Logo

জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীস বাংলাদেশ

Jamiyat Shubbane Ahl-Al Hadith Bangladesh

এই ওয়েবসাইটটি বর্তমানে উন্নয়নাধীন। সকল তথ্য খুব শীঘ্রই যুক্ত করা হবে ইনশাআল্লাহ!

মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহাব রহ. : সমকালীন বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনে তাঁর প্রভাব

মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহাব রহ. : সমকালীন বিশ্ব ইসলামী আন্দোলনে তাঁর প্রভাব

তানযীল আহমাদ
সাধারণ সম্পাদক, জমইয়ত শুব্বানে আহলে হাদীস বাংলাদেশ

১৯২৪ সালে উসমানীয় সালতানাতের চূড়ান্ত পতনের মধ্য দিয়ে মুসলিম জাহানের শক্তি ও স্বাধীনতার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়া হয়। শত শত বছরের জমানো ক্ষোভ আর জিঘাংসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে থাকে কুফরি বিশ্ব। সাম্রাজ্যবাদকে হাতিয়ার করে, পুঁজিবাদকে বর্ম করে, শান্তি, সম্প্রীতি ও স্বাধীনতার লেবাস পরিধান করে মৃত গরুর উপরে শকুনের দল যেভাবে ঝাপিয়ে পড়ে ঠিক তেমনি মুসলিম বিশ্বের ওপর একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ে কুফরি বিশ্ব। আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের নোংরা চিন্তা বাজারজাত করে প্রতিটি অঞ্চলকে অশান্তময় করে তোলে বিশ্ব মোড়লরা। গণতন্ত্রের কথা বলে এক অঘোষিত চলমান গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে দেয় দেশে দেশে। পুঁজিবাদের মুখোশ পড়ে সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থার মাধ্যমে হাতিয়ে নেয় মুসলিম বিশ্বের অর্থ সম্পদ। বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক নিরাপত্তার কথা বলে সেসব অঞ্চলে অস্ত্রের রমরমা ব্যবসা করে তারা। এমনকি নিরাপত্তর মিথ্যা বুলি আওড়িয়ে বিভিন্ন দেশে বিশ্ব মোড়ল আমেরিকা তার সৈন্যদের রাখার ব্যবস্থাও করে। এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে রাখালহীন ভেড়ার পালের কারণে। অর্থাৎ, নেতৃত্বহীন, খেলাফতবিহীন উম্মাহর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে।
স্মর্তব্য, উসমানীয় খেলাফত ১৯২৪ সালে বিলুপ্ত হলেও অনেক আগে থেকেই তা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো,

১. সতেরো শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে ভারতের মোঘল সাম্র্যাজ্যের অভ্যন্তরে ব্রিটিশ বেনিয়ারা নয়া সাম্যাজ্য কায়েম করে। যার নির্মম ভোগান্তি উপমহাদেশের মুসলমানদেরকে দীর্ঘ দিন যাবত পোহাতে হয়। কিন্তু উসমানীয় সালতানাত/ খেলাফত এ নিয়ে মাথা ঘামানোর সুযোগ পায় নি। উপরন্তু, উসমানীয় খেলাফতকে টিকিয়ে রাখার জন্য ভারতে খেলাফত আন্দোলন গড়ে ওঠে।

২. আরববিশ্বের হযবরল অবস্থা। সেখানের নিয়ন্ত্রণ উসমানীয়দের হাতে ছিল না বললে ভুল হবে না। শরীফ হোসাইন সেখানে নিজস্ব কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে।

৩. সাইরেনিকায় (বর্তমান পূর্ব লিবিয়া) সানুসী বিদ্রোহ আরম্ভ হয়।

৪. ১৯২৯ সালে গ্রীস স্বাধীনতা লাভ করে।

৫. ১৮৩০ সালে ফ্রান্স আলজিয়ার্স দখল করে।

৬. বলকানে রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার ইন্ধনে অস্থীতিশীল পরিবেশের সৃষ্টি হয়।

