brand-image

আলোকিত জীবন

101685350441.jpg

আলোকিত জীবন

প্রফেসর ড. এম এ বারী (রহ) ক্ষণজন্মা শিক্ষা সংস্কারক ও শিক্ষাবিদ

আবূ সা‘দ ড. মো. ওসমান গনী

বিংশ শতকের শিক্ষাজগতে প্রফেসর এম এ বারী একটি সুপরিচিত নাম। শ্রদ্ধা, সম্মান ও সম্মোহনী প্রজ্ঞার অপূর্ব সংমিশ্রণে গড়ে উঠা যেন এক অনন্য প্রতিষ্ঠান। ইসলামী দর্শন ও আধুনিকতার চমৎকার সম্মিলন তাঁর জীবনের অনুপম ভূষণ। সমকালীন যামানার খানদানি পরিবারের যোগ্যতম উত্তরপুরুষ ছিলেন ড. এম এ বারী। ছাত্র ও কর্মজীবনের পরতে পরতে রয়েছে তাঁর অসামান্য নিষ্ঠা ও প্রতিভার দ্যুতি। বহমান ঘুণেধরা ইসলামী সমাজ উন্নয়নের লক্ষ্যে বিজ্ঞানের সাথে ধর্মীয় শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। অনুধাবন করেছিলেন পারলৌকিক কল্যাণ লাভের পর্বতসম বাধা শির্ক ও বিদআতের দুর্লঙ্ঘ্য জঞ্জাল। তাঁর শৈক্ষিক জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে ছিলেন সদাশয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। শিক্ষা বিস্তার আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও নানামুখী শিক্ষা সংস্কারের উপযুক্ত কারিগর হিসেবে তাঁকে বাছাই করা হয়। অত্যল্পকালের মধ্যে সে সকল মিশন সম্পন্নকরণ তাঁর জীবনের অসাধারণ কীর্তি। সাড়ে তিন কোটি তাওহিদী জনতার অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে তিনি আজও অমর হয়ে আছেন।

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১লা সেপ্টেম্বর। পূর্ববঙ্গের তাওহিদী গণমানসের ভাবনার জগতে পূর্ণতা দানে যেন নতুন চন্দ্রের উদয় হয়েছিল। রাজনীতির মতো ধর্মীয় ক্ষেত্রে মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে। মহানবী (সা)এর ইন্তেকালের অব্যবহিত পরে নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের কারণে শিয়া সম্প্রদায়ের বীজ উপ্ত হয়। ক্রমশ আরো বহুভাগে বিভক্ত হয়ে ইসলামের মৌল ভিত্তি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। মাসআলাগত ফয়সালার সূত্র ধরে, তদীয় অনুসারীদের আগ্রহে নতুন নতুন মতবাদ সৃষ্টি হয়। সমাজে হানাফী (৬৯৯-৭৬৭), মালেকী (৭১৩-৭৯৫), শাফেয়ী (৭৬৭-৮১৯) ও হাম্বলী (৭৮০-৮৫৫) প্রভৃতি মাযহাব পরিচিতি লাভ করে। উপরিউক্ত ইমাম চতুষ্টয়ের অনুসরণ অনিবার্য জ্ঞানে স্ব স্ব মাযহাব পন্থীরা নবীর অনুসরণকে প্রকারান্তরে অস্বীকার করতে শুরু করে। আল্লাহ তা‘আলার রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করার পরিবর্তে বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করে। অথচ জাতীয় জীবনকে গ্রথিত, সংহত, সুবিন্যস্ত ও সুসজ্জিত করার স্বর্গীয় রজ্জুর মহিমা প্রসঙ্গে কুরআন মাজীদে উৎকীর্ণ হয়েছেÑ

(وَاعْتَصِمُوْا بِحَبْلِ اللهِ جَمِيْعًا وَلَا تَفَرَّقُوْا)

অর্থ : “তোমরা সম্মিলিতভাবে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করো এবং বিচ্ছিন্ন হইও না।” 

অথচ ভাবতে অবাক লাগে যে, উমাইয়া খিলাফতের (৬৬১-৭৫০) পতনকাল অবধি কোনো মুসলমান নিজেকে হানাফী, মালেকী, শাফেয়ী বা হাম্বলী বলতেন না। এ ধারা ‘আব্বাসীয় খিলাফতের মধ্যভাগ (৭৫০-৮৫৫) পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস ও মহান আল্লাহর অলঙ্ঘনীয় অভিলাষের ফলশ্রম্নতিতে ইসলামের বহুধা বিভক্তি নিশ্চিত হয়ে পড়ে। এ ঢেউ পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের মতো অবিভক্ত বাংলাতেও আছড়ে পড়ে। শির্ক ও বিদআতের মহাপাতকে নিমজ্জিত ইসলামী সমাজ তাওহীদের চেতনাকে হারিয়ে ফেলে। তাকলিদ ও ইত্তেবার রকমফের বাংলার মুসলিম সমাজে অস্পষ্ট হয়ে পড়ে। ফলে অবলীলাক্রমে গড়ে উঠে অসংখ্য পীর ও তাদের মাযার। পীর ও মাযার পূজারিদের মুহুর্মুহু আনাগোনার ফলে দীপ্তিমান তাওহিদী ভাবনার আকাশে দেখা দিয়েছিল বিষণ্ণতার কালো মেঘ। তাঁর জন্মের দশকে খিলাফত আন্দোলন তুঙ্গে। পলাশী (১৭৫৭), বালাকোট (১৮৩১) ও সিপাহি বিদ্রোহের (১৮৫৭) প্রতিটি বাঁকে মুসলমানরা হয় লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত। ওয়াহদানিয়াতের বিশুদ্ধ চর্চা করে টিকে থাকা রীতিমতো কঠিন হয়ে পড়ে। মুসলমানেরা ঐক্যের স্বার্থে জনপ্রিয় খিলাফতের সম্মান ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। তুরস্কের অখণ্ডতা  কীভাবে অক্ষুণ্ণ রাখা যায় সে চিন্তা ও প্রয়াসে বিভোর। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে সেভার্স চুক্তি  মুসলমানদের ভাবনার মূলে বারি সিঞ্চন করে। খিলাফত আন্দোলন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়ে তীব্র আকার ধারণ করে। আন্দোলনের ফলশ্রম্নতিতে বিশ্বের মুসলমানরা যখন উৎফুল্ল-উচ্ছ্বসিত তখনই গান্ধীজী অহিংসার রেশ ধরে আন্দোলন বন্ধ করে দেন। উপরন্তু তুরস্কই এ আন্দোলনের প্রতি চরম আঘাত হানে। কামাল পাশা জাতীয় সংস্কার কর্মসূচি প্রণয়ন করে প্রথমেই সালতানাত উচ্ছেদ করেন। ড. এম. এ বারী’র জন্মের মাত্র ছয় বছর পূর্বে খিলাফত উচ্ছেদ করা হয়। মুসলমানদের মনে ভীষণ আঘাত হানে। দেড় হাজার বছরের লালিত সভ্যতা ও প্রতিষ্ঠান খিলাফত উচ্ছেদ হওয়ায় মুসলমানরা দীনহীন হয়ে পড়ে। ইংরেজদের ‘ভাগ করো ও শাসন করো’ নীতির যাঁতাকলে মুসলমানরা পিষ্ট হয়ে চরম অধঃপতনে নিপতিত হয়। এমনি এক মর্মন্তুদ পরিবেশে মুহতারাম মুহাম্মদ আব্দুল বারী’র জন্ম যেন অমানিশার অন্ধকারে একঝলক চন্দ্রদর্শনের মতো হয়ে উঠে।

