
অভিভাষণ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আব্দুল বারী (রহ)
2002
তারিখ: ০৮ই ফেব্রুয়ারি ২০০২ইং সময়: সকাল ১১.৩০টা স্থান: জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন। ওয়াসসালাতু ওয়াসসালামু আলা খাইরি খলকিহি মুহাম্মাদিও ওয়ালা আলিহি ওয়া সাহবিহি আজমা‘ঈন। আম্মা বা‘দ। আ‘উযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম। বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম। “সিবগাতাল্লাহ। ওয়া মান আহসানু মিনাল্লাহি সিবগাহ। ওয়া নাহনু লাহু ‘আবিদুন।” ওয়া কালা নাবিয়্যুল আমীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম “তারাকতু ফীকুম আমরাইন। লান তাযিলু মাতামাসসাকতুম বিহিমা কিতাবাল্লাহি ওয়া সুন্নাতি।”
জনাব সভাপতি, মাননীয় বিশিষ্ট অতিথিবৃন্দ, সমবেত ভ্রাতৃমণ্ডলী, স্নেহের শুব্বান ছেলেরা। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমতুল্লাহি ওয়া বারা কাতুহু।
আমি সর্বপ্রথম আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বারগাহে সিজদায়ে শোকর আদায় করছি, যিনি আমাকে অনেক বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও আজকে জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীসের এ কেন্দ্রীয় সম্মেলনে যোগদান করার তাওফীক আতা করেছেন। আমি শারীরিকভাবে সুস্থ নই। মানসিকভাবেও অত্যন্ত বিপর্যস্ত। প্রফেসর ড. আযহার উদ-দীন যেমনটি বললেন, আজকে সকাল ৮.০০টা থেকে দুপুর ১২.০০টা পর্যন্ত আমার বড় জামাতা প্রফেসর ড. এরশাদুল বারীর একটি কিডনী সংযোজন হয়েছে। দিল্লীর এপোলো হাসপাতালে। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের মেহেরবানী অপারেশন তো সফল হয়েছে কিন্তু এর পর আল্লাহ রব্বুল আলামীন আরোগ্য দেবেন কি দেবেন না, তার মালিক তিনি।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অশেষ মেহেরবানী আমাদের ভাইরা যে যেখানে ছিলেন, তাদের মধ্যে মুরুব্বীরা ছিলেন, যুবকরা ছিলেন, তরুনরা ছিলেন, তার ছাত্ররা এবং আমাদের ছাত্ররাও দু'আ করেছে হয়তোবা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সবার দু'আর বরকতে মাফ করতে পারেন। আজ জুমার দিন, পবিত্র দিন। সালাতুল জুমার পর যদি আমার জন্য দু'আ করেন আমি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট কৃতজ্ঞ থাকব। নিশ্চয় আপনাদের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো। আপনারা সবাই ঢাকার বিভিন্ন মসজিদে নামায আদা করে থাকেন। সেখানে যাবার জন্য আপনারা ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। আমি অতি সংক্ষেপে আজকে দু-চারটি কথা আপনাদের সামনে তুলে ধরবো।
প্রথম কথা হলো- আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠানের শেষ নেই। প্রত্যেক দিনই একটা না একটা নূতন নূতন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। সেটা বড়দের মধ্যে যেমন হচ্ছে ছোটদের মধ্যেও তেমন হচ্ছে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলির আদর্শ কি? লক্ষ্য কী? তাদের উদ্দেশ্য কী? তাদের কর্মপদ্ধতি কী? কর্মসূচি কী? আমরা অবহিত হতে পারি না। যদি সেই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলদেরও জিজ্ঞাসা করা হয় আজকে যে প্রতিষ্ঠান দাঁড় করলেন, এ প্রতিষ্ঠান কী উদ্দেশ্যে করলেন? তারা সবাই কিন্তু তার সমুচিত জবাব দিতে পারেন না। তার কারণ এই অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান আমরা দেখছি হয় ব্যক্তিভিত্তিক, অথবা গোষ্ঠীভিত্তিক, অথবা স্বার্থভিত্তিক, অথবা কোন একটা বিশেষ ক্ষণে, একটা বিশেষ মুহুর্তে, বিশেষ একটা উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে গঠন করে থাকেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, এই সংগঠনগুলো খুব একটা নীতি নৈতিকতা মেনে চলে না। এ সমস্ত সংগঠনের নেতা-নেত্রী এবং যারা পরিচালক পরিচালিকা আছেন তারাই নিজেদের মধ্যে বার বার যে ডেমোক্রেসির (Democracy) কথা বলেন তা নিজেরাই অনেকে বোঝেন না। আজকে যেমন আপনারা এর একটা চরম পরিচয় লাভ করলেন। কিছুক্ষণ আগে আমাদের ভাই ওবায়দুল্লাহ গযনফর আমাদের জানালেন, জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীসের নেতৃবৃন্দ নির্বাচিত হয়েছে গোপন ব্যলটে। কেউ এদের মধ্যে কিন্তু প্রার্থী হতে পারনি। কেউ প্রার্থীতা ঘোষণা করতে পারনি। কেউ কারো পক্ষে কোন বক্তব্য রাখতে পারেননি। কর্মীরা, 'মাজলিসে আমে'র ছেলেরা সমবেত হয়ে মনে করেছে যাদেরকে দিয়ে আল্লাহর ফযল ও করমে জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীস-এর উদ্দেশ্য সফলভাবে বাস্তবায়িত হবে, যারা শুব্বানের খেদমত করতে পারবে, যারা জামাত ও জমঈয়তের খেদমত আঞ্জাম দিতে পারবে, তাদেরকে তারা নির্বাচন করেছে।
এখানেই দেখুন, আমরা সারা দুনিয়াসুদ্ধ সবসময় চিৎকার শুনে থাকি- গণতন্ত্র গণতন্ত্র আর গণতন্ত্র। কত রকম গণতন্ত্রের চেহারা আমরা দেখলাম। একটা হোয়াইট হলের গণতন্ত্র দেখলাম। একটা হোয়াইট হাউসের গণতন্ত্র দেখলাম। আমরা এলিসি প্যারিসের গণতন্ত্র দেখলাম, মুগাবে সাহেব আবার আরেক গণতন্ত্র আমাদের দেখাচ্ছেন। গণতন্ত্রের রূপের শেষ নেই। আমরা কিন্তু এ ধরনের নামকা ওয়াস্তে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি না। বরং আমাদের নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ যে কথা বলেছেন, আমরা প্রত্যেকেই মানুষ এবং মানুষ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব বেঁধে দেয়া হয়েছে, "রব্বানা মা খালাকতা হা-যা বাতিলা।"