৭. ক্রাইমিয়ার যুদ্ধে (১৮৫৪-৫৬) ইংরেজ এবং ফরাসি বাহীনি মিত্রশক্তি হিসাবে নিজস্ব প্রয়োজনে সাহায্যের হস্ত সম্প্রসারণ করলেও তাতে প্রচুর অর্থহানী হয়।

মুসলিম বিশ্বের এই টালমাটাল অবস্থায় আজকের সৌদি আরবের নাজদে জন্মগ্রহণকারী মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব (১৭০৩-১৭৯২) এর ধর্মীয় সংস্কারমূলক আন্দোলন ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। রাজনৈতিকভাবে যেমনিভাবে মুসলিমরা চরম দুর্দশার শিকার, ধর্মীয় কুসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে তেমনই তাদের করুণ দশা হয়েছিল। মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব মূলত ধর্মীয় সংস্কারের কাজে হাত দেন। আরব ভূখন্ডে শিরক-বিদআতসহ অনৈসলামী রসম রেওয়াজের শিখণ্ডি উপড়ে ফেলতে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করেন। তার ও তার আন্দোলন সম্পর্কে আমাদের বিরুপ ধারণা থাকলেও এ দেশের সর্বজনমান্য শ্রদ্ধেয় আলেম মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী রহ. এর মূল্যায়ন

সকল ভুল ধারণা অপনোদনে যথেষ্ট। তিনি লিখেছেন:
তিনি মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব বিন সুলাইমান আত তামিমি আন নাজদি। আরব উপদ্বীপে আধুনিক ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের অগ্রনায়ক।

তিনি আরো লিখেছেন:
তিনি সালাফে সালেহিনের অনুসারী। খালেস তাওহীদের দিকে এবং বিদআতকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে ও ইসলামের মধ্যে সংযুক্ত হরেক রকমের কুসংস্কার নস্যাৎ করার প্রতি আহবানকারী ছিলেন।
[আত তাওহীদ ওয়াশ শিরক ওয়া আকসামুহুমা, ১৮ পৃঃ ৯ নং টিকা দ্রঃ]

উল্লেখ্য, শায়খ মুহাম্মাদ এর পূর্বেও ধর্মীয় সংস্কারের গুরু দায়িত্বের আঞ্জামের জন্য ভারেতের শায়খ আহমাদ সারহিন্দি মুজাদ্দেদে আলফে সানী রহ. সুপ্রসিদ্ধ ছিলেন। সম্রাট আকবর ও তদীয় পুত্র জাহাঙ্গীরের মিশ্রিত ধর্মীয় ধারার কঠোর সমালোচক ছিলেন তিনি।
যাই হোক, দীর্ঘদিন যাবত কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, ধর্মীয় স্থবিরতা, জড়তা কাটিয়ে উঠতে এবং মুসলমানদেকে সাহাবায়ে কেরাম ও ইসলামের প্রথম যুগের মানুষদের মত ইসলাম পরিপালন করতে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব নাজদে একটি সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলেন। সৌভাগ্যক্রমে, তিনি তার এই আন্দোলনের জন্য একজন রাজনৈতিক ভক্ত পেয়ে যান। তিনি হলেন মুহাম্মাদ বিন সউদ। মুহাম্মাদ বিন সউদ তখন নাজদের একজন উচ্চাকাংখী গোত্রপ্রধান, যিনি মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাবের নির্ভেজাল তাওহীদের দাওয়াতকে গ্রহণ করেন। তার সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন। এবং তার কন্যার পাণিগ্রহণ করেন। এভাবেই শায়খ মুহাম্মাদের সংস্কার আন্দোলন হালে পানি পায়। রাজনৈতিকভাবে সমর্থন পায়, বরং একথা বললে অতিরঞ্জন হবে না যে, জামাই-শ্বশুর উভয় মুহাম্মাদের আন্দোলন একাকার হয়ে পড়ে। কারণ শায়খ মুহাম্মাদের একনিষ্ঠ সমর্থকদের সমন্বয়ে গঠিত ‘ইখওয়ান’ বাহিনী নিয়েই ইবনে সউদের পরবর্তী বংশধর আব্দুল আযীয রিয়াদ দখল করেন এবং ক্রমান্বয়ে পুরো হেজাজে নিজের কতৃর্ত্ব প্রতিষ্ঠা করে।

মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাবের সংস্কার আন্দোলন খুব সহজেই হেজাজে জনপ্রিয়তা পায়। কারণ এই আন্দোলনের মূল কথাই হলো, কুরআন সুন্নাহ, সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে সালেহীনের পথে পরিচালিত হওয়া। গোটা আরব ভূখন্ডে ইসলামের নামে যে কবরপূজা, মাজারপূজা, পীরপুজার সয়লাব হয়ে গিয়েছিল তার মূলোৎপাটন করে মুসলমানদেরকে ইসলামের মূল ধারার সাথে একাকার করাই ছিল এই আন্দোলনের মুখ্য উদ্দেশ্য। শায়খ মুহাম্মাদের এই আন্দোলনে প্রভাবিত হয়ে মুসলিম বিশ্বের বেশ কয়েকটি অঞ্চলে একই রকম সংস্কার আন্দেলন শুরু হয়। এটা দাবী করা অসঙ্গত হবে না যে, উসমানীয় খেলাফত পরবর্তী বিশ্বব্যাপী ইসলামী আন্দোলনের পুরোধা হলেন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব রহ.। এজন্যই আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী রহ. লিখেছেন :
পুরো ইসলামী বিশ্বে অধুনা নবজাগরণে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহাবের দাওয়াতই ছিল প্রথম মশাল। হিন্দুস্তান, মিসর, ইরাক, শাম ও অন্যান্য অঞ্চলে সংস্কারপন্থীরা তার দাওয়াত দ্বারা প্রবাবিত হন। যেমন বাগদাদে আলুসী, আফগানিস্তানে জামাল উদ্দীন আফগানী, মিসরে মুহাম্মাদ আবদুহু, শামে জামাল উদ্দীন কাসেমী, তিউনিসে খাইরুদ্দীন তিউনিসি, হিন্দুস্তানে সিদ্দীক হাসান খান, কলকাতায় আমীর আলী প্রমুখ। আরব উপদ্বীপে তার সমর্থকদের আহলুত তাওহীদ (তাওহীদপন্থী) বলা হয়। তাদের বিরোধীরা তাদেরকে ওহাবি নামে আখ্যায়িত করে। [আত তাওহীদ ওয়াশ শিরক, ১৮ পৃঃ ৯ নং টিকা দ্রঃ]

মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহাবের আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত বিশ্বের বিশ্বে অন্যান্য ইসলামী অন্দোলনসমূহ :
১. সানুসী আন্দোলন :
সানুসী আন্দোলনের প্রবক্তা মুহাম্মাদ বিন আলী বিন সানুসী (১৭৮৭-১৮৫৯) আলজেরিয়ার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। লেখাপড়া করতে মক্কায় আসলে শায়খ মুহাম্মাদরে সংস্কার আন্দোলনের সাথে পরিচিত হন এবং মনেপ্রাণে তা গ্রহণ করেন। দেশে ফিরে গিয়ে সমাজ সংস্কারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। সুদান, আলজেরিয়াসহ উত্তর ও পূর্ব আফ্রিকায় তার দাওয়াত বেগবান হয়। বর্তমান লিবিয়ার বিস্তীর্ণ মরুভূমিতে বসবাসরত বিভিন্ন বেদুঈন সমাজে তার দাওয়াত সফল হয়। আলজেরিয়া ও সুদানেও তার দাওয়াত সাদরে গৃহীত হয়। উল্লেখ্য, সানুসী ও সৌদি আরবের ওহাবি আন্দোলনের পার্থক্য ছিল এর উপস্থাপনায়। হিজাজে ইখওয়ানরা যেভাবে বিরোধিদের এপর ক্ষিপ্ত ও চড়াও ছিল সানুসীর কর্মীরা তেমনটা ছিল না। মুহাম্মাদ সানুসী তার আন্দোলনের জন্য ভালবাসা, দরদ ও বিনয়কে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছেন। এজন্যই, যে আন্দোলন হেজাজে উসমানীয়দের বিরোধীতার সম্মুখীন হয়েছিল, সেই একই আন্দেলন উত্তর-পূর্ব আফ্রিকায় তাদের সাহায্য সমর্থন পেয়েছিল। এমনকি সুলতান আব্দুল হামীদ ১৮৫৬ সালে এক রাষ্ট্রীয় ফরমানে সানুসী কতৃর্ক প্রতিষ্ঠিত দাওয়াতের খানকাগুলোকে পবিত্র ও নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসাবে ঘোষণা দেন।