বগুড়ার শিবগঞ্জ থানাধীন সৈয়দপুর গ্রামের মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করে শিশু ‘বুলু’ সবারই মাঝে অজানা খুশির হিল্লোল সৃষ্টি করে। বাল্যকাল থেকেই সৌম্যদর্শন আব্দুল বারী ইসলামী পরিবেশে লালিত—পালিত হয়েছেন। বাবা আল্লামা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহিল বাকী ছিলেন উপমহাদেশের খ্যাতিমান ইসলামী চিন্তাবিদ ও রাজনীতিক। খিলাফত আন্দোলন ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তিনি অবিভক্ত ভারতের মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি, কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক পরিষদ ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য ছিলেন। পাকিস্তান গণপরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের বিজ্ঞ ও তুখোড় সদস্য হিসেবে প্রসিদ্ধি অর্জন করেন।

ড. এম এ বারী’র জীবনের প্রস্তুতি পর্বটি ছিল অত্যন্ত আকর্ষণীয়। তিনি তাঁর প্রিয় চাচাজি আল্লামা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহিল কাফী আল কুরায়শীর একান্ত সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। জ্ঞান চর্চার গহিন বারিধিতে অবগাহন করার একান্ত সুযোগ লাভ করেছিলেন তাঁর চাচাজির আগ্রহে। অকৃতদার আল্লামা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহিল কাফী আল কোরাইশী ছিলেন প্রজ্ঞাশীল বাঙালি রাজনীতিক, প্রথিতযশা সাংবাদিক ও প্রতিষ্ঠিত লেখক। ইসলাম ও সংগঠনের নিবিড় সম্পর্কের অপরিহার্যতা উপলব্ধি করে আব্দুল্লাহিল কাফী তাওহিদি জনতাকে সংগঠিত করেন। কুরআন সুন্নাহর আলোকে জমঈয়তে আহলে হাদীস প্রতিষ্ঠা তাঁর অসামান্য কীর্তি। জ্ঞানদীপ্ত ইসলামী রাজনৈতিক পরিবারের যোগ্য উত্তরসূরি মুহাম্মদ আব্দুল বারী তাঁর দীপ্তিমান পরিবার দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হন।

পারিবারিক ঐতিহ্যের আবহে লালিত এম এ বারী বাল্য শিক্ষা তাঁর পিতা ও চাচার নিকট থেকে গ্রহণ করেন। ছোটকাল থেকেই অত্যন্ত মেধাবী আব্দুল বারী পারিবারিক ঐতিহ্যের সাথে সঙ্গতি রেখে নিজ গ্রামের জুনিয়র মাদরাসায় ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। এরপর নওগাঁ কো-অপারেটিভ হাই মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ১৯৪৪ সালে মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে সমগ্র বাংলায় প্রথম শ্রেণিতে একাদশ স্থান অধিকার করে হাই মাদ্রাসা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪৬ সালে যথা পরিসরে ঢাকা ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে কাজী নজরুল ইসলাম কলেজ) হতে ১৯৪৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। মাত্র ১৯ বছর ৪ মাস বয়ঃক্রমকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগ হতে সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বরসহ প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে বি. এ. অনার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫০ সালে একই বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয় হতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন।

আরবি ভাষার ছাত্র হয়ে ইংরেজিতে পারদর্শিতার জন্য তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। অনার্স ও মাস্টার্স পরীক্ষায় অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য তিনি নানা পুরস্কার, সম্মাননা ও বৃত্তি অর্জন করেন। নীলকান্ত গোল্ড মেডেল, বাহরুল উলুম ওবায়দী সোহরাওয়ার্দী গোল্ড মেডেল অন্যতম। বিরল প্রতিভার অধিকারী ড. এম এ বারী’র জ্ঞানার্জনের অতৃপ্ত বাসনা তাঁকে সদা তাড়িত করত। ১৯৫৩ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে তিনি বিশ্ববিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণা করে পিএইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন জগদ্বিখ্যাত প্রাচ্যবিদ প্রফেসর এইচ এ আর গিব ও প্রফেসর জোসেফ শাখ্ত। একটি সূত্রমতে অবগত হওয়া যায় যে, আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়েও তিনি কিছুকাল গবেষণা করেন। জ্ঞান অর্জনের দুর্নিবার কৌতূহলী এম এ বারী ১৯৬১ সালে নাফিল্ড ফাউন্ডেশন ফেলোশিপ লাভ করে পূর্ব লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টোরল রিসার্চ সম্পন্ন করেন।

কর্মজীবনে ড. এম এ বারী ছিলেন একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর সততা ও নিষ্ঠা প্রবাদতুল্য। প্রবাদ প্রতীম মনীষী ড. এম এ বারী অক্সফোর্ড থেকে দেশে ফিরে ১৯৫৪ সালে তৎকালীন পাকিস্তান শিক্ষা সার্ভিসে সরাসরি অধ্যাপক পদে যোগ দেন। উপযুক্ত নিয়োগকর্তার বিচক্ষণতা প্রশংসার দাবি রাখে। কেননা সরাসরি অধ্যাপক পদে কলেজসমূহে যোগদানের ইতিহাস নেই। ইতিহাস সৃষ্টি হলো ড. আব্দুল বারী’র মেধা ও যোগ্যতার যথাযথ মূল্যায়ন করে। কর্তৃপক্ষ অধ্যাপক পদে নিয়োগ দিয়ে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। প্রথমে তিনি ঢাকা কলেজে এবং পরবর্তীতে রাজশাহী কলেজের আরবি বিভাগে অধ্যাপনা করেন। মাত্র দু’বছর পর ১৯৫৬ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে ‘রীডার’ পদে যোগদান করেন। পরবর্তীকালে একই সাথে প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে দীর্ঘকাল দায়িত্ব পালন করেন।

