brand-image

ইসলামে শিশু প্রতিপালনে প্রায়োগিক কয়েকটি ক্ষেত্র

781685967440.jpg
ইসলামে শিশু প্রতিপালনে প্রায়োগিক কয়েকটি ক্ষেত্র
আদর্শবান, সৎ ও যোগ্য আগামীর প্রজন্ম গড়ার লক্ষ্যে দ্বীন ইসলাম শিশু প্রতিপালনের দিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। কারণ শিশুরাই সমাজের মূল ভিত্তি এবং তাদের ব্যাপারে কিয়ামতের দিন বড়দের জিজ্ঞাসা করা হবে। শিশু লালন-পালনকারীর জন্য রয়েছে অফুরন্ত প্রতিদান আবার সন্তান সৎ হলে তার দু‘আর কারণে মিযানের পাল্লায় অব্যাহতভাবে নেকি বৃদ্ধি হতে থাকে। অতএব প্রত্যেক পিতা-মাতার ও প্রতিপালনকারীর উচিৎ সন্তান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়সমূহে গুরুত্ব দেওয়া।
 শিশুকে সম্মান প্রদর্শন
 শিশুর ইসলামী ব্যক্তিত্ব গঠন
 শিশুর চরিত্র গঠন
 শিশুর প্রতি মায়া ও কোমলতা প্রকাশে গুরুত্ব প্রদান
 শিশুর আক্বীদা-বিশ্বাস গঠন
 শিশুর শিষ্টাচার শিক্ষা প্রদানের উপকরণসমূহ
স্মর্তব্য যে, ইসলাম শিশু প্রতিপালনে এ সমস্ত বিষয় ব্যতীত অন্য অনেক বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে তবে আমরা এখানে সংক্ষিপ্ত আকারে এ আলোচনার মৌলিক বিষয়সমূহ উল্লেখ করব যা বিশুদ্ধরূপে ইসলামে শিশু প্রতিপালন বুঝতে, অনুধাবন ও উপলব্ধি করতে সাহায্য করবে।
১. শিশুকে সম্মান প্রদর্শন :
আল্লাহর নবী (সা.) প্রথমেই একটা সুন্দর ও অর্থবহ নাম নির্ধারণ করার মাধ্যমে শিশুকে সম্মান প্রদর্শন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। কোনো অপরিচিত, দুর্বোধ্য ও মন্দ নাম রাখতে নিষেধ করেছেন।
ইমাম আহমদ বর্ণনা করেছেন রাসূল (সা.) বলেছেন,
تسمَّوا بأسماءِ الأنبياءِ وأحبُّ الأسماءِ إلى اللهِ عبدُ اللهِ وعبدُ الرحمنِ وأصدقُها حارثٌ وهمامٌ وأقبحُها حربٌ ومُرةٌ.
‘তোমরা নবীদের নাম রাখ, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে পছন্দের নাম হল আব্দুল্লাহ ও আব্দুর রহমান। আর নামের মধ্যে সবচেয়ে সত্যবাদী হল হারেছ ও হাম্মাম এবং ঘৃণিত নাম হল হারব ও মুররাহ।’
আবার সম্মানের সহিত সন্তানকে যথোপযুক্ত লালনপালনের জন্য বিয়ের পূর্বে একজন দ্বীনদার সৎ স্ত্রী নির্বাচনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইসলাম বাচ্চাদের অবহেলা ও অপমান করতে নিষেধ করেছে।
শিশুকে সম্মান প্রদর্শনের যথাযথ সম্মান পেয়ে শিশু বড় হলে অন্যদের সম্মান করতে শিখবে।
২. শিশুর ইসলামী ব্যক্তিত্ব গঠন :
৪টি মৌলিক উপাদানের মধ্য দিয়ে শিশুর ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠে। তা হল:
