brand-image

জমঈয়তে আহলে হাদীস- ই মূল সংগঠন : একটি নিরপেক্ষ বয়ান

371683791361.jpg
জমঈয়তে আহলে হাদীস- ই মূল সংগঠন : একটি নিরপেক্ষ বয়ান
সম্প্রতি ড. মুজাফফর বিন মুহসিন সাহেবের বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীসে আনুষ্ঠানিক যোগদান উপলক্ষে জমঈয়ত, শুব্বান এবং ঐক্য প্রয়াসী সাধারণ আহলে হাদীসগণ উচ্ছ্বসিত হন । মাতৃসংগঠনে ফেরত আসার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানান, আহলে হাদীস সংগঠনগুলোর ঐক্য কামনা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের সুপ্ত আবেগ- অনুভূতি প্রকাশ করেন । কিন্তু সামান্য গোলযোগ দেখা দিয়েছে জমঈয়তে আহলে হাদীসকে মূল সংগঠন বলা নিয়ে । যদিও গোলযোগটির নতুন গোলযোগ সৃষ্টির জন্য এবং ভিন্ন সংগঠনের কোনো উদার ও ঐক্যপ্রয়াসী ব্যক্তির অন্তরে সন্দেহ তৈরির জন্যই অবতারণা করা হয়েছে । চেপে থাকা কোনো ঐতিহাসিক সত্যকে প্রকাশের সদিচ্ছায় নয় ।
জমঈয়তে আহলে হাদীস মূল সংগঠন কি না এটা নিয়ে হয়রান না হয়ে এবং যুবসংঘের একজন সাবেক সভাপতির জমঈয়তে হাস্যোজ্জল ও উল্লসিত বদনে যোগদানের জন্য বিলাপ না করে আপনারা নিজেদেরকে প্রশ্ন করুন যে, কেন ড. মুজাফফর বিন মুহসিনের মতো ব্যক্তি যিনি ড. গালিব স্যারের হাতে গড়া কর্মী, শিষ্য, যুবসংঘের সাবেক সভাপতি, আন্দোলনের একনিষ্ঠ অনুসারী এবং তত্কালীন সময়ে জমঈয়তের প্রতি অঙ্গুলি উঁচুকারী একজন জমঈয়তে যোগদান করলেন? তিনি কী স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জমঈয়তের প্রতি তীর্যক ইশারা করতেন নাকি তাকে ভুল ইতিহাসের সবক দেয়া হয়েছিল এবং যেকোনো উপায়েই জমঈয়তের বিরোধিতা করার দীক্ষা দেয়া হয়েছিল?
এবার আসি মূল কথায় । জমঈয়তে আহলে হাদীস কি আসলেই মূল সংগঠন? যারা এ ব্যাপারে আপত্তি তুলেছেন তাদের বক্তব্য হলো, যেহেতু জমঈয়ত সৃষ্টির পূর্বে আহলে হাদীসদের আরো অনেক সংগঠন ছিল সেহেতু জমঈয়ত কিভাবে মূল সংগঠন হয়? প্রশ্নটি যৌক্তিক । আমরা যারা মূল সংগঠন মূল সংগঠন বলে হুংকার দেই তাদের জন্যও ভাববার বিষয় । কারণ দলিল- প্রমাণ, যুক্তি ও ঐতিহাসিক সত্যকে পাশ কাটিয়ে গলার জোরে কোনো কিছুকে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না, অন্ধ ভক্তকূলের মাঝে সাময়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করা যায় মাত্র । আমরা বিষয়ঠিকে প্রমাণ ও ইতিহাসের নিরিখে বিচার করতে চাই । সত্য বের করতে চাই । নিজের সংগঠনের পক্ষে গোঁড়ামি করার জন্য নয় এবং সেসবের কোনো বদ অভ্যাস আমাদের নেই- আলহামদুলিল্লাহ ।