ড. এম এ বারী শুধু সফল শিক্ষকই ছিলেন না, তাঁর উপর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও পরিচালনা পর্ষদের নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন, জিন্নাহ হলের (বর্তমান শের-ই-বাংলা) প্রভোস্ট ছিলেন। সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে তাঁর চৌকস ভূমিকা আজও প্রশংসিত হয়ে আসছে। মাত্র ৪০ বছর বয়সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিযুক্তি উপাচার্য নিয়োগের ইতিহাসে বিরল ঘটনা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্য হতে তিনিই প্রথম ভিসির মর্যাদায় অভিষিক্ত হন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপর্যুপরি দু’মেয়াদ ভিসির দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর অসামান্য প্রজ্ঞা ও প্রশাসনিক দক্ষতার বিষয়ে সরকার প্রধান অবহিত ছিলেন। ১৯৮১ সালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এ পদে দু’মেয়াদে দীর্ঘ আট বছর তিনি অত্যন্ত সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।

সফল শিক্ষা প্রশাসক ও বিদ্যা বিস্তারের বিজ্ঞ ভাবুক হিসেবে তাঁর প্রতি সদাশয় সরকারের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লগ্নে ১৯৮৯ সালে তিনি অনুমোদনকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পের উপদেষ্টা পদে নিয়োগ লাভ করেন। মালয়েশিয়ার অনুকরণে শিক্ষা সুবিধা গ্রাম-বাংলার জনসাধারণের দোরগোড়ায় পেঁৗছানোর জন্য তাঁর একক নেতৃত্বে বিশ্বের উন্নত দেশসমূহের ন্যায় এ দেশে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বিশ্ববিদ্যালয় গড়ন প্রক্রিয়া সম্পন্নের অব্যবহিত পরে ১৯৯২ সালে তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস-চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁর স্বচ্ছতা ছিল প্রশ্নাতীত। বরাদ্দকৃত টাকা ব্যয়িত না হলে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরৎ দিতেন। 

প্রফেসর ড. এম এ বারী তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের সকল ক্ষেত্রে দারুণ সফলতা ও সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। একজন শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে তাঁর তুলনা হয় না। শিক্ষক হিসেবে তিনি অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কৃত হন। ১৯৬৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক “শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক” (চৎরফব ড়ভ চবৎভড়ৎসধহপব) নির্বাচিত হন এবং স্বর্ণপদক লাভ করেন। তিনি পেশাগত ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বহুবিধ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ইতিপূর্বে উল্লিখিত হয়েছে যে, তিনি তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতা ও সফল প্রকল্পক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষের উপদেষ্টার দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য গঠিত দু’টি কমিটিরই চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি অত্যন্ত যোগ্যতা ও দক্ষতার সাথে এ সব দায়িত্ব পালন করেন।

দেশবিদেশে অনুষ্ঠিত অসংখ্য-আন্তর্জাতিক সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ও কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করে দেশ ও দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে জগদ্বাসীর নিকট তুলে ধরেন।  প্রফেসর এম এ বারী’র অবিস্মরণীয় কীর্তি হলো, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় স্কীম কমিটি ১৯৭৭, অন্তর্বর্তীকালীন শিক্ষানীতি ১৯৭৯, মাদ্রাসা শিক্ষা কমিটি ১৯৮৯ ও জাতীয় শিক্ষা সংস্কার কমিটি ২০০২ প্রভৃতি। এ সকল কমিটির দায়িত্ব তিনি দক্ষতার সাথে পালন করেন। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলমানদের অধিকাংশ অর্থকরী কর্মক্ষেত্রে সম্পৃক্ত হলেও ইসলামী ভাবধারায় ও ধর্মীয় আচার—আচরণ অনুশীলনের ক্ষেত্রে প্রায়শ উদাসীনতা পরিলক্ষিত হয়। তাঁর অভিমত, এর কারণ দ্বিবিধ, প্রথমত আধুনিক শিক্ষায় ধর্মীয় শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি না থাকা, দ্বিতীয়ত ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থায় আধুনিক শিক্ষার সংশ্লেষ না থাকা। এ অসঙ্গতি দূরীকরণার্থে মুসলমানদের জন্য আধুনিক ও ধর্মীয় শিক্ষার সমন্বয়ে একটি একক শিক্ষা ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। একদিকে যেমন আধুনিক শিক্ষাকে ইসলামী ভাবধারায় সমৃদ্ধ করতে হবে, তেমনি ইসলামী শিক্ষাকে করতে হবে আধুনিক জীবনের চাহিদার উপযোগী। আর এজন্য ডিগ্রি প্রদানকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। এর মাধ্যমেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষার সমন্বয় সাধন সম্ভব। এ উপলক্ষ্যে ১৯৩৮ হতে ১৯৪৯ সাল অবধি অন্তত তিনটি কমিটি কাজ করেছে।  কিন্তু সুপারিশ প্রণয়ন ছাড়া তেমন কিছুই হয়নি। পরে ১৯৭৬ সালের ১লা ডিসেম্বর বাংলাদেশের তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ঘোষণাক্রমে ১৯৭৭ সালের জানুয়ারিতে কমিটি গঠিত হয়। সাত সদস্য বিশিষ্ট কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ড. এম এ বারী।

প্রায় চল্লিশ বছরের ব্যবধানে বন্ধুর পথ মাড়িয়ে পরিগৃহীত সুপারিশমালার আলোকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়িত হয়। ইসলাম বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জনসহ মানবিক ও বিজ্ঞান বিভাগের আধুনিক জ্ঞানার্জনের নিমিত্তে প্রয়োজনীয় বিষয়াদির সমন্বয় সাধন করে গ্রাজুয়েট তৈরি করার সুপারিশমালা প্রণীত হয়। একাধিক অনুষদ ছাড়া কতিপয় ইনস্টিটিউট সম্পর্কে পরিগৃহীত সুপারিশমালা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য বহন করে। ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল রিসার্চ এবং ‘আব্বাসীয় ও স্পেনীয় উমাইয়া আমলের বায়তুল হিকমা ও কর্ডোভার দারুল হিকমার আদলে ব্যুরো অব ট্রান্সলেশন ও মধ্যপ্রাচ্য শিক্ষা ইনস্টিটিউট অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ড. আল্লামা আব্দুল বারীর মেধা প্রাখর্যের ফলস্বরূপ অতীত গৌরবোজ্জ্বল ধারাকে অনুসরণ করে ইসলামী তাহজীব তমদ্দুন সমুন্নত রাখার জন্য এ সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়। কমিটির সুপারিশে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে একটি ল্যাবরেটরি স্কুল কাম মাদ্রাসা স্থাপন করার কথা উল্লেখ করা হয়। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ব-প্রস্তুতিমূলক পর্যায়ে পাঠদান করা হবে। মাত্র সাত মাসের রিপোর্টে অভিভূত তদানীন্তন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মূল্যায়ন ছিল, “আজকের নীতিজ্ঞান ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের সময় ইসলামের নীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে জ্ঞান আদান—প্রদানের ও নবদিগন্তে ছায়া বিনিময়ের সেতুবন্ধনের কাজ করবে। যুগোপযোগী এ সুপারিশমালা অতিদ্রুত বাস্তবায়িত হবে।”