আজকে যে ছেলেটি সর্বপ্রথম কুরআন মজিদ থেকে তেলাওয়াত করেছে সেখানে এ আয়াতের অংশটুকু আছে। অথচ আমরা মনে করি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের খামাখা এখানে নিয়ে আসলেন। আমরা এখানে স্বার্থপরের মত যার যা উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য পাগলপারা হয়ে একেবারে ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত, হালাল-হারাম, গ্রহণযোগ্য-বর্জনযোগ্য, বিবেচনা না করে আমার মন যা চাইলো একটিা বিশেষ মূহুর্তে আমার প্রবৃত্তি আমাকে পরিচালিত করলো, যে প্রবৃত্তির দাস হয়ে জীবনটাকে শেষ করে ফেললাম। এরকম উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীস বা জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীস গঠিত হয় নাই। জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীসের একটি গঠনতন্ত্র আছে। লিখিত গঠনতন্ত্র দিয়ে তারা তাদের জীবন শুরু করেছে এবং সেখানে তারা প্রথমেই বলছে, তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো- “কালেমা তাইয়্যেবাকে যথাযথ উপলব্ধি করত জীবনের সর্বস্তরে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।”
আজকে আমরা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান যে, আমাদের মাঝে যেসমস্ত বিশেষ অতিথি এসেছিলেন, তারা যেসমস্ত মূল্যবান ভাষণ রেখেছেন তা আমাদের অনেকের জন্য জীবন চলার পথের পাথেয় হয়ে থাকবে। যে কথাটা আমাদের বিদেশী মেহমান বললেন এবং তাঁর মুখ থেকে এ কথাটা আসাতে আমি অন্তত লজ্জিত হয়েছি। আমাদের নিজেদের মধ্যে যদি কেউ বলতেন তাহলে এতটা লজ্জা হতো না। যদিও তিনি বাংলাদেশে অবস্থান করে, বাংলাদেশীদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন কিন্তু এটা শুধু বাংলাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটা এখন পৃথিবীতে সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বলতে চাচ্ছেন, আজকে আমাদের কী হয়েছে যে আমরা মা-আছির সম্বন্ধে সতর্ক ও সাবধান। এবং সেজন্য আমাদের মধ্যে এলমে নাফে গায়েব হয়ে গেছে। যে জ্ঞান, যে বুদ্ধি, যে বিবেক, যে বিবেচনা থাকলে সত্যকে সত্য বলে আমরা গ্রহণ করতে পারি অসত্য ও মিথ্যা বলে বর্জন করতে পারি। সে বিবেকটুকুও আমি হারিয়ে ফেলেছি। যদি এতে আমার স্বার্থসিদ্ধ হয়, উনি কিন্তু বলেছেন ইমাম শাফেঈ রাহিমাহুল্লাহ এর উদাহরণ দিয়ে, যদি এটা আমার স্বার্থের পরিপোষক হয় তাহলে আমি আলেম হই আর জালেম হই, আমি সমাজের নেতা হই বা সমাজের সাধারণ সদস্য হই, আমি একটা শিক্ষায়তনের প্রধান হই বা একজন শিক্ষার্থী হই, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদ ভাইস চ্যান্সেলর যারা অলংকৃত করেন তারাই হন অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ সর্বনিম্ন ক্লাসের ছাত্র হই, আমরা কেউ কিন্তু আদর্শের প্রতি যত্নবান হচ্ছি না। মেহমান যে কথাটা বললেন, আমরা এখন অত্যন্ত সংকীর্ণভাবে আমাদের দৃষ্টিকে ছোট করতে করতে করতে এমন একটা অবস্থায় পৌঁছে গেছি যখন আমরা জগতটাকে মহাবিশ্বের মধ্যে দেখি না। মহাবিশ্বের সামান্য একটা ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আমার নিজস্ব পরিমণ্ডলে আমার স্বার্থসিদ্ধির একটা বৃত্তের মধ্যে আমরা এটাকে গুটিয়ে ফেলেছি। এবং সেজন্যই আজকে সমাজে কোন আইন এবং শৃঙ্খলা নেই। সমাজে কোন ন্যায় ও নীতি নেই, সমাজে ভালো ও মন্দের জ্ঞান আমরা হারিয়ে ফেলেছি। বড় ও ছোটর জ্ঞানও আমরা ক্রমে হারিয়ে ফেলছি। এমনকি শিক্ষাঙ্গনগুলোও আমরা আজকে শিক্ষাঙ্গন না করে রণাঙ্গনে পরিণত করেছি। একথাটা মাওলানা মোবারক আলী সাহেব অত্যন্ত সুন্দর ও হৃদয়গ্রাহীভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। তো এই যখন আমাদের দেশের অবস্থা, যখন একটা মোরালিটির ক্রাইসিস (Morality Cricis) চলছে, যখন একটা নীতিনৈতিকতার দুর্ভিক্ষ চলছে, তখন এই দেশে একটা নীতিভিত্তিক, আদর্শভিত্তিক, বিশেষ গুণবিশিষ্ট- যে আদর্শ ও গুণে আমার বাহ্যিক উন্নতির চেয়ে, অগ্রগতির চেয়ে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি অর্জনটাই বড় সেরকম একটা প্রতিষ্ঠান চালানো চাট্টিখানি সাহসের কথা নয়। যদি এ বাচ্চারা আজকে এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে, তাদের ফেস্টুনে আপনারা লক্ষ্য করলে দেখবেন এখানে কোথায় যেন আছে, তাদের নিজেদের কর্মসূচি ৫টি।
প্রথমটি হলো- একটা ইসলাহুল আক্বীদা বা আক্বীদা সংশোধন করা। তার কারণ আগেতো নিজেকে সংশোধন করতে হবে। ইমাম শাফে'ঈ যেমন বললেন, আমি যে মানুষ, আমি যে আল্লাহর বান্দা, আল্লাহ যে আমাকে সৃষ্টি করেছেন বিশেষ একটা উদ্দেশ্যে এবং সেই উদ্দেশ্য সফল করার জন্য তিনি আমাদের কিছু পথ বাতলিয়ে দিয়েছেন। ছেলেরা বাংলায় আমাদের সামনে যে গযলটি পেশ করলো ওটাতো আসলে সূরা ফাতিহার তাফসীর ছিলো, "ইহদিনাস সিরাতাল মুসতাকিম। সিরা তুল্লাযিনা আন আমতা আলাইহিম।" ইত্যাদি। আমাদের নিজেদের চরিত্রের মধ্যে যদি কোন দোষ থাকে- এই যে আমাদের মেহমান যেমন বললেন, "একটা অন্যায় করলে একটা কালো দাগ পড়ে, আরেকটা করলে আরেকটা দাগ হয়, আরেকটা করলে আরেকটা দাগ হয়, এরপর আমাদের অবস্থা ঐরকম হয়ে যায়, "খাতামাল্লাহু আলা কুলুবিহিম"। আমাদের সব খতম হয়ে যায়। আপনি বাজারের এভেলেবল যত ভালো ডিটারজেন্ট নিয়ে আসেন না কেন, যতই ঘষামাজা করেন না কেন, যতই চেষ্টা করেন না কেন, আমার মন থেকে সে কালিমা আর দূর হয়ে যায় না। আমার মধ্যে যখন একটা ছাপ পড়ে যায়। যে ছাপের কারণে আমি সত্যকে সত্য বলে আর দেখতে পাই না। কাজেই বাচ্চারা নিজেরা সৎ হতে চেষ্টা করছে। নিজেদের আক্বীদা ঠিক করতে চেষ্টা করছে। শির্ক, বিদআত, তাকলীদ, কুফর এবং ইলহাদ সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করছে। এর মানে তারা আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সঙ্গে একটা সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য আগ্রহী হয়ে এসেছে।
আজকে তারা প্রায় ১০-১২ জনকে দিয়ে আমাদের বুড়োদেরকে বকিয়ে নিল, এর চেয়ে তাদের একজন যদি নিজেদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি সম্পর্কে আমাদের সামনে তুলে ধরতো তাহলে আমরা অনেকেই লজ্জা পেতাম এবং আমরা আমাদের বাচ্চাদের থেকে অনেক কিছু শিখতাম। সবসময় যে বড়রাই শিক্ষা দেয় আমি এটাতে বিশ্বাস করি না। অনেক সময় ছাত্রদের কাছ থেকেও অনেক কিছু শেখার আছে। আমরা আমাদেও ছোটদের থেকে অনেক কিছু শিখতাম। আমার ছেলেমেয়েদের কাছ থেকেও অনেক কিছু শেখার আছে। আমার বাচ্চা অনেক সময় বলে, আব্বা এটা কি সত্যিকার কাজ হচ্ছে? আমার বাচ্চারা আমাকে বলতে পারবে, ঐ যে আমাদের মেহমান 'হায়া'র কথা বললেন, কিন্তু হায়া তো দুনিয়া থেকে উঠেই গেছে। সেজন্যই তো আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, "আল হায়ায়ু শুবাতুল মিনাল ইমান"- যার হায়া নেই সে বেহায়া, সে বেইমান। কিন্তু আজকে বেইমানতো সবাই হয়ে পড়েছি। আমরা সবাই বেহায়া হয়ে গেছি। আমরা প্রত্যেকেই লেজ কেটে ফেলেছি। এইজন্য লেজওয়ালা কিছু দেখতে আমরা প্রস্তুত নই। আমি যে কথাটা বলেছিলাম, যে বাচ্চারা প্রথমত নিজেদের আক্বীদা ঠিক করতে চাইছে।