উপমহাদেশে আহলে হাদীসের ইতিহাস সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় সূচিত হয়নি । ঐক্যবদ্ধ ও সম্মিলিত শক্তি গঠন এবং তার তত্পরতার মাধ্যমে মাসলাকে আহলে হাদীস তখনো পরিচিত হয়নি । বরং শুরুর দিকে আরব ইসলাম প্রচারক, হেজাজ, ইরাক, ইয়ামান, খোরাসান থেকে আগত দাঈ, মুবাল্লিগ ও মুজাহিদদের মাধ্যমেই এতদ্অঞ্চলে আহলে হাদীস তরিকার বিস্তৃতি ঘটে । সেগুলোর কোনোটাই আজকের মতো সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় ছিল না । ছিল বিচ্ছিন্নভাবে । একক প্রচেষ্টায় । এর ফলে দেখা যায় অনেক অঞ্চলে একসময় কোনো আহলে হাদীস বিদ্বান হয়তো বেশ ভালোভাবে হাদীসের দারস- তাদরীস দিয়েছেন, তার কাছে বিভিন্ন এলাকা থেকে ছাত্ররা এসে শিক্ষা নিয়েছেন, নিজ এলাকায় ফিরে গিয়ে ইলম প্রচার করেছেন, কিন্তু সাংগঠনিক ব্যবস্থা না থাকায় ঐ বিদ্বান মারা যাওয়ার পর বা অন্যত্র চলে যাওয়ার পর আহলে হাদীস মাসলাক স্তিমিত হয়ে গেছে । অবশ্য সেসময় সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা ও বাস্তবতা আজকের দিনের মতো অনুভূত হয় নি ।
মুঘল রাজত্বের পতন ও বৃটিশদের আধিপত্য বিস্তারের যুগসন্ধিক্ষণে ভারতগৌরব শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলাভী মুসলিমদের আভ্যন্তরীণ সংস্কারের যে তুর্যধ্বনি উচ্চারণ করেন, বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের যে চ্যালেঞ্জ পেশ করেন, মুসলিমদের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের যে স্বপ্ন তিনি দেখান তাতে মুসলমানদের একাত্ব হয়ে বৃহত্তর পরিসরে ও জাতীয় স্বার্থে সাংগঠনিক কাজ করার দীক্ষা পাওয়া যায় । যার ফলে দেখা যায় ইংরেজ খেদাও আন্দোলনে আহলে হাদীসরা এগিয়ে আসে । ভারতের বুক থেকে ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে জিহাদের জন্য আহলে হাদীসরাই সর্বাগ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে । সাংগঠনিক প্রক্রিয়া শুরু হয় মূলত জিহাদ আন্দোলনের মাধ্যমে । সাইয়েদ আহমাদ বেরলভীর মুজাহিদ বাহিনীতে যোগ দেন বিশিষ্ট আহলে হাদীস বিদ্বান, মর্দে মুজাহিদ, শহীদে বালাকোট শাহ ইসমাইল শহীদ রহ. । সাইয়েদ আহমাদ ছিলেন হানাফী, আর তার প্রধান সেনাপতি ইসমাইল শহীদ আহলে হাদীস । তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় যে যুগপত্ আন্দোলন গড়ে ওঠে তাতে ইংরেজরা চরম সংকটের মুখে পড়ে । কিন্তু ১৮৩১ সালে ৬ই মে বালাকোটের রণাঙ্গনে ইংরেজদের দোসর শিখদের নিকট তাদের পরাজয় হয়, অনেকেই সেখানে শাহাদাত বরণ করেন ।
ড . আসাদুল্লাহ আল গালিব স্যার তার থিসিসে উল্লখ করেন, বালাকোটের বিপর্যয়ের পর জিহাদ আন্দোলনের সার্বিক নেতৃত্ব পাটনা আযীমাবাদের ছাদিকপুরী পরিবারের উপর পড়ে । আলী ভ্রাতৃদ্বয়ের যোগ্যতম নেতৃত্বে বাংলাদেশ হতে সীমান্ত পর্যন্ত উপমহাদেশ জিহাদী জোশে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে । আলী ভ্রাতৃদ্বয়ের মৃত্যুর পর তাঁদের উত্তরসূরীগণ জিহাদের আগুন তাজা রাখেন, যা ব্রিটিশ রাজত্বের জন্য একটা স্থায়ী ভীতি হিসাবে বিরাজ করে । পাঁচ/সাতশো মুজাহিদকে দমন করার জন্য বৃটিশ সরকারকে ১৮৫০ হতে ১৮৬৩ পর্যন্ত ১৩ বত্সর সময়কালে সর্বমোট ২০ টি অভিযান প্রেরণ করতে হয়, যাতে অংশ নেয় ৬০,০০০ হাযার নিয়মিত বাহিনী । তাছাড়া ছিল বহুসংখ্যক অনিয়মিত ও অতিরিক্ত সৈন্য ও পুলিশ বাহিনী । [আহলেহাদীছ আন্দোলন, ৩১৩ পৃ.]