প্রফেসর ড. আল্লামা মুহাম্মদ আব্দুল বারী অন্তবর্তীকালীন শিক্ষানীতি ১৯৭৯ প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ওই সময় নানা কারণে দেশে সুস্পষ্ট শিক্ষানীতি না থাকার ফলে শিক্ষা ব্যবস্থায় ক্রমশ অবনতি ঘটতে থাকে। ফলে ক্রমাগত শিক্ষার মান কমতে থাকে। এ সমস্যা দূরীকরণের লক্ষ্যে গঠিত হয় শিক্ষা উপদেষ্টা পরিষদ। ড. এম এ বারী উপদেষ্টা কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। সুপারিশমালায় প্রাথমিক, মাধ্যমিক, মাদ্রাসা, বৃত্তিমূলক, কারিগরি, শিল্পভিত্তিক, কৃষিভিত্তিক, ব্যবসায় ও বাণিজ্যিকভিত্তিক, ললিতকলাভিত্তিক, চিকিৎসাভিত্তিক শিক্ষা ও শিক্ষণের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়।

ড. এম এ বারী’র অবিস্মরণীয় কীর্তি হলো মাদ্রাসা শিক্ষা কমিটির সুপারিশ প্রণয়ন। ইবতেদায়ি, দাখিল, আলিম, ফাযিল ও কামিল স্তরের বিষয়সমূহকে ঢেলে সাজানো হয়। মান ও মূল্যায়ন পদ্ধতির চমৎকারিত্ব সুপারিশমালার উল্লেখযোগ্য দিক। কমিটির সুপারিশমালার অন্যতম দিক ছিল শিক্ষক প্রশিক্ষণ। দীর্ঘ মেয়াদী মৌলিক প্রশিক্ষণ ও সজ্জীবনী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের কর্মউদ্যোগকে শানিত করার অভিনব পদ্ধতি পরিগৃহীত হয়। কমিটি মাদ্রাসা কামিল উত্তীর্ণ যোগ্য শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা যথা এমফিল, এম এস ও পি এইচ ডিসহ মৌলিক গবেষণার সুযোগ সৃষ্টির সুপারিশ করেন। তাঁর সুপারিশমালায় মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিক শিক্ষার সাথে সমন্বয়ের প্রয়াস ছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে সুপারিশসমূহ আজও অনুমোদন লাভ করেনি।

২০০২ সালে ড. এম এ বারী’র নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষা সংস্কার কমিটি গঠিত হয়। যে জাতি শিক্ষায় যত উন্নত সে জাতি সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং তাহযীব—তমুদ্দুনের দিক দিয়েও ততোধিক উৎকর্ষতা অর্জন করেছে। এ নীতির আলোকে গঠিত কমিটি কাজ শুরু করে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে তিনি সুপারিশমালা পেশ করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেগুলোর বাস্তবায়ন আজও হয়ে উঠেনি। মোটা দাগে নিদেনপক্ষে ৪টি শিক্ষা সংস্কার বিষয়ক কমিটির দায়িত্ব লাভ একটি ব্যক্তির জীবনে দুর্লভ সম্মান বলা যায়। তিনি সকল কমিটির রিপোর্ট যথাসময়ে উপস্থাপন করে সমকালীন পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ ও সরকারের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী এমনকি রাষ্ট্রপ্রধানও তাঁর বিষয়ে সম্যক্ অবগত ছিলেন।

প্রফেসর ড. আল্লামা মোহাম্মদ আব্দুল বারী তাঁর শিক্ষা সংস্কার কমিটির সুপারিশমালায় ভ্রান্ত পাশ্চাত্য শিক্ষানীতির নেতিবাচক দিকের আলোকে ইসলামী শিক্ষাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তাঁর অভিমত ছিল : “যে শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীর মনে পরস্পরের প্রতি দয়া-মায়া উদ্রেক করে না, ভালোবাসার বিকাশ ঘটায় না, দারিদ্র্য জর্জরিত, অভাবগ্রস্ত, উপেক্ষিত ও অবহেলিতদের প্রতি সহানুভূতি জাগ্রত করে না এবং তাদের সারিতে দাঁড়িয়ে তাদের কল্যাণ কর্মে উদ্বুদ্ধ করে না, যে শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যক্তি স্বার্থের উপর সমাজ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থকে দেখার প্রেরণা দেয় না, আর যাই হোক, সে শিক্ষা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।”

ড. আল্লামা আব্দুল বারী অনুধাবন করেছিলেন, প্রত্যেক জাতির নিজস্ব ও স্বতন্ত্র জীবন ধারা ও রীতিনীতি আছে। আর আছে তাদের নিজস্ব শিক্ষাধারা। আমরা বাঙালি মুসলমান হিসেবে আমাদের ধর্মীয় ভাবধারা শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রতিফলন হওয়া দরকার। কিন্তু ম্যাকলের ভাবনা দ্বারা পুষ্ট যে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রয়োগ করা হয়েছিল তাতে ভারতীয়রা নিজস্ব সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে বেমালুম ভুলে যাবে; চিরতরে মুছে যাবে। ম্যাকলের লেখা একটি চিঠিতে সে বিষয়ে সম্যক্ অবগত হওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, It is my firm belief that if our plan’s of education are followed up. There will not be a single idolator among the respected classes in Bengal thirty years since, And this will be effected without any efforts to proselytes.