ধর্মীয় সংস্কারমূলক আন্দোলন হিসাবে সানুসী আন্দোলনের সূচনা হলেও একসময় তা সশস্ত্র আন্দোলনে রুপ নেয়। কারণ ইটালী তার সাম্ররাজ্যবাদী চেহারা প্রদর্শনের জন্য ১৯১১ সালে ত্রিপলী আক্রমণ করে বসে। তখন স্বদেশ স্বজাতিকে রক্ষার জন্য সানুসীরা হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীতে ১৯৫০ সালে মুহাম্মাদ সানুসীর পৌত্র আল সাঈদ মোহাম্মাদ ইদ্রীসের হাত ধরে বর্তমান লিবিয়ার জন্ম হয়।

২. মাহদীয়া আন্দোলন :
এই আন্দোলনের সূতিকাগার সুদান। সুদানের লাবাব দ্বীপের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মুহাম্মাদ আহমাদ মাহদী ১৮৪৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। মারা যান ১৯৮৫ সালে। ছোট বেলায় কুরআনুল কারীম হিফয করেন। রাজধানী খার্তুমে উচ্চশিক্ষার জন্য গমন করলে বড় বড় আলেম, সূফি ও রাজনীতিবিদের সাথে পরিচিত হন। মুহাম্মাদ মাহদী ধর্মীয় শিক্ষার ফলে সমাজে পূণ্যবান ও নিলোর্ভী হিসাবে বিবেচিত হতেন। সুদানে তখন মিসরের কর্তৃত্ব বজায় ছিল। ফলে মিসরীয় সূফীবাদের বিভিন্ন ধারা এবং মাজার, খানকাহ ও পীরকেন্দ্রীক শিরক বিদআতের ব্যাপক প্রচলন ছিল সুদানে। মাহদী একদিকে যেমন ধর্মীয় সংস্কারে আত্মনিয়োগ করে মুসলিমদেরকে সাহাবায়ে কেরাম ও ইসলামের প্রথম যুগের মূল ধারায় ফিরিয়ে নিতে চেষ্টিত হন এবং এক্ষেত্রে তিনি ওহাবি আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হন, বিশেষত নিকটস্থ লিবিয়ায় সানুসী আন্দোলন দ্বারা, অপরদিকে, সুদান থেকে ব্রিটিশ আশ্রিত মিসরীয়দেরকে সুদান ছাড়া করতে একটি দক্ষ সেনাবাহীনি গঠন করেন। অর্থাৎ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উভয় দিক থেকে তিনি সুদানে একটি বৃহত্তর গণআন্দোলনের সৃষ্টি করেন। ১৯৫৫ সালে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত সুদানে অদ্যাবধি মাহদীয়া আন্দোলনের ছাপ সুস্পষ্ট। সুদানের জনগণের মধ্যে গভীর রেখাপাত করে এই আন্দোলন। প্রফেসর এবিএম হোসেন রিখেছেন, ‘মাহদী আন্দোলন ও বিদ্রোহ এবং বৃটেন ও মিসরের বিরুদ্ধে তার কৃতকার্যতায় সমসাসয়িক মুসলিম বিশ্বে একটি আস্থার সৃষ্টি হয় যে, নিজেদের উজ্জীবনের মাধ্যমে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শাসন যত শক্তিশালী হোকনা কেন, তা অবসান ঘটানো সম্ভবপর।’

