ ও লক্ষণসমূহ চিহ্নিত করে এমন পথ ও পদ্ধতি অবলম্বন করা, যার মাধ্যমে আমরা মরণ ব্যাধি এ মানসিক বিপর্যয় উত্তরণ করে একটি সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পারি। সমগ্র পৃথিবীতে ইসলামের ঝাণ্ডা উড্ডীন করার মাধ্যমে উভয় জগতের অফুরন্ত কল্যাণ লাভ করতে পারি।
আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন:
﴿إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ﴾
“নিশ্চয় আল্লাহ কোন সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজ অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে।” (সূরা আর রা'দ ১৩: ১১)
হে রাব্বুল ‘আলামীন! আমাদের প্রতি দয়া কর, আমাদের সাহায্য কর। আমাদের দুর্বল ঈমানকে সতেজ ও সুদৃঢ় করে দাও। আমাদের অন্তরের সংকীর্ণতাকে দূর করে কল্যাণের পথে প্রসারিত কর। সর্বময় ক্ষমতার একচ্ছত্র মালিক তুমি। সব কিছুর একমাত্র নিয়ন্ত্রক তুমিই। তোমার প্রকৃত দীনের আলোকদীপ্ত চিরায়ত কল্যাণের পথে সুপ্রতিষ্ঠিত কর। আমীন! সুম্মা আমীন!!
(উপ-রেজিস্ট্রার, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও পরিচালক, আল্লামা ‘আলীমুদ্দীন একাডেমী)