অর্থাৎ-আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বাঙালিরা ইংরেজি শিক্ষা পেয়ে স্বাভাবিকভাবেই খৃষ্ট ধর্মভাবাপন্ন হয়ে উঠবে, ধর্ম প্রচারের প্রয়োজনই হবে না। পরবর্তী ৩০ বছরের মধ্যে এ দেশে একজনও মূর্তিপূজক থাকবে না।

ম্যাকলের ভাবনার প্রতিফলন কিন্তু মুসলমানদের জন্যও প্রযোজ্য ছিল এ বিষয়ে ড. এম এ বারী বিলক্ষণ অনুধাবন করেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন যে, ব্রিটিশদের “ভাগ করো শাসন করো” (উরারফব ধহফ জঁষব) নীতি আশ্চর্যজনক ও সার্থকভাবে শিক্ষা ব্যবস্থাকে সেকিউলার ও ধর্মভিত্তিক দু’ভাগেই বিভক্ত করেনি; বরং বাংলা ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থাকে খণ্ড বিখণ্ড করে ছেড়েছে। ওল্ড স্কীম, নিউ স্কীম, খারেযী ও ভারতের উত্তর প্রদেশে গড়ে উঠেছে বিপরীতমুখী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আলীগড়ের ‘এ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ’, ‘দারুল উলুম দেওবন্দ’ ‘নাদওয়াতুল উলুম’, লক্ষেèৗ এবং দিল্লির জামেয়া মিল্লিয়া’। ব্রিটিশের এ শিক্ষানীতি ভারতের মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক সুদূরপ্রসারী ও সুপরিকল্পিত মহাচক্রান্ত।

অধুনা ইসলামী চিন্তাবিদগণ মুসলিম জাহানে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচুর গরমিল লক্ষ্য করেছেন। একেক দেশে চালু রয়েছে একেক ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা। বস্তুতঃ সমগ্র মুসলিম বিশ্বে এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হওয়া দরকার যার ভিতরে থাকবে ইসলামী আদর্শানুগ একটি মৌলিক ঐক্য। শিক্ষার্থীরা নিউটন, গ্যালিলিও, রুশো, ভলতেয়ার, গ্যারিবল্ডি প্রভৃতি পাশ্চাত্যের অনেক বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, কবি, সাহিত্যিকদের যেমন জানবে তেমনি জানবে নবী, রাসূল, খলিফা, বড়ো বড়ো মনীষী, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক ও সমাজ সংস্কারকদের কথা। ড. এম এ বারী তাঁর অভিভাষণে কুরআন মাজীদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন,

وَالشَّمْسُ تَجْرِيْ لِمُسْتَقَرٍّ لَهَا ذٰلِكَ تَقْدِيْرُ الْعَزِيْزِ الْعَلِيْمِ ۝ وَالْقَمَرَ قَدَّرْنَاهُ مَنَازِلَ حَتّٰى عَادَ كَالْعُرْجُوْنِ الْقَدِيْمِ ۝ لَا الشَّمْسُ يَنْبَغِيْ لَهَا أَنْ تُدْرِكَ الْقَمَرَ وَلَا اللَّيْلُ سَابِقُ النَّهَارِ وَكُلٌّ فِيْ فَلَكٍ يَسْبَحُوْنَ

“সূর্য আবর্তন করে তার নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে, এটা প্রবল পরাক্রান্ত সর্বজ্ঞ আল্লাহ কর্তৃক সুনির্দিষ্ট। আর আমি চন্দ্রের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছি বিভিন্ন মনযিল, অবশেষে তা শুষ্ক বাঁকা খর্জুর শাখার আকার ধারণ করে। সূর্য নাগাল পায় না চন্দ্রের, রজনী অতিক্রম করে না দিবসকে এবং প্রত্যেকে সন্তরণ করে নিজ নিজ কক্ষপথে।” 

এ সব তো বিজ্ঞানীদের খোরাক, আবিষ্কারের সূত্র, কবি—সাহিত্যিকদের ভাবনার উৎস ও দার্শনিকদের চেতনা সৃষ্টির ক্ষেত্র। প্রফেসর ড. আল্লামা মুহাম্মদ আব্দুল বারী’র সুপারিশমালার প্রতিপাদ্য কথা ছিল, প্রযুক্তি ও প্রকৌশলবিদ্যার অগ্রগতিকে অস্বীকার করা যাবে না। এ অগ্রগতির প্রেক্ষিতে মাদ্রাসা শিক্ষায় পরিবর্তন আনতে হবে। কিন্তু বর্তমানকেও গুরুত্ব দিতে হবে বলেই অতীতকে অস্বীকার করা যাবে না। পার্থিব উন্নতির জন্য চেষ্টা করতে হবে বলেই পারলৌকিক ভাবনা বাদ দেয়া যায় না। তাঁর ভাবনায় প্রতিফলিত হয়েছে যে, দেশে প্রচলিত দু’রকম শিক্ষা পদ্ধতি বাদ দিয়ে এমন এক জাতীয় শিক্ষা পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটাতে হবে, যাতে করে উভয় দিকের সমন্বয় সাধিত হবেÑ শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে পার্থিব এবং পারলৌকিক উভয় লোকের কল্যাণ লাভের পথনির্দেশ মিলবে। মানবকুলের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির কথা পবিত্র কুরআন মজীদে বিঘোষিত হয়েছে

رَبَّنَا آتِنَا فِيْ الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِيْ الْآخِرَةِ حَسَنَةً

“প্রভু হে! আমাদের কল্যাণ দাও এ দুনিয়ায় আর কল্যাণ দাও পারলৌকিক জীবনেও।” 

পবিত্র কুরআনের শাশ্বত বাণী মানবজাতির অতি প্রয়োজনীয় শাস্ত্র কৃষিবিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্রের উৎপত্তি ও বিকাশে দারুণ দিক নির্দেশনা উপহার দিয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং বলেছেনÑ

سُبْحَانَ الَّذِيْ خَلَقَ الْأَزْوَاجَ كُلَّهَا مِمَّا تُنْبِتُ الْأَرْضُ وَمِنْ أَنْفُسِهِمْ وَمِمَّا لَا يَعْلَمُوْنَ

“পবিত্র ও মহান তিনি, যিনি প্রত্যেক বস্তুকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন; মাটিতে যা উৎপন্ন হয় (উদ্ভিদ), তাদের নিজেদের (মনুষ্য জাতির) মধ্য হতে এবং যে বস্তুর খবর তারা (মানুষ) রাখে না (সবই তিনি জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন)।”  তাহলে বিজ্ঞান ও ইসলামকে তো পৃথক করার সুযোগ নেই। তাঁর অভিমত এমন এক শিক্ষা পদ্ধতি থাকবে যার গবেষণা ও অধিকার মানুষের পারলৌকিক ভাবনাকে যৌক্তিক করবে এবং ইহকালীন অর্জনকে নিশ্চিত করবে। ড. আব্দুল বারী স্যারের শিক্ষা সংস্কারের পরতে পরতে উপরিউক্ত বিষয়সমূহ প্রতিফলিত হয়েছে।