তারপর তারা বলেছে, তারা দাওয়াত ও তাবলীগ করবে। তাদের কাছে আমাদের অনুরোধ যে "বাবারা, তোমরা কিন্তু সবসময় মনে রাখবে- ইসলাম দুনিয়াতে অশান্তি নিয়ে আসতে আসেনি। ইসলাম সবসময় দুনিয়াতে শান্তির বাণী নিয়ে এসেছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মাধ্যমে আল্লাহ রাববুল আলামীন আরবদের যে শাস্তি ও সমৃদ্ধি দিয়েছেন তা বিশ্ববাসীর কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। অমুসলিম ঐতিহাসিকরা এক বাক্যে স্বীকার করেছেন, কুরআনের ঐ আয়াত "ওয়াযকুরু নি'য়মাতাল্লাহি আলাইকুম ইয কুনতুম আ'দাআন ফাআল্লাফা বাইনা কুলুবিকুম ওয়া আসবাহতুম বিনি'মাতিহি ইখওয়ানা" আল্লাহ পাক তার নবী মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মাধ্যমে ঘৃণিত একটি গোষ্ঠী, যেখানে প্রত্যেকে প্রত্যেকের মৃত্যু কামনা করতো, প্রত্যেকে প্রত্যেকের ধ্বংস কামনা করতো, আপোষে লড়াই করাই তাদের জীবিকা ছিলো, তাদেরকে তিনি সম্প্রীতির ডোরে, একটি স্নেহের ডোরে, একটি মমতার ডোরে, একটি ভ্রাতৃত্বের ভোরে বেঁধে দিলেন। তোমরা কিন্তু মনে রেখো, তোমাদের "উদউ ইলা সাবিলে রাব্বিকা বিল হিকমাতে ওয়াল মাওইযাতিল হাসানাতি ওয়া জাদিলহুম বিল্লাতি হিয়া আহসান।" তোমরা সুন্দরভাবে, আকর্ষণীয়ভাবে, অত্যন্ত সহজ-সরল ভাষায়, লোকের মনকে জয় করে নিয়ে তোমরা দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ আঞ্জাম দিবে।
আজকে সারা বিশ্বের জ্যেঠা হয়ে বসেছেন অনেকেই। আগে বিভিন্ন রকমের সাম্রাজ্যবাদ ছিলো। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ছিলো। ফরাসী সাম্রাজ্যবাদ ছিলো। ডাচ্ সাম্রাজ্যবাদ ছিলো। পর্তুগীজ সাম্রাজ্যবাদ ছিলো। এমনকি কিছুদিনের জন্য জার্মানও সাম্রাজ্যবাদ ছিলো। কত কিসিমের, কত রকমের, কত ফের্কার আমরা সাম্রাজ্যবাদ দেখেছি। এখন মনে হচ্ছে যে একক সাম্রাজ্যবাদ। তারা যা বলবেন সেটাই ঠিক। আর সেটাই সবাইকে মেনে নিতে হবে। এখন নতুন করে তারা বোধহয় হিউম্যন রাইট্ট্স এর ডেফিনেশন Defination) দিবেন। এখন নতুন করে হয়তো তারা ফান্ডামেন্টাল রাইট্স (Fundamental Rights), মানুষ হিসেবে আমাদের যে মৌলিক অধিকার আছে সে সম্পর্কে আমাদেরক অবহিত করতে চেষ্টা করবেন।
“মান কাতালা নাফসান বিগাইরি নাফসিন আও ফাসাদি ফিল আরদি ফাকা আন্নামা কাতালান নাসা জামিয়া। ওয়া মান আহইয়াহা ফা কাআল্লামা আহইয়ান নাসা জামিয়া।” একটি জীবনকে রক্ষা করা সারা মানবতাকে রক্ষা করার সমান বলা হয়েছে। এবং একটি জীবনকে অন্যায়ভাবে হরণ করা সারা বিশ্বের লোককে তাদের জীবন থেকে বঞ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। অথচ আজকে একবিংশ শতকে যারা সবচেয়ে বড় সভ্যতার দাবীদার তারা দেদারচে মানুষ খুন করে চলেছেন। তাদের খুনী বলা চলবে না। আর আমাদের সমাজেও দেখুন না দৈনিক খবরের কাগজে। তখন সর্বপ্রথম কি দেখি? কাউকে খুন করা হয়েছে। কাউকে ধর্ষণ করা হয়েছে। কাউকে জবাই করে মেরে ফেলা হয়েছে। কাউকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলার পর আগুন দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এগুলো সভ্য সমাজের কাজ? এগুলো মনুষ্যত্বের কাজ? তাহলে আল্লাহ রব্বুল আলামীন কেন আমাকে বললেন- যে একটি জীবন রক্ষা করলে তো গোটা মানবতাকে রক্ষা করলে। আর একটি জীবনকে অন্যায়ভাবে যদি কেড়ে নাও তাহলে গোটা মানবতাকে হত্যা করলে।
আমাদের বাচ্চারা আল্লাহর ফযল ও করমে কুরআনের সত্য বাণীগুলো তুলে ধরবেন। তারা এই কথাই বলবেন, “সিবগাতাল্লাহ ওয় মান আহসানু মিনাল্লাহি সিবগাহ।” দেখ, আল্লাহর বান্দ্য হিসেবে আল্লাহ রব্বুল 'আলামীন তোমাকে যে সমস্ত গুণাবলি দিয়েছেন, তোমার মধ্যে যে সকল মানবীয় সম্ভাবনাকে সুপ্ত রেখেছেন, সেগুলোকে পূর্ণ বিকশিত করে, ইনসানে কামেল হয়ে, পরস্পরকে ভালোবেসে, পরস্পরকে “তাওয়াআনু আলাল বিররে ওয়াত তাকওয়া'র মাধ্যমে প্রত্যেকে প্রত্যেককে সাহায্য করে, ন্যায়ের পথে, সত্যের পথে, বৃদ্ধির পথে, মুক্তির পথে, সফলতার পথে চলো আমরা সকলে মিলে এগিয়ে যাই। আমরা হিংসাকে পরিত্যাগ করি। আমরা সন্ত্রাসকে পরিত্যাগ করি। আমরা বিদ্বেষকে পরিত্যাগ করি। আমরা কুৎসা রটনাকে পরিত্যাগ করি। আমরা আমাদের মুরুব্বীদের সম্মান করতে শিখি। আমরা আমাদের ছোটদেরকে ভালোবাসতে শিখি। আমরা লোকের দিকে আমার সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের হাত বাড়িয়ে দিই। আমরা পরস্পর পরস্পরকে আলিঙ্গন করে, আমরা মানুষ সবাই যে এক আল্লাহর বান্দা, ওই আদম ও হাওয়ার সন্তান- “ইন্না খালাকনাকুম মিন যাকারিও ওয়া উনসা ওয়া জা'আলনাকুম শু‘যুবাওঁ ওয়া কাবায়িলা লিতা‘ আরাফু ইন্না আকরমাকুম ‘ইনদাল্লাহি আতক্বাকুম।” আমার ব্যাংক ব্যালেন্স দিয়ে, আমার চেহারা দিয়ে, আমার কাপড়-চোপড় দিয়ে, আমার গুলশান বনানীতে কতগুলো বাড়িঘর আছে, কতগুলো ইনডাস্ট্রি আছে? আমি কত জায়গায় বড় বড় বক্তৃতা করতে পারি? এগুলো দিয়ে কিন্তু আমার মর্যাদার পরিমাপ করা হবে না। আমাকে মূল্যায়ন করা হবে না। বরং মূল্যায়ন সেটা দিয়ে হবে আমি কতটা তাকওয়ার অধিকারী। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা যেসমস্ত গুণে গুণান্বিত করে আমাকে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ করে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন সেই সৃষ্টির সেরা মানুষ যদি শেয়ালের চেয়ে ধুর্ত হয়, সৃষ্টির সেরা মানুষ যদি ঐ কাকের চেয়ে প্রতারক হয়, সৃষ্টির সেরা মানুষ যদি বাঘের চেয়ে হিংস্র হয়, সৃষ্টির সেরা মানুষ যদি পরশ্রীকাতর হয়, একজন কিছু পেলে আরেকজন যেন হিংসায় বেকারার হয়ে পড়ে। কেনো তুমিও চেষ্টা কর। "লাইসা লিল ইনসানি ইল্লা সা'আ"। তুমি চেষ্টা কর। আল্লাহ তোমাকেও দিবেন ইন শা আল্লাহ। কিন্তু আরেক ভাইয়ের কাছ থেকে কেড়ে নিতে হবে কেন? আমাদের বাচ্চারা সত্য প্রচারে দ্বিতীয় এই কাজটি করছে।