তবে জিহাদ আন্দোলন বাহ্যিকভাবে সরাসরি অসফল হওয়ার মৌলিক দুইটি কারণ ছিল । ড. মুসলেহউদ্দীন স্যার তার الحركة السلفية في البنغال থিসিসে বলেন, জিহাদ আন্দোলন সরাসরি ব্যর্থ হওয়ায় মৌলিক কারণ দুইটি,
১. স্থানীয় পাঠানদের ইংরেজদের সাথে গোপন আঁতাত এবং মুজাহিদদের সাথে গাদ্দারি করা,
২. মুজাহিদদের নিকটে সাধারণ বন্দুক ছাড়া অন্য কোনো উন্নতমানের যুদ্ধাস্ত্র না থাকা ।
তবে এই আন্দোলনের ফলে গোটা ভারতে ইংরেজবিরোধীতা জেগে ওঠে । ভারতীয়রা ভারতীয় জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত হয়ে জাতীয় কংগ্রেস (১৮৮৫ সালে) সৃষ্টি করে, মুসলিমরা ইসলামী জাতীয়তাবোধ উজ্জীবিত হয়ে মুসলিম লীগ (১৯০৬ সালে) গঠন করে, বিদেশী উপনিবেশের বিরুদ্ধে খেলাফত আন্দোলন এবং স্বাধীনতাকামী আরো অনেক দল ও সংগঠন তৈরী হয়, যেগুলো জিহাদ আন্দোলন থেকেই মূলত অনুপ্রাণিত । [الحركة السلفية في البنغال , ৩৩৯ পৃ.]