২.১. শরীর: শিশুর শারীরিক গড়ন ও গঠন স্বাভাবিক রাখার প্রতি ইসলাম অপরিসীম গুরুত্ব দিয়ে পূর্ণ দুই বছর তাকে দুধ পান করানোর বিধান রেখেছে। যা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে।
২.২. বিবেক: শিশুর বিবেক বুদ্ধি বিকাশে ইসলাম বুদ্ধিদীপ্ত স্থানগুলোতে বাচ্চাদের বড়দের সংস্পর্শে থাকার বৈধতা দিয়েছে। বাবা তাঁর ছোটো—ছোটো সন্তানদেরকে বিনা সংকোচে মসজিদে নিয়ে যেতে পারবে। এমন অসংখ্য সুযোগ আছে যা শিশুদের বুদ্ধিমান হয়ে বেড়ে উঠতে সহায়তা করে।
২.৩. মন ও মনন: ইসলাম বাচ্চাদের আবেগ-অনুভূতি, মন-মানসিকতা ও মননশীলতার সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণ এবং পরিমার্জন-পরিশোধনের শিক্ষা দিতে পিতামাতাকে নির্দেশ দিয়েছে। হাদীসে রাগ না করতে বলা আছে। বাবা—মা শিশু মনে গেঁথে দিবে বেশি রাগ ভাল না। এভাবে হাদীসে বর্ণিত মনোজগত সংক্রান্ত সব বিষয়ের প্রশিক্ষণ দিবে।
২.৪. আত্মিক : আত্মিক বা আধ্যাত্মিক উন্নয়ন ব্যতীত ইসলামের ইলাহী ইশকের স্বাদ আস্বাদন করা সম্ভব নয়। তাই শিশুর আত্মার পরিচর্যায় বিশেষ এক গুরুত্ব দিতে হবে। শৈশবেই আল্লাহর পরিচয় শিক্ষা দিতে হবে, প্রভুর আনুগত্যের সুফলের সুন্দর ঘটনা তাকে শোনাতে হবে এবং আল্লাহর অবাধ্য হওয়ার কঠিন পরিণামের বাস্তব কিসসা-কাহিনী যা সে অনুধাবন করতে পারবে তা বর্ণনা করতে হবে।
৩. শিশুর চরিত্র গঠন :
উৎকৃষ্ট চরিত্র একদিনে গঠিত হয় না বরং সময়, ধৈর্য, প্রচেষ্টা ও বিশাল সাধনার মাধ্যমে তা রপ্ত হয়। এ জন্য বাচ্চাদের কোমল হৃদয়ে উত্তম চরিত্রের বীজ রোপণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যা পরিণত বয়সে বড় এক মহীরুহে রূপান্তর হয়ে ডাল-পালা মেলবে। উত্তম আদবের সংমিশ্রণে হয় উত্তম চরিত্র। হাদীসে এসেছে,
‘রাসূল বলেছেন,
ما نحل والد ولدا من نحل أفضل من أدب حسن.
‘সন্তানের জন্য বাবার পক্ষ থেকে উত্তম আদব অপেক্ষা বড় কোনো উপহার নেই।’
ইসলামে প্রতিটি কাজেরই নির্দিষ্ট আদব রয়েছে। কথা বলার আদব, ঘুমের আদব, খাবারের আদব, বাড়িতে প্রবেশের আদব ও ঘর থেকে বের হওয়ার আদব ইত্যাদি এসব ছোট বয়সে পিতা-মাতা তার সন্তানকে শিক্ষা দিবে আর এগুলো আয়ত্ত করেই একসময় প্রতিটি শিশুই উত্তম চরিত্রের অধিকারী হবে।
৪. শিশুর প্রতি মায়া ও কোমলতা প্রকাশে গুরুত্ব প্রদান :
হাসান-হুসাইন এর সাথে রাসূল বৎসলতাপূর্ণ আচরণ করতেন তাতে আমাদের জন্য অনেক কিছু শেখার আছে।
অসংখ্য হাদীসে শিশুদের প্রতি রাসূল -এর ভালবাসা, মায়া-মমতা ও তাদের প্রতি তাঁর বিশেষ আকর্ষণের বর্ণনা পাওয়া যায়। উসামা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
انهُ كانَ يَأْخُذُهُ والحَسَنَ ويقولُ: اللَّهُمَّ إنِّي أُحِبُّهُما فأحِبَّهُما.