তৃতীয়ত, তারা যেটা করছে-তানজীম ও সংগঠন। আমাদের দেশে মা শা আল্লাহ অনেক সংগঠন আছে। তাদের যখন জন্ম হয়েছে তখন থেকে আর কোন বৈঠক হয় না। আমাদের কি হয়? আমরা পীরপূজকের দেশ। বাংলাদেশ আগে মুর্তিপূজক ছিলো। সেখান থেকে আমরা পীরপূজক হয়েছি। আমরা যখন একজনকে একবার নির্বাচন কওে নেই। নেতা হিসেবে আমৃত্যু তাকেই আমরা মেনে নেই। মানুষ ভুল করতে পারে। মানুষ ত্রুটি করতে পারে। ভুল সংশোধনও করতে পারে। ত্রুটি থেকে মুক্তি পেতে পারে। কিন্তু আমরা যদি একজনের হাতে সম্পূর্ণ ক্ষমতাকে সঁপে দিয়ে আর তাতে পূর্ণ বশ্যতা স্বীকার করি এবং তিনি সর্বপ্রকার ভুল ত্রুটির উর্ধ্বে- এটা মনে করি তাহলে কিন্তু সেটা সত্যিকার সংগঠন হয় না। সংগঠনে অভ্যন্তরীণ গনতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে। সংগঠনের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা করতে হবে। পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। এই যে লক্ষ করলাম- কর্মীরা সভাপতিকে ভাই বলছে, সেক্রেটারিকে ভাই বলছে। পরস্পর পরস্পরকে আসাদ ভাই, মাসউদ ভাই বলছে- এই যে বন্ধন। ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন খলিফা ছিলেন পারস্যের দূত এসে দেখলেন, তিনি মাঠের মধ্যে নিজের উট চড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। কাজ শেষে গাছের তলে হেলান দিয়ে আছেন, এ অবস্থা দেখে রাষ্ট্রদূত অবাক হয়ে গেছে যে, আমাদের বাদশারা কত রকমের বেষ্টনীর মধ্যে থাকে তারপরও তাদের নিরাপত্তা সম্পর্কে তারা নিশ্চিত হতে পারেন না। আর উমর (রা.) সারা মুসলিম জাহানের নেতা হওয়া সত্ত্বেও তুমি এরকম অতি সাধারণ একটা জীবনযাপন করছো। কাজেই আমাদের এখানে তানযীমের খুব বড় প্রয়োজন। এখানে আমাদের মধ্যে শৃঙ্খলার খুব প্রয়োজন আছে। ইমামকে যখন আমরা দাঁড় করিয়ে দিয়েছি, তিনি ইমামতি করছেন, তিনি যখন রুকুতে যাবেন আমাদের সববাইকে রুকুতে যেতে হবে। তিনি যখন রুকু থেকে উঠবেন আমাদের সববাইকে রুকু থেকে উঠতে হবে। এখানে কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি ইমাম আছেন তার ইতা'আত আমাদের করতে হবে। কিন্তু তিনি আমাদের বাধাধরা ইমাম না। আমরা অন্য ইমামও নির্বাচন করতে পারি।
এর পর তারা যে কাজটি করছে তা হচ্ছে ইসলাহুল মুজতামা। এটা যে কত বড় কথা। আপনারা দেখুন, এখানে ক'টা গোল্ড মেডেল পাব, ক'টা পুরস্কার পাব, কে কোন তখতে বসবো, কে কোন কুরসী দখল করবো, কে কিছুদিনের মধ্যে কত ব্যাংক ব্যালেন্স বানাবো, কে কোন জায়গায় ক'টা বাড়ী তৈরি করবো, এগুলো নয়। বাচ্চাদের শেষ কথাটা হচ্ছে তারা সমাজের মধ্যে পরিবর্তন আনতে চায়। সংস্কার আনতে চায়। আমাদের মধ্যে আত্মশুদ্ধিবোধটা তারা জাগ্রত করতে চায়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদেরকে তাওফীক 'আতা করুন। তারা আমাদের ভবিষ্যৎ। তারা জাতির ভবিষ্যৎ। এবং জাতির ভবিষ্যতকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের দেশে সত্যিকার শিক্ষার দরকার আছে। শিক্ষার মাধ্যমে নিরক্ষরতা থেকে মুক্তি- এটা মূল শিক্ষা নয়। যে শিক্ষা আমাকে পরিশীলিত করলো না, যে শিক্ষা আমাকে পবিত্র করলো না, যে শিক্ষা আমাকে আমার প্রভুকে চেনালো না, যে শিক্ষা আমার ছোট ভাইদের স্নেহ করতে শেখালো না, যে শিক্ষা আমার মধ্যে দেশপ্রেমকে জাগ্রত করলো না, যে শিক্ষা আমার মধ্যে দুর্বলের প্রতি স্নেহ এবং সবলের প্রতি একদম শর্তহীন আনুগত্য প্রকাশ করতে বাধ্য করলো না, সেটাতো শিক্ষা নয়। এবং বাস্তবে সে রকমের শিক্ষা তো আমরা এখন পাচ্ছি না।
আমাদের গায়ে অনেক ছিপছাপ পড়ছে। আমরা কি সত্যিকার শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছি? কাজেই আল্লাহ করুন আমাদের বাচ্চারা সত্যিকার শিক্ষায় শিক্ষিত হোক, আমাদের বাচ্চারা কুরআনের আলোতে আলোকিত হোক, আমাদের বাচ্চারা কুরআনের শিক্ষায় শিক্ষিত হোক। যেমনটি মা আয়েশা (রা.) বলেছিলেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, তিনি তো কোন মক্তবে পড়েন নাই? তিনি তো কোন পাঠশালাতেও পড়েন নাই? এবং হযরত জিবরীল (আ.) প্রথম তার কাছে যখন বলেছিলেন, 'ইকুরা'-পড়। তিনি বলেছিলেন, 'মা আনা বি ক্বারী' আমি পড়তে পারি না। তিনি তো উম্মী ছিলেন। অক্ষরজ্ঞান বিমুক্ত ছিলেন। কিন্তু তার চেয়ে দুনিয়াতে কোন শিক্ষিত লোক ছিল? হবে? তা হলে শিক্ষা মানেই কিন্তু এ বি সিডিকখগঘ আর আলিফ বা তা সা নয়। শিক্ষা একটা বড় জিনিস। যেটা মনকে প্রসারিত করে। যেটা সত্যিকারভাবে আমার চোখে আলো দান করে। ঐ যে নূরের কথা বললেন বার বার করে আমরা কিন্তু সেই নূর হারিয়ে বসেছি। এখন অন্ধকারের মধ্যে আমরা যেন হাতড়ে মরছি। আল্লাহ রব্বুল আলামীন এই অপমান থেকে, এই অধঃপতন থেকে রক্ষা করুন। আমাদের বাচ্চারা সত্যিকার শিক্ষায় শিক্ষিত হোক, তাওহীদের দীক্ষায় দীক্ষিত হোক, সুন্নাতের আদর্শে আদর্শবান হোক, বিদ'আত থেকে এবং অন্যায় থেকে দূরে থাকতে তারা শিখুক। এবং ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতে নেতৃত্ব গ্রহণ করার জন্য, ভবিষ্যতে বিজাতীয় মতবাদের মধ্যে সাম্য মৈত্রির একটা ইজম সৃষ্টি করার জন্য, সর্বশেষে এই দেশটাকে একটি কুরআন ও সুন্নার অনুসারী, অন্তত কুরআন ও সুন্নার অনুসারী একটি সমাজ গঠনের জন্য তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকুক।
আমি অনেক সময় নিয়ে ফেলেছি। আপনাদের কাছে মাফ চেয়ে নিচ্ছি। বাচ্চাদেরকে আবারও আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তাদের উজ্জল ভবিষ্যৎ কামনা করছি। তাদের ইহকালীন ও পরকালীন উন্নতি কামনা করছি। এবং আপনাদের সববাইকে আবারও ধন্যবাদ জানিয়ে আমি এখানে শেষ করছি। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।
শ্রুতিলিপি:
মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মোতি
সাবেক সহ-সভাপতি, জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীস বাংলাদেশ
কথ্যরীতি হতে লেখ্যরীতিতে রূপান্তর:
মুহা. আব্দুল্লাহ আল-ফারুক
সাবেক সভাপতি, জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীস বাংলাদেশ