কৃতবিদ্য পণ্ডিত ড. আব্দুল বারী স্যারের পাণ্ডিত্যের পরিসীমা নির্ণয় করা সুকঠিন। তাঁর প্রতি দেশজোড়া পণ্ডিতদের মান্যতা অবাক করার মতো। তিনি শতব্যস্ততার মাঝে ইসলামী বিশ্বকোষ ও শিশু বিশ্বকোষ প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান পদে বরিত হয়েছিলেন। একটি অনন্য জীবন ব্যবস্থা হিসেবে ইসলাম বিশ্বকে উপহার দিয়েছে একটি দর্শন, একটি সংস্কৃতি, একটি সভ্যতা, একটি প্রশাসনিক কাঠামো, একটি নৈতিক মানদণ্ড, তাওহীদভিত্তিক বৈচিত্র্যময় ইতিহাস সমৃদ্ধ একটি উম্মাহ্। সভ্যতার ইতিহাসে ইসলামের অবদান কালজয়ী। এর প্রতিটি বিষয় বৈশিষ্ট্যসমৃদ্ধ। ইতিহাসের প্রথম মানুষই ইসলামের বিবেচনায় প্রথম মানুষ ও নবী। এ নিরিখে ইসলামের ইতিহাস সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব মুখরিত মানব ইতিহাসের সমার্থক। এমনিতরো শত-সহস্র জটিল বিষয়াদি অনুলেখন, সম্পাদন নিঃসন্দেহে দুরূহ কাজ। ড. এম এ বারী অংশত হলেও সে কাজ আঞ্জাম দিয়ে জ্ঞান চর্চার জগতে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। পণ্ডিত-গবেষকদের চিন্তা ও আবিষ্কারের নানা ভুক্তি শিশুতোষ আকারে উপস্থাপনার পারঙ্গমতা তাঁর আর এক অনন্য কীর্তি। তিনি সফলতার সাথে শিশু বিশ্বকোষ বিরচনে বিজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন। সমকালীন যামানার পণ্ডিতদের মাঝে তাঁর ভাষার ব্যঞ্জনা ও শব্দের গাঁথুনি অসাধারণ। রচনার ক্ষেত্রে লয় ও লহরির সৃষ্টি তাঁর মেধা প্রাখর্যের পরিচয় বহন করে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ড. এম এ বারী সমধিক পরিচিত। একজন ধীমান পণ্ডিত, বহু ভাষাবিদ ও দক্ষ সংগঠক হিসেবে তাঁর তুলনা মেলা ভার। ইতিপূর্বে উল্লিখিত হয়েছে যে, মাত্র ২৩ বছর বয়সে এম এ বারী বিশ্বখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব ফিলোসফি (ডি. ফিল) ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ‘ঊনিশ শতকের বাংলার মুসলিম সংস্কার আন্দোলন’। তাঁর জন্মের আগের শতকের ম্রিয়মান মুসলিম জাতিকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে যে সংস্কার হয়েছিল সে বিষয়টিতে গবেষণা করতে তাঁর আগ্রহ সৃষ্টি হয়। ঐ সংস্কারের যৌক্তিকতা, যথার্থতা ও কুরআন সুন্নাহর আলোকে তা কতটা সম্পাদিত হয়েছিল বৈজ্ঞানিক ভাণ্ডারে যাচাই বাছাইয়ের তাগিদ থেকে সম্ভবত ড. এম এ বারী গবেষণা করেন। ইতিপূর্বে উল্লিখিত হয়েছে যে, তাঁর গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন জগদ্বিখ্যাত প্রাচ্যবিদ প্রফেসর এইচ এ আর গিব ও প্রফেসর যোশেফ শাখ্ত। ধানমন্ডির বাসা পরিবর্তনের সময় মুহতারাম স্যার প্রাবন্ধিককে ড. এইচ আর গিব হস্তলিখিত চিঠিগুলো দেখিয়ে ছিলেন। আমি হতবাক হয়ে ছাত্রকে ইংরেজ পণ্ডিতের স্বহস্তে লিখিত সৌন্দর্যময় লেখা প্রত্যক্ষ করেছি। ছাত্র হিসেবে ড. এম এ বারী তাঁর নিকট কতই না আদরের ছিলেন! সাত সমুদ্র তের নদী পারের সে চিঠি তার প্রমাণ বহন করে।

পাশ্চাত্যের বহু পণ্ডিতের সাথে তাঁর সখ্য ছিল। ছিল যোগাযোগ। অত্যন্ত বিনয়ের সাথে আলোচনা করতেন। সঠিক না হলে, যুক্তির নিরিখে প্রত্যাখ্যান করতেন। অসত্য তথ্য ও ইসলামের বিরুদ্ধে অযৌক্তিক কোনো কথা বা অভিমত বরদাশত করতেন না। তিনি পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের ইসলামিক ভাবনা ও মুসলমানদের অধঃপতন সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণার অপনোদন করেন। পাশ্চাত্য পণ্ডিতরা ধারণা পোষণ করতেন যে, ‘ইসলাম জোরজবরদস্তিতে বিশ্বাসী’ এবং মানুষের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না। মানুষের কর্মে নয়; ভাগ্য ও নিয়তিতে বিশ্বাসী এবং জ্ঞান বিজ্ঞান বিরোধী। তারা আরও মনে করে, এ সকল বিশ্বাস ও মতবাদের কারণে মুসলমানরা জ্ঞান—বিজ্ঞান থেকে পশ্চাৎপদ। ফলে আধুনিক বিশ্বে মুসলিমরা একটি অধঃপতিত জাতিতে পরিণত হয়।’ পাশ্চাত্য মনীষীদের উপরিউক্ত অভিমত ক্ষুরধার জ্ঞানের অধিকারী ড. এম এ বারী’র দৃষ্টি আকৃষ্ট করে। আমরা তাঁর জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতামালা, আলাপচারিতা ও লেখনীতে সে সকল ভ্রান্ত ধারণা খণ্ডনের প্রয়াস দেখতে পাই। ড. এম এ বারী ইসলামের সাথে পাশ্চাত্য ভাবধারা তাওহীদুর রুবুবিয়াতের আলোকে ব্যাখ্যা দাঁড় করেন। তিনি ইসলামের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা পেশ করে উদ্ধৃত করেন যে,

Islam is not merely a religion, It is a total and unified way of both religious and secular; It is a set of beliefs and form of worship; It is a vast integrated system of law; It is a culture and civilization; It is an economic system and a way of doing business; It is a polity and a method of governance: It is a particular sort of society and a way of running a family; It’s prescribed for inheritance and divorce, this-worldly and otherworldly.