‘রাসূল আমাকে ও হাসান ইবনে আলী কে ধরে বললেন হে আল্লাহ! আমি এই দু’জনকে ভালোবাসি তুমিও তাদের ভালোবাস।
সহীহ মুসলিমে আনাস থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
ما رَأَيْتُ أَحَدًا كانَ أَرْحَمَ بالعِيَالِ مِن رَسولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عليه وسلَّمَ،
আল্লাহর শপথ পরিবার-পরিজনের প্রতি রাসূল (সা.) এর চেয়ে অধিক দয়াশীল কাউকে দেখিনি।
আরেকটি হাদীসে উমায়র নামক ছোট বাচ্চার চড়ুই পাখির মৃত্যুর পর রাসূল তার অনুভূতির প্রতি কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন তা ফুটে উঠেছে।
এ সমস্ত বিশুদ্ধ হাদীস ও ঘটনা শিশুদের অনুভূতি ও মানসিক অবস্থার প্রতি আমাদের বিশেষ এক গুরুত্ব দেওয়ার শিক্ষা দেয়।
৫. শিশুর আক্বীদা-বিশ্বাস গঠন :
শিশুদের বিশুদ্ধ আক্বীদা-বিশ্বাসের শিক্ষা না দিলে আল্লাহর কাছে পিতা-মাতাকে জবাবদিহি করতে হবে। কারণ আক্বীদার ওপরই নির্ভর করে ব্যক্তির জান্নাত-জাহান্নাম ও ইহকালীন-পরকালীন ক্ষতি এবং সফলতা। শিশুর বিশুদ্ধ আক্বীদাহ গঠনে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে :
৫.১. শৈশবে তাওহীদ শিক্ষা দিবে।
৫.২. শিশুর মনে আল্লাহ, নবী ও সাহাবীদের ভালবাসা গেঁথে দিবে।
৫.৩. বাচ্চাদের দ্বীনি প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করে এমন গল্প শুনাবে।
৫.৪. ছোট আবস্থায় কুরআন মুখস্থ করানোর চেষ্টা করবে।
৫.৫. শিশুদের কুরআনের অর্থ শোনাবে।
৫.৬. সোনামণিদের ইবাদতের প্রশিক্ষণ দেবে।
৫.৭. ছোট সন্তানদের মসজিদে নিয়ে যাবে।
৫.৮. দ্বীনি আলোচনার হালাকায় ছোটদের বসাবে।
ইত্যাদি পদক্ষেপ শিশুদের আক্বীদা-বিশ্বাস বিশুদ্ধ করতে ভূমিকা রাখবে।
৬. শিশু প্রতিপালনের মাধ্যমসমূহ :
কোমলমতি শিশুদের প্রতিপালনে নির্দিষ্ট কিছু পথ-পন্থা ও উপায় অবলম্বন করতে হবে যা কুরআন, হাদীস এবং নবী এর কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি। নিম্নে কয়েকটি উপকরণের বিবরণ দেওয়া হল।
৬.১. উত্তম আদর্শ : শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। অতএব তাদের সম্মুখে উত্তম আদর্শের পরিপন্থী কোনো আচরণ প্রকাশ করা যাবে না। হাদীসে এসেছে, আবু হুরায়রা হতে বর্ণিত, নাবী বলেন,
" من قال لصبي: تعال هاك، ثم لم يعطه فهي كذبة "
‘যে কোনো শিশুকে বলবে, এখানে এসো কিছু দিব তোমাকে, অতঃপর কোনো কিছু দেয় না তাহলে সে মিথ্যাবাদী।’
৬.২. সন্তানদের মাঝে ইনসাফ ও সমতা বজায় রাখা :
একাধিক সন্তান থাকলে পিতা-মাতার ওপর আবশ্যক সবার মাঝে সমতা বিধান করা ও ইনসাফ বজায় রাখা। আল্লাহর নাবী ও এমনটা আদেশ দিয়েছেন।
নু'মান বিন বাশীর থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
عن النعمان بن بشير، أن أباه أتى به إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم فقال: إني نحلت ابني هذا غلاما، فقال: ্রأكل ولدك نحلت مثلهগ্ধ، قال: لا، قال: ্রفارجعه
‘তার পিতা রাসূল (সা.) এর কাছে এসে বলেন, আমি আমার গোলামকে এই ছেলেটিকে দান করেছি তখন রাসূল (সা.) জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি তোমার সব সন্তানদের এমন দান করেছ? আমার পিতা জবাব দিলেন, না। অতঃপর রাসূল বললেন, এই দান তুমি ফিরিয়ে নাও।’
উল্লিখিত হাদীস স্পষ্ট করছে, সন্তানদের মাঝে ইনসাফ ও সমতা বজায় রাখতে হবে।
৬.৩. সন্তানদের জন্য দু‘আ করা : সন্তান প্রতিপালনের মৌলিক উপাদানসমূহের অন্যতম হল সন্তানের মঙ্গলের দু‘আ করা। কারণ সন্তানের জন্য পিতা-মাতার দু‘আ সর্বদা কবুল হয়ে থাকে। নবী বলেন,
لا تدعوا على أنفسكم، ولا تدعوا على أولادكم، ولا تدعوا على خدمكم، ولا تدعوا على أموالكم.