* বক্তব্যটি youtube এ দেখতে সার্চ করুন- Dr. Sir Bari (r)
https://youtu.be/U78i9t9Bh-Q?si=gp8VRPjeIjFn8Eu3
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন। ওয়াসসালাতু ওয়াসসালামু আলা খাইরি খলকিহি মুহাম্মাদিও ওয়ালা আলিহি ওয়া সাহবিহি আজমা‘ঈন। আম্মা বা‘দ। আ‘উযুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির রাজীম। বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম। “সিবগাতাল্লাহ। ওয়া মান আহসানু মিনাল্লাহি সিবগাহ। ওয়া নাহনু লাহু ‘আবিদুন।” ওয়া কালা নাবিয়্যুল আমীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম “তারাকতু ফীকুম আমরাইন। লান তাযিলু মাতামাসসাকতুম বিহিমা কিতাবাল্লাহি ওয়া সুন্নাতি।”
জনাব সভাপতি, মাননীয় বিশিষ্ট অতিথিবৃন্দ, সমবেত ভ্রাতৃমণ্ডলী, স্নেহের শুব্বান ছেলেরা। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমতুল্লাহি ওয়া বারা কাতুহু।
আমি সর্বপ্রথম আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বারগাহে সিজদায়ে শোকর আদায় করছি, যিনি আমাকে অনেক বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও আজকে জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীসের এ কেন্দ্রীয় সম্মেলনে যোগদান করার তাওফীক আতা করেছেন। আমি শারীরিকভাবে সুস্থ নই। মানসিকভাবেও অত্যন্ত বিপর্যস্ত। প্রফেসর ড. আযহার উদ-দীন যেমনটি বললেন, আজকে সকাল ৮.০০টা থেকে দুপুর ১২.০০টা পর্যন্ত আমার বড় জামাতা প্রফেসর ড. এরশাদুল বারীর একটি কিডনী সংযোজন হয়েছে। দিল্লীর এপোলো হাসপাতালে। আল্লাহ রব্বুল আলামীনের মেহেরবানী অপারেশন তো সফল হয়েছে কিন্তু এর পর আল্লাহ রব্বুল আলামীন আরোগ্য দেবেন কি দেবেন না, তার মালিক তিনি।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অশেষ মেহেরবানী আমাদের ভাইরা যে যেখানে ছিলেন, তাদের মধ্যে মুরুব্বীরা ছিলেন, যুবকরা ছিলেন, তরুনরা ছিলেন, তার ছাত্ররা এবং আমাদের ছাত্ররাও দু'আ করেছে হয়তোবা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সবার দু'আর বরকতে মাফ করতে পারেন। আজ জুমার দিন, পবিত্র দিন। সালাতুল জুমার পর যদি আমার জন্য দু'আ করেন আমি আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট কৃতজ্ঞ থাকব। নিশ্চয় আপনাদের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো। আপনারা সবাই ঢাকার বিভিন্ন মসজিদে নামায আদা করে থাকেন। সেখানে যাবার জন্য আপনারা ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। আমি অতি সংক্ষেপে আজকে দু-চারটি কথা আপনাদের সামনে তুলে ধরবো।
প্রথম কথা হলো- আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠানের শেষ নেই। প্রত্যেক দিনই একটা না একটা নূতন নূতন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। সেটা বড়দের মধ্যে যেমন হচ্ছে ছোটদের মধ্যেও তেমন হচ্ছে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলির আদর্শ কি? লক্ষ্য কী? তাদের উদ্দেশ্য কী? তাদের কর্মপদ্ধতি কী? কর্মসূচি কী? আমরা অবহিত হতে পারি না। যদি সেই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলদেরও জিজ্ঞাসা করা হয় আজকে যে প্রতিষ্ঠান দাঁড় করলেন, এ প্রতিষ্ঠান কী উদ্দেশ্যে করলেন? তারা সবাই কিন্তু তার সমুচিত জবাব দিতে পারেন না। তার কারণ এই অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান আমরা দেখছি হয় ব্যক্তিভিত্তিক, অথবা গোষ্ঠীভিত্তিক, অথবা স্বার্থভিত্তিক, অথবা কোন একটা বিশেষ ক্ষণে, একটা বিশেষ মুহুর্তে, বিশেষ একটা উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে গঠন করে থাকেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, এই সংগঠনগুলো খুব একটা নীতি নৈতিকতা মেনে চলে না। এ সমস্ত সংগঠনের নেতা-নেত্রী এবং যারা পরিচালক পরিচালিকা আছেন তারাই নিজেদের মধ্যে বার বার যে ডেমোক্রেসির (Democracy) কথা বলেন তা নিজেরাই অনেকে বোঝেন না। আজকে যেমন আপনারা এর একটা চরম পরিচয় লাভ করলেন। কিছুক্ষণ আগে আমাদের ভাই ওবায়দুল্লাহ গযনফর আমাদের জানালেন, জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীসের নেতৃবৃন্দ নির্বাচিত হয়েছে গোপন ব্যলটে। কেউ এদের মধ্যে কিন্তু প্রার্থী হতে পারনি। কেউ প্রার্থীতা ঘোষণা করতে পারনি। কেউ কারো পক্ষে কোন বক্তব্য রাখতে পারেননি। কর্মীরা, 'মাজলিসে আমে'র ছেলেরা সমবেত হয়ে মনে করেছে যাদেরকে দিয়ে আল্লাহর ফযল ও করমে জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীস-এর উদ্দেশ্য সফলভাবে বাস্তবায়িত হবে, যারা শুব্বানের খেদমত করতে পারবে, যারা জামাত ও জমঈয়তের খেদমত আঞ্জাম দিতে পারবে, তাদেরকে তারা নির্বাচন করেছে।
এখানেই দেখুন, আমরা সারা দুনিয়াসুদ্ধ সবসময় চিৎকার শুনে থাকি- গণতন্ত্র গণতন্ত্র আর গণতন্ত্র। কত রকম গণতন্ত্রের চেহারা আমরা দেখলাম। একটা হোয়াইট হলের গণতন্ত্র দেখলাম। একটা হোয়াইট হাউসের গণতন্ত্র দেখলাম। আমরা এলিসি প্যারিসের গণতন্ত্র দেখলাম, মুগাবে সাহেব আবার আরেক গণতন্ত্র আমাদের দেখাচ্ছেন। গণতন্ত্রের রূপের শেষ নেই। আমরা কিন্তু এ ধরনের নামকা ওয়াস্তে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি না। বরং আমাদের নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ যে কথা বলেছেন, আমরা প্রত্যেকেই মানুষ এবং মানুষ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব বেঁধে দেয়া হয়েছে, "রব্বানা মা খালাকতা হা-যা বাতিলা।"
আজকে যে ছেলেটি সর্বপ্রথম কুরআন মজিদ থেকে তেলাওয়াত করেছে সেখানে এ আয়াতের অংশটুকু আছে। অথচ আমরা মনে করি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের খামাখা এখানে নিয়ে আসলেন। আমরা এখানে স্বার্থপরের মত যার যা উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য পাগলপারা হয়ে একেবারে ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত, হালাল-হারাম, গ্রহণযোগ্য-বর্জনযোগ্য, বিবেচনা না করে আমার মন যা চাইলো একটিা বিশেষ মূহুর্তে আমার প্রবৃত্তি আমাকে পরিচালিত করলো, যে প্রবৃত্তির দাস হয়ে জীবনটাকে শেষ করে ফেললাম। এরকম উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীস বা জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীস গঠিত হয় নাই। জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীসের একটি গঠনতন্ত্র আছে। লিখিত গঠনতন্ত্র দিয়ে তারা তাদের জীবন শুরু করেছে এবং সেখানে তারা প্রথমেই বলছে, তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো- “কালেমা তাইয়্যেবাকে যথাযথ উপলব্ধি করত জীবনের সর্বস্তরে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।”