সমাজ, দেশ ও বিশ্ব সমস্যার সমাধানে শাশ্বত ইসলামের যুগপোযোগী ব্যবহারের বিশদ বিবরণ ড. এম এ বারী’র বক্তব্যে লক্ষ্য করা যায়। মানব জাতির সঠিক কল্যাণ ও মুক্তির জন্য ব্যবহারিক জীবন ব্যবস্থা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার অনুপম উপহার। সব যুগের, সব বর্ণের ও সকল ভাষাভাষী মানুষের জন্য তা মুক্তি, শান্তি ও সমৃদ্ধির সম্পদস্বরূপ।

পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের চাপিয়ে দেয়া ‘জোর-জবরদস্তির’ তক্মা প্রত্যাখ্যান করে সমান অধিকার নিয়ে বসবাসের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তাঁর লেখনী ও বক্তৃতাসূত্রে অবগত হওয়া যায়। “উনসুর আখাকা যালিমান আও মাযলুমান” হাদীস উদ্ধৃতি করে সম্প্রীতির মজবুত বন্ধনের বিষয়ে খ্রিষ্টান জগতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। মুসলিম জাতির প্রতি খ্রিষ্টান বিশ্বের ভ্রান্ত ধারণা অপনোদন পূর্বক ড. এম এ বারী অবহেলিত মুসলিমদের স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করে মহান অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন। মুসলমানদের প্রতি পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের নেতিবাচক চিন্তাধারার বিষয়ে তার বক্তৃতায় বিশ্বের মুসলমানদের সতর্ক করেন। জ্ঞানের দীপ্ত মশাল ড. এম এ বারী সাংগঠনিক ও ধর্মীয় প্রচারপ্রসারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা প্রশাসক হিসেবে ড. এম এ বারী দারুণ ব্যস্ত থাকতেন। লিখবার প্রচণ্ড আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও সময়াভাবে লেখা হয়ে উঠতো না। তবে তাঁর সুলিখিত কয়েকটি বইয়ের মধ্যে ‘ধর্ম বিজ্ঞান ও প্রগতি’ এবং ‘তাবলীগে দ্বীন ও আহলে হাদীস আন্দোলন’ উল্লেখযোগ্য। তাঁর গবেষণাধর্মী লিখনশৈলী তথ্যের বিশ্বস্ততা সম্পর্কে দেশ—বিদেশের পণ্ডিতবর্গ অবগত ছিলেন। স্যারকে ওর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স (ও আই সি), মহাসচিব বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা বই লিখবার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। আলাপচারিতায় স্যার বিষয়টি আমার কাছেও উত্থাপন করেছিলেন। কিন্তু সময়াভাবের কারণে সেটি সম্ভব হবে কিনা সে ব্যাপারে শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। বাস্তবে তাই—ই হয়েছিল।

একজন গবেষক ও শিক্ষা প্রশাসক হিসেবে পরিচিতির পাশাপাশি ইসলামী ধর্মবেত্তা হিসেবে সমধিক খ্যাতি লাভ করেছিলেন। ইংলান্ডসহ আফ্রিকা মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় তাঁর যথেষ্ট যশ ও খ্যাতি ছিল। সাউদি রাষ্ট্রদূত শাইখ ফুয়াদ আব্দুল হামিদ আল খতীব, হারামাইন শরীফাইনের খতীব শাইখ ‘আব্দুল্লাহ আস সুবাইল, বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ড. ‘আব্দুল্লাহ আব্দুল মুহাসিন আত্ তুর্কী, ড. রাবি বিন হাদী উমায়ের আল মাদখালী, শাইখ ‘আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল আজীজ আল বাকরী, ড. শাইখ আহমাদ আব্দুল লতীফ, শাইখ হামুদ মুহাম্মদ আশ শিমরীমি, শাইখ আব্দুর রহমান আল মুহাইযান, শাইখ মাহমুদ মুহাম্মদ বা-হাযেক, শাইখ ‘আব্দুল্লাহ ওসমান আল হুসাইনী, সুদানের শাইখ মুহাম্মদ আবূ যায়েদ মোস্তফা, কুয়েতের সামী আন নাসের, শাইখ খলীল হাবস, সিরিয়ার শাইখ আ. বাকী মুহাম্মদ আশ শুবাইকী, ভারতের শাইখ আব্দুল হামিদ আব্দুল জব্বার রহমানী, শাইখ মুখতার আহমাদ নাদভী, শাইখ আব্দুল হামীদ রহমানী শাইখ আতাউর রহমান আল মাদানী, শাইখ আব্দুর রহমান আল মাজহারী, শাইখ আব্দুল ওয়াহাব আব্দুল ওয়াজেদ খিলজী, নেপালের আমীর শাইখ শামীম আহমাদ খান নদভী, শাইখ আব্দুর রউফ ঝাণ্ডানগরী, পশ্চিমবঙ্গের শাইখ হাফেজ আইনুল বারী আলীয়াভী, পাকিস্তানের আল্লামা ইহসান ইলাহী যহীর, প্রফেসর সাজেদ মীর, প্রমুখ ব্যক্তিত্যের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও যোগাযোগ ছিল।