‘তোমরা তোমাদের নিজেদের জন্য, সন্তানদের জন্য, গোলামদের জন্য এবং সহায়সম্পদের জন্য বদদোয়া কর না।’
আল্লাহর রাসূল শিশু ইবনে আব্বাস এর জন্য দু‘আ করেছিলেন "اللهم علمه الكتاب" অর্থাৎ হে আল্লাহে, তাকে কিতাব শিক্ষা দিন।
৬.৪. সন্তানদের বৈধ খেলনাসামগ্রী কিনে দেওয়া :
এটার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হল রাসূল (সা.) তিনি ছোট বয়সে আয়েশা (রা.) কে খেলনা দিয়ে খেলতে দেখেও ধমক না দিয়ে বরং প্রমোদবাক্য বিনিময়ে তাঁর সাথে হাসাহাসি করেছিলেন।
৬.৫. শিশুদের বেশি বেশি তিরস্কার, নিন্দা ও ভর্ৎসনা না করা : রাসূল কখনো তাঁর কোনো খাদেমকে বা কোনো শিশুকে তিরস্কার করতেন না। আনাস রাসূল এর একাধারে ১০ বছর খেদমত করেছেন। তিনি এই ১০ বছরে রাসূল এর আচরণ প্রসঙ্গে বলেন :
خدمت النبي صلى الله عليه وسلم عشر سنين، فما قال لي أف، ولا لم صنعت، ولا ألا صنعت.
‘রাসূল (সা.) আমাকে উফ শব্দটুকু বলেননি এবং কখনো আমার করা কোনো কাজের জন্য আমাকে বলেননি তুমি কেন এমনটি করেছ অথবা তুমি কেন এমনটি করনি?’
উক্ত হাদীস থেকে বড় একটি শিক্ষা হল শিশুর দোষ গোপন করে ভাল আচরণের মাধ্যমে তাকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলা।
ইসলামে শিশু প্রতিপালন বিষয়টি বৃহৎ ও বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে। এ নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে সংক্ষেপে বিষয়টির স্বরূপ উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। প্রবন্ধটি পাঠ শেষে শিশু প্রতিপালনের মৌলিক জ্ঞান অর্জন হবে, ইনশা আল্লাহ।
অতএব, পরিশেষে আহ্বান হল, মুসলিম পিতা-মাতা ইসলামী পরিবেশে শিশুদের সুন্দর ও সঠিক পদ্ধতিতে প্রতিপালনের জন্য এ বিষয় নিয়ে লেখা বিস্তারিত ও গ্রহণযোগ্য বই সংগ্রহ করে নিয়মিত অধ্যয়ন করবে এবং সে অনুযায়ী শিশু প্রতিপালনের সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। আল্লাহ আমাদের প্রচেষ্টাগুলো কবুল করুন।
মাসিক তর্জুমানুল হাদীস
৬ষ্ঠ বর্ষ, ৩য় সংখ্যা
শুব্বান পাতা
লেখা পাঠাতে : 01933-355908

Facebook