আজকে আমরা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান যে, আমাদের মাঝে যেসমস্ত বিশেষ অতিথি এসেছিলেন, তারা যেসমস্ত মূল্যবান ভাষণ রেখেছেন তা আমাদের অনেকের জন্য জীবন চলার পথের পাথেয় হয়ে থাকবে। যে কথাটা আমাদের বিদেশী মেহমান বললেন এবং তাঁর মুখ থেকে এ কথাটা আসাতে আমি অন্তত লজ্জিত হয়েছি। আমাদের নিজেদের মধ্যে যদি কেউ বলতেন তাহলে এতটা লজ্জা হতো না। যদিও তিনি বাংলাদেশে অবস্থান করে, বাংলাদেশীদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন কিন্তু এটা শুধু বাংলাদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটা এখন পৃথিবীতে সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বলতে চাচ্ছেন, আজকে আমাদের কী হয়েছে যে আমরা মা-আছির সম্বন্ধে সতর্ক ও সাবধান। এবং সেজন্য আমাদের মধ্যে এলমে নাফে গায়েব হয়ে গেছে। যে জ্ঞান, যে বুদ্ধি, যে বিবেক, যে বিবেচনা থাকলে সত্যকে সত্য বলে আমরা গ্রহণ করতে পারি অসত্য ও মিথ্যা বলে বর্জন করতে পারি। সে বিবেকটুকুও আমি হারিয়ে ফেলেছি। যদি এতে আমার স্বার্থসিদ্ধ হয়, উনি কিন্তু বলেছেন ইমাম শাফেঈ রাহিমাহুল্লাহ এর উদাহরণ দিয়ে, যদি এটা আমার স্বার্থের পরিপোষক হয় তাহলে আমি আলেম হই আর জালেম হই, আমি সমাজের নেতা হই বা সমাজের সাধারণ সদস্য হই, আমি একটা শিক্ষায়তনের প্রধান হই বা একজন শিক্ষার্থী হই, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদ ভাইস চ্যান্সেলর যারা অলংকৃত করেন তারাই হন অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ সর্বনিম্ন ক্লাসের ছাত্র হই, আমরা কেউ কিন্তু আদর্শের প্রতি যত্নবান হচ্ছি না। মেহমান যে কথাটা বললেন, আমরা এখন অত্যন্ত সংকীর্ণভাবে আমাদের দৃষ্টিকে ছোট করতে করতে করতে এমন একটা অবস্থায় পৌঁছে গেছি যখন আমরা জগতটাকে মহাবিশ্বের মধ্যে দেখি না। মহাবিশ্বের সামান্য একটা ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে আমার নিজস্ব পরিমণ্ডলে আমার স্বার্থসিদ্ধির একটা বৃত্তের মধ্যে আমরা এটাকে গুটিয়ে ফেলেছি। এবং সেজন্যই আজকে সমাজে কোন আইন এবং শৃঙ্খলা নেই। সমাজে কোন ন্যায় ও নীতি নেই, সমাজে ভালো ও মন্দের জ্ঞান আমরা হারিয়ে ফেলেছি। বড় ও ছোটর জ্ঞানও আমরা ক্রমে হারিয়ে ফেলছি। এমনকি শিক্ষাঙ্গনগুলোও আমরা আজকে শিক্ষাঙ্গন না করে রণাঙ্গনে পরিণত করেছি। একথাটা মাওলানা মোবারক আলী সাহেব অত্যন্ত সুন্দর ও হৃদয়গ্রাহীভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। তো এই যখন আমাদের দেশের অবস্থা, যখন একটা মোরালিটির ক্রাইসিস (Morality Cricis) চলছে, যখন একটা নীতিনৈতিকতার দুর্ভিক্ষ চলছে, তখন এই দেশে একটা নীতিভিত্তিক, আদর্শভিত্তিক, বিশেষ গুণবিশিষ্ট- যে আদর্শ ও গুণে আমার বাহ্যিক উন্নতির চেয়ে, অগ্রগতির চেয়ে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টি অর্জনটাই বড় সেরকম একটা প্রতিষ্ঠান চালানো চাট্টিখানি সাহসের কথা নয়। যদি এ বাচ্চারা আজকে এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে, তাদের ফেস্টুনে আপনারা লক্ষ্য করলে দেখবেন এখানে কোথায় যেন আছে, তাদের নিজেদের কর্মসূচি ৫টি।
প্রথমটি হলো- একটা ইসলাহুল আক্বীদা বা আক্বীদা সংশোধন করা। তার কারণ আগেতো নিজেকে সংশোধন করতে হবে। ইমাম শাফে'ঈ যেমন বললেন, আমি যে মানুষ, আমি যে আল্লাহর বান্দা, আল্লাহ যে আমাকে সৃষ্টি করেছেন বিশেষ একটা উদ্দেশ্যে এবং সেই উদ্দেশ্য সফল করার জন্য তিনি আমাদের কিছু পথ বাতলিয়ে দিয়েছেন। ছেলেরা বাংলায় আমাদের সামনে যে গযলটি পেশ করলো ওটাতো আসলে সূরা ফাতিহার তাফসীর ছিলো, "ইহদিনাস সিরাতাল মুসতাকিম। সিরা তুল্লাযিনা আন আমতা আলাইহিম।" ইত্যাদি। আমাদের নিজেদের চরিত্রের মধ্যে যদি কোন দোষ থাকে- এই যে আমাদের মেহমান যেমন বললেন, "একটা অন্যায় করলে একটা কালো দাগ পড়ে, আরেকটা করলে আরেকটা দাগ হয়, আরেকটা করলে আরেকটা দাগ হয়, এরপর আমাদের অবস্থা ঐরকম হয়ে যায়, "খাতামাল্লাহু আলা কুলুবিহিম"। আমাদের সব খতম হয়ে যায়। আপনি বাজারের এভেলেবল যত ভালো ডিটারজেন্ট নিয়ে আসেন না কেন, যতই ঘষামাজা করেন না কেন, যতই চেষ্টা করেন না কেন, আমার মন থেকে সে কালিমা আর দূর হয়ে যায় না। আমার মধ্যে যখন একটা ছাপ পড়ে যায়। যে ছাপের কারণে আমি সত্যকে সত্য বলে আর দেখতে পাই না। কাজেই বাচ্চারা নিজেরা সৎ হতে চেষ্টা করছে। নিজেদের আক্বীদা ঠিক করতে চেষ্টা করছে। শির্ক, বিদআত, তাকলীদ, কুফর এবং ইলহাদ সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করছে। এর মানে তারা আল্লাহ রব্বুল আলামীনের সঙ্গে একটা সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য আগ্রহী হয়ে এসেছে।
আজকে তারা প্রায় ১০-১২ জনকে দিয়ে আমাদের বুড়োদেরকে বকিয়ে নিল, এর চেয়ে তাদের একজন যদি নিজেদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি সম্পর্কে আমাদের সামনে তুলে ধরতো তাহলে আমরা অনেকেই লজ্জা পেতাম এবং আমরা আমাদের বাচ্চাদের থেকে অনেক কিছু শিখতাম। সবসময় যে বড়রাই শিক্ষা দেয় আমি এটাতে বিশ্বাস করি না। অনেক সময় ছাত্রদের কাছ থেকেও অনেক কিছু শেখার আছে। আমরা আমাদেও ছোটদের থেকে অনেক কিছু শিখতাম। আমার ছেলেমেয়েদের কাছ থেকেও অনেক কিছু শেখার আছে। আমার বাচ্চা অনেক সময় বলে, আব্বা এটা কি সত্যিকার কাজ হচ্ছে? আমার বাচ্চারা আমাকে বলতে পারবে, ঐ যে আমাদের মেহমান 'হায়া'র কথা বললেন, কিন্তু হায়া তো দুনিয়া থেকে উঠেই গেছে। সেজন্যই তো আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, "আল হায়ায়ু শুবাতুল মিনাল ইমান"- যার হায়া নেই সে বেহায়া, সে বেইমান। কিন্তু আজকে বেইমানতো সবাই হয়ে পড়েছি। আমরা সবাই বেহায়া হয়ে গেছি। আমরা প্রত্যেকেই লেজ কেটে ফেলেছি। এইজন্য লেজওয়ালা কিছু দেখতে আমরা প্রস্তুত নই। আমি যে কথাটা বলেছিলাম, যে বাচ্চারা প্রথমত নিজেদের আক্বীদা ঠিক করতে চাইছে।