উল্লেখ্য, বালাকোটের বিপর্যয়ের পর যারা জিহাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা সকলেই পুরোদস্তুর আহলে হাদীস ছিলেন । আর এটাই ছিল আহলে হাদীসদের সর্বপ্রথম সাংগঠনিক কার্যক্রম ।
এখানে এও স্মর্তব্য যে, জিহাদ আন্দোলন চলাকালীন ভারতের দুইজন আহলে হাদীস বিদ্বান ইলমী ময়দানে অবিস্মরণীয় খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন, হাযার হাযার ছাত্ররা তাদের দারসী এবং তাসনীফী মহাসমুদ্রে অবগাহন করেছেন । তারা হলেন, মিয়া সাইয়েদ নাযীর হোসাইন দেহলাভী এবং নওয়াব সিদ্দিক হাসান খান ভূপালী । সুতরাং বলা চলে, উনিশ শতক এবং বিশ শতকের শুরুভাগ পুরোটাই ছিল আহলে হাদীসদের জিহাদী এবং ইলমী যুগ ।
এবার আসা যাক প্রচলিত অর্থে যাকে আমরা সংগঠন বুঝি সেই সাংগঠনিক যুগ । এই আলোচনায় নিরপেক্ষতা অত্যন্ত জরুরি । সেই সাথে ইতিহাসের পালাবদল, সময়ের প্রয়োজন, যুগের চাহিদা এবং মানুষের মেজাজ ও রুচির পরিবর্তনও বুঝা আবশ্যক । তা না হলে আলোচনা করে কোনো লাভ হবে না । ইতিহাসের অমোঘ সত্যকে পাশ কাটিয়ে গোয়ার্তুমি করলে কখনো সত্যের সন্ধান পাওয়া যাবে না । তথ্যের ক্ষেত্রে আমরা ড. গালিব স্যারের থিসিসের উপর অনেকটাই নির্ভর করব ।
ভারতে আহলে হাদীস সংগঠন:
ভারতে আহলে হাদীসের প্রথম সংগঠনটি হলো জামাআতে গোরাবায়ে আহলে হাদীস ।
প্রতিষ্ঠাকাল: ১৮৯৫, দিল্লী ।
এই জামাআতের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ইমারত ও বাইআত । দেশভাগের পর জামাআতের কেন্দ্রীয় দারুল ইমারত দিল্লী হতে পাকিস্তানের করাচিতে স্থানান্তরিত হয় ।
দ্বিতীয় সংগঠন: অল ইন্ডিয়া আহলে হাদীস কনফারেন্স
প্রতিষ্ঠাকাল: ১৯০৬, বিহারের আরাহ জেলা ।
প্রশ্ন হলো, জামাআতে গোরাবায়ে আহলে হাদীস থাকার পরেও অল ইন্ডিয়া আহলে হাদীস কনফারেন্স- এর প্রয়োজনীয়তা পড়ল কেন? এর জবাব হলো,
১. বাইয়াত ও ইমারতের প্রশ্নে অন্যান্য আলেমগণ গোরাবার সাথে একমত ছিলেন না ।
২. গোরাবায়ে আহলে হাদীসের কার্যক্রম সারাদেশে এবং ব্যাপকভিত্তিক ছিল না । মোট কথা, সারা ভারতে আহলে হাদীসদের একই নেতৃত্বে এবং একটি শক্তিশালী সাংগঠনিক আওতায় নিয়ে আসার জন্যই অল ইন্ডিয়া আহলে হাদীস কনফারেন্স- এর প্রয়োজনীয়তা দেখা যায় । আর ভারতের সব গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বখ্যাত আহলে হাদীস আলেম কনফারেন্সের সাথে ছিলেন । যেমন মাওলানা সানাউল্লাহ অমৃতসরী, হাফেয আব্দুল্লাহ গাযীপুরী, শামসুল হক আযীমাবাদী, আব্দুর রহমান মুবারকপুরী প্রমুখ । মনে রাখা দরকার, কনফারেন্স গোরাবাকে দ্বিখন্ডিত করে নয় বরং স্বতন্ত্র সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় । এবং কনফারেন্সের সাথে তত্কালীন ভারতের সব গ্রহণযোগ্য আলেম ছিলেন । কতিপয় সাধারণ বা অর্ধশিক্ষিত নেতৃত্বলোভীদের দ্বারা অল ইন্ডিয়া আহলে হাদীস কনফারেন্স গঠিত হয় নি ।
তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম সংগঠন: জমঈয়াতুল ইত্তিহাদিল ইসলামী (১৯২২), জমঈয়াতুল ওলামা (১৯৩২), নাদওয়াতুল মুজাহেদীন (১৯৫০) । সবকটিই ভারতের কেরালায় গঠিত । উল্লিখিত ৩টি সংগঠন পরস্পর বিরোধী কোনো সংগঠন নয়, বরং প্রথমটিরই ভিন্ন ভিন্ন বা সামষ্টিক রূপ । ড. গালিব স্যারের ভাষায়, মাওলানা মুহীউদ্দীন আল কাতেব- এর নেতৃত্বে কেরালায় যখন আন্দোলন তুঙ্গে, তখন তিনি এ আন্দোলনে সকল স্তরের আহলেহাদীছ জনগণকে যারা দ্বীনের জন্য জান মাল দিয়ে জিহাদ করতে আগ্রহী, তাদেরকে শামিল করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন ও প্রধানতঃ তাঁরই পরামর্শক্রমে ১৯৫০ সালে 'নাদওয়াতুল মুজাহেদীন' নামে এক ব্যাপকভিত্তিক আহলেহাদীছ সংগঠন কায়েম হয় এবং ইতিপূর্বে প্রতিষ্ঠিত সকল সংগঠন নবপ্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনের সদস্য হন । [৩৭৫ পৃ.]