৩. জিহাদ আন্দোলন :
মোঘল সাম্ররাজ্যেও পতনের মধ্য দিয়ে ভারতে সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ শাসনের সূচনা হয়। এরই মাধ্যমে ভারতের মুসলমানদের ভাগ্যাকাশে দুর্দিনের এমন সূর্য উদিত হয় যা এখনও অস্ত যায় নি। বৃটিশ ভারতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদে সর্বপ্রথম এগিয়ে আসেন আহলে হাদীস ওলামায়ে কেরাম। এই জিহাদ আন্দোলন আঠারো শতকের শুরুভাগ থেকে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বৃটিশদেরকে বেকায়দায় ফেলে দেয়। যদিও ইংরেজ শাসনের শুরুতেই শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর সতর্কতা, ধর্মীয় পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ এবং তদীয় পুত্র শাহ আব্দুল আযীয়ের ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা মুসলমানদেরকে, বিশেষকরে আহলে হাদীসদেরকে উজ্জীবিত করেছিল এবং তারা সশস্ত্র জিহাদে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন, কিন্তু সৈয়দ আহমাদ ব্রেলভী ও শাহ ইসমাঈল শহীদের বালাকোট আন্দোলন ও ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে ইমারতে ইসলামী প্রতিষ্ঠায় হেজাজের শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহাবের সংস্কার আন্দোলনের প্রভাব লক্ষণীয়। এই প্রভাব এত বেশী প্রকট যে, আহলে হাদীসদেরকে ইংরেজরা ওহাবি নামে আখ্যা দেয়া শুরু করে। ওহাবি দেখলেই তারা তাদের জেলখানায় ধরে নিয়ে যেত। যাইহোক, পাক ভারত উপমহাদেশের মুসলমানদের মধ্যে শিরক বিদআতের সয়লাব কারো অবিদিত নয়। এসব শিরক বিদআত মূলোৎপাটনে শাহ ইসমাঈল শহীদ রহ. ময়দানে অবতীর্ণ হন। তিনি সৈয়দ আহমাদ ব্রেলভীর প্রধান সেনাপতি হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন। সেনাবাহীনির মধ্যে শিরক বিদআতের বিরুদ্ধে তিনি অগ্নিঝরা বক্তব্য দেন। তাকবিয়াতুল ঈমান নামক মূল্যবান গ্রন্থ রচনার মাধ্যমে সকলকে শিরক বিদআতের বিরুদ্ধে চূড়ান্ততাবে সতর্ক করেন। গ্রন্থখানি ভারতের প্রেক্ষাপটে এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, হেজাজের শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহাবের কিতাবুত তাওহীদের সমমানের এবং ততখানিই প্রভাববিস্তারকারী।