তারপর তারা বলেছে, তারা দাওয়াত ও তাবলীগ করবে। তাদের কাছে আমাদের অনুরোধ যে "বাবারা, তোমরা কিন্তু সবসময় মনে রাখবে- ইসলাম দুনিয়াতে অশান্তি নিয়ে আসতে আসেনি। ইসলাম সবসময় দুনিয়াতে শান্তির বাণী নিয়ে এসেছে। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মাধ্যমে আল্লাহ রাববুল আলামীন আরবদের যে শাস্তি ও সমৃদ্ধি দিয়েছেন তা বিশ্ববাসীর কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। অমুসলিম ঐতিহাসিকরা এক বাক্যে স্বীকার করেছেন, কুরআনের ঐ আয়াত "ওয়াযকুরু নি'য়মাতাল্লাহি আলাইকুম ইয কুনতুম আ'দাআন ফাআল্লাফা বাইনা কুলুবিকুম ওয়া আসবাহতুম বিনি'মাতিহি ইখওয়ানা" আল্লাহ পাক তার নবী মুহাম্মদুর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মাধ্যমে ঘৃণিত একটি গোষ্ঠী, যেখানে প্রত্যেকে প্রত্যেকের মৃত্যু কামনা করতো, প্রত্যেকে প্রত্যেকের ধ্বংস কামনা করতো, আপোষে লড়াই করাই তাদের জীবিকা ছিলো, তাদেরকে তিনি সম্প্রীতির ডোরে, একটি স্নেহের ডোরে, একটি মমতার ডোরে, একটি ভ্রাতৃত্বের ভোরে বেঁধে দিলেন। তোমরা কিন্তু মনে রেখো, তোমাদের "উদউ ইলা সাবিলে রাব্বিকা বিল হিকমাতে ওয়াল মাওইযাতিল হাসানাতি ওয়া জাদিলহুম বিল্লাতি হিয়া আহসান।" তোমরা সুন্দরভাবে, আকর্ষণীয়ভাবে, অত্যন্ত সহজ-সরল ভাষায়, লোকের মনকে জয় করে নিয়ে তোমরা দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ আঞ্জাম দিবে।
আজকে সারা বিশ্বের জ্যেঠা হয়ে বসেছেন অনেকেই। আগে বিভিন্ন রকমের সাম্রাজ্যবাদ ছিলো। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ছিলো। ফরাসী সাম্রাজ্যবাদ ছিলো। ডাচ্ সাম্রাজ্যবাদ ছিলো। পর্তুগীজ সাম্রাজ্যবাদ ছিলো। এমনকি কিছুদিনের জন্য জার্মানও সাম্রাজ্যবাদ ছিলো। কত কিসিমের, কত রকমের, কত ফের্কার আমরা সাম্রাজ্যবাদ দেখেছি। এখন মনে হচ্ছে যে একক সাম্রাজ্যবাদ। তারা যা বলবেন সেটাই ঠিক। আর সেটাই সবাইকে মেনে নিতে হবে। এখন নতুন করে তারা বোধহয় হিউম্যন রাইট্ট্স এর ডেফিনেশন Defination) দিবেন। এখন নতুন করে হয়তো তারা ফান্ডামেন্টাল রাইট্স (Fundamental Rights), মানুষ হিসেবে আমাদের যে মৌলিক অধিকার আছে সে সম্পর্কে আমাদেরক অবহিত করতে চেষ্টা করবেন।
“মান কাতালা নাফসান বিগাইরি নাফসিন আও ফাসাদি ফিল আরদি ফাকা আন্নামা কাতালান নাসা জামিয়া। ওয়া মান আহইয়াহা ফা কাআল্লামা আহইয়ান নাসা জামিয়া।” একটি জীবনকে রক্ষা করা সারা মানবতাকে রক্ষা করার সমান বলা হয়েছে। এবং একটি জীবনকে অন্যায়ভাবে হরণ করা সারা বিশ্বের লোককে তাদের জীবন থেকে বঞ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। অথচ আজকে একবিংশ শতকে যারা সবচেয়ে বড় সভ্যতার দাবীদার তারা দেদারচে মানুষ খুন করে চলেছেন। তাদের খুনী বলা চলবে না। আর আমাদের সমাজেও দেখুন না দৈনিক খবরের কাগজে। তখন সর্বপ্রথম কি দেখি? কাউকে খুন করা হয়েছে। কাউকে ধর্ষণ করা হয়েছে। কাউকে জবাই করে মেরে ফেলা হয়েছে। কাউকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলার পর আগুন দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এগুলো সভ্য সমাজের কাজ? এগুলো মনুষ্যত্বের কাজ? তাহলে আল্লাহ রব্বুল আলামীন কেন আমাকে বললেন- যে একটি জীবন রক্ষা করলে তো গোটা মানবতাকে রক্ষা করলে। আর একটি জীবনকে অন্যায়ভাবে যদি কেড়ে নাও তাহলে গোটা মানবতাকে হত্যা করলে।
আমাদের বাচ্চারা আল্লাহর ফযল ও করমে কুরআনের সত্য বাণীগুলো তুলে ধরবেন। তারা এই কথাই বলবেন, “সিবগাতাল্লাহ ওয় মান আহসানু মিনাল্লাহি সিবগাহ।” দেখ, আল্লাহর বান্দ্য হিসেবে আল্লাহ রব্বুল 'আলামীন তোমাকে যে সমস্ত গুণাবলি দিয়েছেন, তোমার মধ্যে যে সকল মানবীয় সম্ভাবনাকে সুপ্ত রেখেছেন, সেগুলোকে পূর্ণ বিকশিত করে, ইনসানে কামেল হয়ে, পরস্পরকে ভালোবেসে, পরস্পরকে “তাওয়াআনু আলাল বিররে ওয়াত তাকওয়া'র মাধ্যমে প্রত্যেকে প্রত্যেককে সাহায্য করে, ন্যায়ের পথে, সত্যের পথে, বৃদ্ধির পথে, মুক্তির পথে, সফলতার পথে চলো আমরা সকলে মিলে এগিয়ে যাই। আমরা হিংসাকে পরিত্যাগ করি। আমরা সন্ত্রাসকে পরিত্যাগ করি। আমরা বিদ্বেষকে পরিত্যাগ করি। আমরা কুৎসা রটনাকে পরিত্যাগ করি। আমরা আমাদের মুরুব্বীদের সম্মান করতে শিখি। আমরা আমাদের ছোটদেরকে ভালোবাসতে শিখি। আমরা লোকের দিকে আমার সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্বের হাত বাড়িয়ে দিই। আমরা পরস্পর পরস্পরকে আলিঙ্গন করে, আমরা মানুষ সবাই যে এক আল্লাহর বান্দা, ওই আদম ও হাওয়ার সন্তান- “ইন্না খালাকনাকুম মিন যাকারিও ওয়া উনসা ওয়া জা'আলনাকুম শু‘যুবাওঁ ওয়া কাবায়িলা লিতা‘ আরাফু ইন্না আকরমাকুম ‘ইনদাল্লাহি আতক্বাকুম।” আমার ব্যাংক ব্যালেন্স দিয়ে, আমার চেহারা দিয়ে, আমার কাপড়-চোপড় দিয়ে, আমার গুলশান বনানীতে কতগুলো বাড়িঘর আছে, কতগুলো ইনডাস্ট্রি আছে? আমি কত জায়গায় বড় বড় বক্তৃতা করতে পারি? এগুলো দিয়ে কিন্তু আমার মর্যাদার পরিমাপ করা হবে না। আমাকে মূল্যায়ন করা হবে না। বরং মূল্যায়ন সেটা দিয়ে হবে আমি কতটা তাকওয়ার অধিকারী। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা যেসমস্ত গুণে গুণান্বিত করে আমাকে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ করে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন সেই সৃষ্টির সেরা মানুষ যদি শেয়ালের চেয়ে ধুর্ত হয়, সৃষ্টির সেরা মানুষ যদি ঐ কাকের চেয়ে প্রতারক হয়, সৃষ্টির সেরা মানুষ যদি বাঘের চেয়ে হিংস্র হয়, সৃষ্টির সেরা মানুষ যদি পরশ্রীকাতর হয়, একজন কিছু পেলে আরেকজন যেন হিংসায় বেকারার হয়ে পড়ে। কেনো তুমিও চেষ্টা কর। "লাইসা লিল ইনসানি ইল্লা সা'আ"। তুমি চেষ্টা কর। আল্লাহ তোমাকেও দিবেন ইন শা আল্লাহ। কিন্তু আরেক ভাইয়ের কাছ থেকে কেড়ে নিতে হবে কেন? আমাদের বাচ্চারা সত্য প্রচারে দ্বিতীয় এই কাজটি করছে।