তিনি আহলে হাদীস অনুসারীদের প্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীসের দীর্ঘ দিনের সভাপতি ছিলেন। সংগঠনটি পরিচালনায় তাঁর সাংগঠনিক যোগ্যতা ও ধর্মীয় জ্ঞানের গভীরতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করছে। বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীসের প্রাণপুরুষ ও প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহিল কাফী আল কোরায়শীর ইনতেকালের অল্প কিছুদিন পরে  ১৯৬০ সাল থেকে আমৃত্যু সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতি’র দায়িত্ব অতীব নিষ্ঠা ও প্রজ্ঞার সাথে পালন করে এ দেশে কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর আলোকে ইসলামী দাওয়াতের প্রসারে ভূমিকা রাখেন। প্রফেসর ড. এম এ বারী তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা, বিরল ব্যক্তিত্ব, অসাধারণ পাণ্ডিত্য ও ত্যাগ—তিতিক্ষার মাধ্যমে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া এবং সুন্দরবন থেকে জয়েন্তিয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীসের ৩৫টি সাংগঠনিক জেলা, সাড়ে পাঁচশত এলাকা এবং ছয় সহ¯্রাধিক শাখা জমঈয়ত গঠনের মাধ্যমে বৃন্তচ্যুত আহলে হাদীস জামা‘আতকে ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত করেছেন। তিনি জমঈয়তের অবিসংবাদিত নেতা ও কাণ্ডারী হিসেবে পাঁচটি সফল ও স্বার্থক জাতীয় কনফারেন্স অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জমঈয়তে আহলে হাদীসের পরিচিতি আন্তর্জাতিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। সংগঠনটির মাধ্যমে খিদমতে খালকের আওতায় বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করেছেন অসংখ্য মাদ্রাসা, মসজিদ, ওযূখানা, ইয়াতীমখানাসহ নানা জনকল্যাণমুখী প্রতিষ্ঠান। মানবদরদি ড. এম এ বারী সহায়-সম্বলহীন কিন্তু ঈমানী চেতনায় দীপ্তমান নওমুসলিমদের জন্য গড়ে তোলেন ঢাকার অদূরে ভাওরাইদ নওমুসলিম প্রকল্প।  শিক্ষাবিস্তারের অভিপ্রায়ে প্রস্তাবিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকল্পে  ঢাকার অদূরে বাইপাইলে প্রায় ৫২ বিঘা জমি ক্রয় করেন। বর্তমানে সেখানে ইন্টারন্যাশনাল ইসলামী ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স এন্ড টেকনলোজি ভবন, আল্লামা আব্দুল্লাহেল কাফী আল কোরায়শী ( ) মডেল মাদরাসা, ইয়াতিমখানা এবং একটি আধুনিক মহিলা মাদরাসা রয়েছে।

আনুপূর্বিক বিবেচনায় প্রফেসর ড. এম এ বারী সমকালীন যামানার একজন খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ, শিক্ষা সংস্কারক ও প্রশাসক ছিলেন। আধুনিকতার সাথে ইসলামের সখ্যতার সম্পর্ক চিরদিনের; বৈরিতা কিংবা সাংঘর্ষিক নয়; বিষয়টি চমৎকার করে উপস্থাপন করেন। তিনি মানব সৃষ্টি ও বিকাশের মর্মমূলে ইঙ্গিত করে পবিত্র কুরআনের কতিপয় আয়াতের  উদ্ধৃতি দিয়ে বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এভাবেই সৃষ্টির পরতে পরতে বিজ্ঞানের খোরাক নির্দেশ করে ড. এম এ বারী বিপন্ন ও পথহারা মানবতার বহুল উপকার সাধন করেছেন। ড. এম এ বারী’র ইন্তেকালে আমরা ব্যথিত ও মর্মাহত। বারগাহে মাওলা দু‘আ করি যেন তাঁকে বেহেশ্তের প্রাচুর্য্যময় ফিরদাঊস দান করেন আমীন। 

ভাইস-প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীস; প্রফেসর ও ডিন, স্কুল অব আর্টস, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, ঢাকা।

সূরা আ—লি ‘ইমরান : ১০৩।

তুরস্কের খিলাফত তখনও অক্ষুণ্ণ ছিল।

সেভার্স চুক্তি (১০ অগাস্ট ১৯২০) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর উসমানীয় সা¤্রাজ্য ও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তির মধ্যে শান্তিচুক্তি হিসেবে স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এটি কখনো বাস্তবায়িত হয়নি। চুক্তির আওতায় উসমানীয় সা¤্রাজ্যের বৃহদাংশ হাতছাড়া হয়ে যায়।

 কামাল পাশা (১৮৮১-১৯৩৮) একজন তুকীর্ ফিল্ড মার্শাল, বিপ্লবী রাষ্ট্রনায়ক এবং তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের জাতির জনক ছিলেন।

 আলাপচারিতায় প্রাবন্ধিক একটি সূত্রে জেনেছেন যে, একবার আড়াই কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে ফেরত দিয়েছিলেন।

 দেশ-বিদেশের বেশ কিছু জার্নালে তাঁর লেখা প্রকাশিত ও প্রশংসিত হয়েছে। সৃজনশীল লেখক ও গবেষক হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে ১৭টির অধিক দেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সেমিনারে যোগদান করে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

 ২৪ ১৯৩৮-৪১ খ্রিষ্টাব্দের মাওলা বখশ কমিটি, ১৯৪৬-৪৭ খ্রিষ্টাব্দে সৈয়দ মোয়াজ্জেম উদ্দিন হোসেন কমিটি ও ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের মাওলানা আকরাম খাঁন কমিটি।

  সূরা ইয়া-সীন : ৩৮-৪০। 

  সূরা আল বাক্বারাহ্ : ২০১। 

  সূরা ইয়া-সীন : ৩৬। 

 আল্লামা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহেল কাফী মহোদয়ের ইন্তিকালের পর প্রফেসর ড. এম এ বারী মহোদয় সভাপতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। নাফিল্ড ফেলোশিপের আওতায় গবেষণা করে পোস্ট ডক্টোরাল ডিগ্রি অর্জনের জন্য লন্ডন যাওয়ার প্রাককালে তিনি আল্লামা কবীরুদ্দীন রহমানীর উপর ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব ন্যস্ত করেন। কবির উদ্দিন রহমানী একবছর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি দায়িত্ব পালন করেন।

 ঢাকা থেকে অন্যূন ৩০ কিলোমিটার দূরে ভাওরাইদ নওমুসলিম প্রকল্পটি অবস্থিত। প্রায় ৪বিঘা জমির উপর কাঁচা—পাকা ঘরে ২৪টি নওমুসলিম পরিবার বসবাস করেন। এতদ্ব্যতীত এখানে আছে একটি মসজিদ, পাঁচতলা ভবন ও মাদরাসা। সম্প্রতি গড়ে তোলা আধুনিক মাদরাসাটির নামকরণ করা হয়েছে— ‘ড. এম এ বারী মডেল মাদরাসা’। উল্লিখিত কমপ্লেক্সটির পরিচালক হিসেবে সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন কেন্দ্রীয় জমঈয়তের প্রচার ও গণমাধ্যম সম্পাদক শাইখ মুহাম্মদ রায়হান উদ্দীন।

 ড. এম এ বারী’র প্রস্তাবিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় অতি সম্প্রতি অনুমোদন লাভ করেছে। বিজ্ঞ বোর্ড অব ট্রাসিটজ বিশ্ববিদ্যালয়টির নামকরণ করেছে “ইন্টারন্যাশনাল ইসলামী ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজী” এক বুক আশা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির পথচলা শুরু হয়েছে।

 সূরা আল মু’মিনূন: ১২-১৪।

সাপ্তাহিক আরাফাত