ষষ্ঠ সংগঠন: আঞ্জুমানে আহলে হাদীস বাঙ্গালা ও আসাম ।
প্রতিষ্ঠাকাল: ১৯১৪, কলকাতা ।
তবে, "আঞ্জুমান প্রতিষ্ঠার ৩য় বর্ষে ১৩২৩ সালের ফাল্গুন মাস মোতাবেক ১৯১৬ সালের ৯, ১০, ১১ই মার্চ অল ইন্ডিয়া আহলে হাদীস কনফারেন্স- এর কলিকাতা অধিবেশনে মাওলানা হাফেয আব্দুল্লাহ গাযীপুরী, মাওলানা সানাউল্লাহ অমৃতসরী, মাওলানা আব্দুল আযীয রহিমাবাদী, মাওলানা আবুল কাসেম সায়েফ বেনারসী প্রমুখ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে সর্বসম্মতিক্রমে আঞ্জুমানে আহলে হাদীসকে অল ইন্ডিয়া আহলে হাদীস কনফারেন্সের শাখা হিসাবে গণ্য করা হয় ।" [আহলেহাদীছ আন্দোলন, ৩৮৬ পৃ.]
এই হলো ভারতের আহলে হাদীসদের সাংগঠনিক সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি । বিজ্ঞ পাঠকের নিকট সনির্বন্ধ প্রশ্ন,
১. উপরের আলোচনায় কি এটা প্রমাণিত হয় যে, সংগঠনগুলো পারস্পরিক হিংসা বিদ্বেষের কারণে ছিন্ন ভিন্ন হয়েছে?
২. যেসকল সংগঠন কেরালায় ও কলিকাতায় তৈরী হয়েছে সেগুলো কি নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের কারণে নাকি সময় ও স্থানের প্রয়োজন বিবেচনায়?
৩. উল্লিখিত সংগঠনগুলো কি পরস্পরের প্রতি অনাস্থা, হিংসা পোষণ করে জেদ ধরে ছিল নাকি আবার সময়ের তাগিদেই এক হয়ে গিয়েছিল?