তৃতীয়ত, তারা যেটা করছে-তানজীম ও সংগঠন। আমাদের দেশে মা শা আল্লাহ অনেক সংগঠন আছে। তাদের যখন জন্ম হয়েছে তখন থেকে আর কোন বৈঠক হয় না। আমাদের কি হয়? আমরা পীরপূজকের দেশ। বাংলাদেশ আগে মুর্তিপূজক ছিলো। সেখান থেকে আমরা পীরপূজক হয়েছি। আমরা যখন একজনকে একবার নির্বাচন কওে নেই। নেতা হিসেবে আমৃত্যু তাকেই আমরা মেনে নেই। মানুষ ভুল করতে পারে। মানুষ ত্রুটি করতে পারে। ভুল সংশোধনও করতে পারে। ত্রুটি থেকে মুক্তি পেতে পারে। কিন্তু আমরা যদি একজনের হাতে সম্পূর্ণ ক্ষমতাকে সঁপে দিয়ে আর তাতে পূর্ণ বশ্যতা স্বীকার করি এবং তিনি সর্বপ্রকার ভুল ত্রুটির উর্ধ্বে- এটা মনে করি তাহলে কিন্তু সেটা সত্যিকার সংগঠন হয় না। সংগঠনে অভ্যন্তরীণ গনতন্ত্রের কথা বলা হয়েছে। সংগঠনের মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চা করতে হবে। পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। এই যে লক্ষ করলাম- কর্মীরা সভাপতিকে ভাই বলছে, সেক্রেটারিকে ভাই বলছে। পরস্পর পরস্পরকে আসাদ ভাই, মাসউদ ভাই বলছে- এই যে বন্ধন। ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু যখন খলিফা ছিলেন পারস্যের দূত এসে দেখলেন, তিনি মাঠের মধ্যে নিজের উট চড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। কাজ শেষে গাছের তলে হেলান দিয়ে আছেন, এ অবস্থা দেখে রাষ্ট্রদূত অবাক হয়ে গেছে যে, আমাদের বাদশারা কত রকমের বেষ্টনীর মধ্যে থাকে তারপরও তাদের নিরাপত্তা সম্পর্কে তারা নিশ্চিত হতে পারেন না। আর উমর (রা.) সারা মুসলিম জাহানের নেতা হওয়া সত্ত্বেও তুমি এরকম অতি সাধারণ একটা জীবনযাপন করছো। কাজেই আমাদের এখানে তানযীমের খুব বড় প্রয়োজন। এখানে আমাদের মধ্যে শৃঙ্খলার খুব প্রয়োজন আছে। ইমামকে যখন আমরা দাঁড় করিয়ে দিয়েছি, তিনি ইমামতি করছেন, তিনি যখন রুকুতে যাবেন আমাদের সববাইকে রুকুতে যেতে হবে। তিনি যখন রুকু থেকে উঠবেন আমাদের সববাইকে রুকু থেকে উঠতে হবে। এখানে কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি ইমাম আছেন তার ইতা'আত আমাদের করতে হবে। কিন্তু তিনি আমাদের বাধাধরা ইমাম না। আমরা অন্য ইমামও নির্বাচন করতে পারি।
এর পর তারা যে কাজটি করছে তা হচ্ছে ইসলাহুল মুজতামা। এটা যে কত বড় কথা। আপনারা দেখুন, এখানে ক'টা গোল্ড মেডেল পাব, ক'টা পুরস্কার পাব, কে কোন তখতে বসবো, কে কোন কুরসী দখল করবো, কে কিছুদিনের মধ্যে কত ব্যাংক ব্যালেন্স বানাবো, কে কোন জায়গায় ক'টা বাড়ী তৈরি করবো, এগুলো নয়। বাচ্চাদের শেষ কথাটা হচ্ছে তারা সমাজের মধ্যে পরিবর্তন আনতে চায়। সংস্কার আনতে চায়। আমাদের মধ্যে আত্মশুদ্ধিবোধটা তারা জাগ্রত করতে চায়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদেরকে তাওফীক 'আতা করুন। তারা আমাদের ভবিষ্যৎ। তারা জাতির ভবিষ্যৎ। এবং জাতির ভবিষ্যতকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমাদের দেশে সত্যিকার শিক্ষার দরকার আছে। শিক্ষার মাধ্যমে নিরক্ষরতা থেকে মুক্তি- এটা মূল শিক্ষা নয়। যে শিক্ষা আমাকে পরিশীলিত করলো না, যে শিক্ষা আমাকে পবিত্র করলো না, যে শিক্ষা আমাকে আমার প্রভুকে চেনালো না, যে শিক্ষা আমার ছোট ভাইদের স্নেহ করতে শেখালো না, যে শিক্ষা আমার মধ্যে দেশপ্রেমকে জাগ্রত করলো না, যে শিক্ষা আমার মধ্যে দুর্বলের প্রতি স্নেহ এবং সবলের প্রতি একদম শর্তহীন আনুগত্য প্রকাশ করতে বাধ্য করলো না, সেটাতো শিক্ষা নয়। এবং বাস্তবে সে রকমের শিক্ষা তো আমরা এখন পাচ্ছি না।
আমাদের গায়ে অনেক ছিপছাপ পড়ছে। আমরা কি সত্যিকার শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছি? কাজেই আল্লাহ করুন আমাদের বাচ্চারা সত্যিকার শিক্ষায় শিক্ষিত হোক, আমাদের বাচ্চারা কুরআনের আলোতে আলোকিত হোক, আমাদের বাচ্চারা কুরআনের শিক্ষায় শিক্ষিত হোক। যেমনটি মা আয়েশা (রা.) বলেছিলেন যে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, তিনি তো কোন মক্তবে পড়েন নাই? তিনি তো কোন পাঠশালাতেও পড়েন নাই? এবং হযরত জিবরীল (আ.) প্রথম তার কাছে যখন বলেছিলেন, 'ইকুরা'-পড়। তিনি বলেছিলেন, 'মা আনা বি ক্বারী' আমি পড়তে পারি না। তিনি তো উম্মী ছিলেন। অক্ষরজ্ঞান বিমুক্ত ছিলেন। কিন্তু তার চেয়ে দুনিয়াতে কোন শিক্ষিত লোক ছিল? হবে? তা হলে শিক্ষা মানেই কিন্তু এ বি সিডিকখগঘ আর আলিফ বা তা সা নয়। শিক্ষা একটা বড় জিনিস। যেটা মনকে প্রসারিত করে। যেটা সত্যিকারভাবে আমার চোখে আলো দান করে। ঐ যে নূরের কথা বললেন বার বার করে আমরা কিন্তু সেই নূর হারিয়ে বসেছি। এখন অন্ধকারের মধ্যে আমরা যেন হাতড়ে মরছি। আল্লাহ রব্বুল আলামীন এই অপমান থেকে, এই অধঃপতন থেকে রক্ষা করুন। আমাদের বাচ্চারা সত্যিকার শিক্ষায় শিক্ষিত হোক, তাওহীদের দীক্ষায় দীক্ষিত হোক, সুন্নাতের আদর্শে আদর্শবান হোক, বিদ'আত থেকে এবং অন্যায় থেকে দূরে থাকতে তারা শিখুক। এবং ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতে নেতৃত্ব গ্রহণ করার জন্য, ভবিষ্যতে বিজাতীয় মতবাদের মধ্যে সাম্য মৈত্রির একটা ইজম সৃষ্টি করার জন্য, সর্বশেষে এই দেশটাকে একটি কুরআন ও সুন্নার অনুসারী, অন্তত কুরআন ও সুন্নার অনুসারী একটি সমাজ গঠনের জন্য তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকুক।
আমি অনেক সময় নিয়ে ফেলেছি। আপনাদের কাছে মাফ চেয়ে নিচ্ছি। বাচ্চাদেরকে আবারও আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তাদের উজ্জল ভবিষ্যৎ কামনা করছি। তাদের ইহকালীন ও পরকালীন উন্নতি কামনা করছি। এবং আপনাদের সববাইকে আবারও ধন্যবাদ জানিয়ে আমি এখানে শেষ করছি। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।
শ্রুতিলিপি:
মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মোতি
সাবেক সহ-সভাপতি, জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীস বাংলাদেশ
কথ্যরীতি হতে লেখ্যরীতিতে রূপান্তর:
মুহা. আব্দুল্লাহ আল-ফারুক
সাবেক সভাপতি, জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীস বাংলাদেশ
* বক্তব্যটি youtube এ দেখতে সার্চ করুন- Dr. Sir Bari (r)
https://youtu.be/U78i9t9Bh-Q?si=gp8VRPjeIjFn8Eu3