ক. ইমাম শামিল রহ.
যিনি দাগিস্তানের মুজাহিদ নামে পরিচিত। তার সময়কাল (১৮৩০-১৮৫৯)। ইমাম শামিল হানাফি মাযহাবের অনুসারী হলেও সংস্কার ও জিহাদের ক্ষেত্রে তিনি পূর্বসূরী সালাফদেরকেই অগ্রাধিকার দেন। দাগিস্তান, চেচনিয়া ও ককেশাসের পাহাড়ি অঞ্চলে বেড়ে ওঠা ইমাম শামিল আঞ্চলিক গোত্রগুলোতে যেমন ধমীর্য় সংস্কারের কাজ চালিয়ে যান তেমনি রাশিয়ার জারের বিরুদ্ধে দীর্ঘ চল্লিশ বছরেরও বেশী সময় ধরে জিহাদে নেতৃত্ব দেন। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে তিনিও যে হেজাজ ভূমিতে চলমানু গণআন্দোলনে মুগ্ধ ছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
খ. আব্দুল কাদির আল জাযায়েরি রহ.
আলজেরিয়ার মর্দে মুজাহিদ আব্দুল কাদির রহ. ফরাসী ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে জিহাদ করে শাহাদাত বরণ করেন। তার সময়কাল ১৮০৮-১৮৮৩ খ্রি.। দীর্ঘ পনেরো বছর তিনি ফরাসী ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে জিহাদে নেতৃত্ব দেন। আলজেরিয়ার স্বাধীনতার জন্য অমর হয়ে আছেন তিনি।
গ. উসমান দান ফদিয়োর (১৭৫৪-১৮১৭)
ফরাসীদের বিরুদ্ধে তার আন্দোলনের ফলে নাইজেরিয়া স্বাধীনতা লাভ করে। তিনিও মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহাবের সংস্কার আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।
ঘ. মাহমুদ আলুসী
আবুস সানা শিহাব উদ্দীন মাহমুদ বিন আব্দুল্লাহ আল আলুসী আল বাগদাদী আল হুসাইনী (১৮০৩-১৮৫৪) বাগদাদে জন্মগ্রহণকারী বিরল প্রতিভার অধিকারী একজন শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, ফকিহ ও মুজতাহিদ। তার শ্রেষ্ঠত্বের সেরা নিদর্শন রুহুল মাআনী নামক বিখ্যাত তাফসীরগ্রন্থ। শাফেঈ মাযহাবের অনুসারী হলেও মানহাজ ও আকীদার ক্ষেত্রে তিনি পুরোপুরি সালাফি ছিলেন। এর প্রমাণ মিলে আল্লাহর আসমা ওয়া সিফাতের ক্ষেত্রে তার অবস্থান। রুহুল মাআনী পড়লেই তা প্রতিভাত হয়ে উঠবে। আল্লামা আলুসী রহ. তার চিন্তাধারা ও সালাফি আকীদার ক্ষেত্রেও মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহাবের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, আলুসীর পরিবারকে আল্লাহ তাআলা ইসলামের জন্য কবুল করে নেন। ফলে তার সন্তান আব্দুল্লাহ আলুসী, আহমাদ শাকের আলুসী, নু‘মান আলুসী ও আব্দুল বাকী আলুসী সকলেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে ইলমের খেদমত করে গেছেন। মুসলিম বিম্বে বাগদাদেও এই পরিবার ইলমী পরিবার হিসাবে সমাদৃত।

উপসংহার : ধর্মীয় কুসংস্কারে নিমজ্জিত মুসলিমদেরকে ইসলামের স্বচ্ছ ঝর্ণাধারায় অবগাহনের জন্য দাওয়াত, তাবলীগ, জিহাদ সহ সর্বক্ষেত্রে সরব পদচারণার জন্য শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহাবকে হিজরি বারো শতকের মুজাদ্দিদ হিসাবে গণ্য করা হয়। তার দাওয়াত ও সংস্কার আন্দোলনে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের সংস্কারকরাও প্রভাবিত ছিলেন এবং এরই ফলে দীর্ঘদিন যাবত কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, ইসলামের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন, স্থবির ও পশ্চাদপর মুসলিম জাতি মুক্তির প্রকৃত পথের সন্ধান লাভে ধন্য হয়। খালেছ তাওহীদের দাওয়াত ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে। উম্মাহকে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তিনি। ইমাম ইবনু তাইমিয়ার পর আরববিশ্বের সবচেয়ে বড় সংস্কারক হিসাবে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহাবকেই গণ্য করতে হবে।

আল্লাহ তাকে জান্নাতবাসী করুন। তার দাওয়াত ছড়িয়ে পড়ুক মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি ঘরে ঘরে। আমীন।

সহায়ক গ্রন্থাবলী :
১. আত তাওহীদ ওয়াশ শিরক ওয়া আকসামুহুমা, জুনায়েদ বাবুনগরী
২. হাযিরুল আ’লাম আল ইসলামী, ড. আহমাদ হাররান
৩. মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস অটোমান সাম্রাজ্য থেকে জাতিসত্তা রাষ্ট্র, প্রফেসর এ বি এম হোসেন
৪. মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাস (উনিশ ও বিশ শতক), এম এ কাউসার
৫. আধুনিক মধ্যপ্রাচ্য, সফিউদ্দীন জোয়ারদার
৬. উইকিপিডিয়া।