কারণ, জামাআতে গোরাবায়ে আহলে হাদীস তো তাদের কার্যক্রম পাকিস্তানে নিয়ে যায় আর এদিকে কলকাতা কেন্দ্রীক 'আঞ্জুমানে আহলে হাদীস বাঙ্গালা ও আসাম' অল ইন্ডিয়া আহলে হাদীস কনফারেন্সের শাখা হিসাবে মর্যাদা পায় । বাকী থাকল কেরালার 'নাদওয়াতুল মুজাহেদীন' সংগঠনটির কথা । তাদের সাথে অল ইন্ডিয়ার কোনো বিরোধ বা গোস্বার ইতিহাস নাই । বরং কেরালা জমঈয়তে ওলামার সেক্রেটারি ও নাদওয়াতুল মুজাহেদীন গঠনের উদ্যোক্তা মুহীউদ্দীন মুহাম্মদ আল কাতেব ১৯৮৭ সালে মারকাযী জমঈয়তের (১৯৭০ সালে অল ইন্ডিয়া আহলে হাদীস কনফারেন্সের নাম পরিবর্তন করে মারকাযী জমঈয়তে আহলে হাদীস হিন্দ রাখা হয়) নায়েবে আমীর ছিলেন । সুতরাং এই সংগঠন দুটির মধ্যে যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক আছে তা সহজেই অনুমেয় । সবচেয়ে বড় কথা হলো তারা একে অপরের বিরোধী নয়, আঞ্চলিক কারণে পৃথক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে ।
পাকিস্তানে আহলে হাদীস সংগঠন:
প্রথম সংগঠন: আঞ্জুমান আহলে হাদীস লাহোর ।
প্রতিষ্ঠাকাল: ১৯১৩, লাহোর ।
এর কার্যক্রম কেবল লাহোর কেন্দ্রীক ছিল ।
দ্বিতীয় সংগঠন: জামাআতে আহলে হাদীস পাঞ্জাব (বর্তমান নাম জামাআতে আহলে হাদীস পাকিস্তান) ।
প্রতিষ্ঠাকাল: ১৯৩১, পাঞ্জাব ।
সংগঠনটি পাঞ্জাবভিত্তিক প্রতিষ্ঠা হলেও দেশ বিভাগের পর জাতীয়ভিত্তিক নামকরণ করে । কিন্তু আমার ক্ষুদ্র গবেষণায় তাদের উল্লেখযোগ্য তত্পরতা নেই । মূলত পাঞ্জাবে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কার্যক্রম ছাড়া তেমন উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম নেই ।
তৃতীয় সংগঠন: মারকাযী জমঈয়তে আহলে হাদীস পাকিস্তান ।
প্রতিষ্ঠাকাল: ১৯৪৮, লাহোর । দেশ বিভাগের পর এটিই পশ্চিম পাকিস্তানে আহলে হাদীসদের সর্বপ্রথম ও সর্ববৃহত্ জাতীয় সংগঠন । অন্যান্য দু'একটি সংগঠন যা ছিল তা জাতীয়ভিত্তিক ছিল না । থাকলে মারকাযী জমঈয়ত প্রতিষ্ঠার প্রশ্নই আসত না ।
চতুর্থ সংগঠন: জমঈয়তে আহলে হাদীস পাকিস্তান ।
প্রতিষ্ঠাকাল: ১৯৮১, গুজরানওয়ালা ।
মারকাযী জমঈয়ত থাকার পরেও আল্লামা ইহসান ইলাহি যহীর জমঈয়তে আহলে হাদীস পাকিস্তান গঠন করেন মূলত রাজনৈতিক বিষয়ে মারকাযী জমঈয়তে আহলে হাদীসের রাজনৈতিক বিষয়ে নীরব ভূমিকায় ক্ষুব্ধ হয়ে । আল্লামা ইহসান ইলাহি যহীরের অসামান্য প্রতিভা, নির্ভীকতা, ও যোগ্য নেতৃত্বে পুরো পাকিস্তানে আহলে হাদীস আন্দোলন বেগবান হয় ।
এই ক্ষেত্রে সাংগঠনিকভাবে আহলে হাদীসগণ বিভক্তির মুখোমুখি হন । কিন্তু পৃথক হলেও পুরো পাকিস্তানে আহলে হাদীসের সকল সংগঠনের মধ্যকার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ঈর্ষণীয় । আমি এর আগে ফেসবুকে বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীসের সাবেক সভাপতি প্রফেসর একেএম শামসুল আলম স্যারের পাকিস্তান সফরের ইতিবৃত্ত তুলে ধরেছিলাম । ২০০৬ সালে তিনি মারকাযী জমঈয়তে আহলে হাদীসের জাতীয় সম্মেলনে যোগদান করেন । সেই সম্মেলনে পাকিস্তানের সব আহলে হাদীস সংগঠন একই মঞ্চে একত্রিত হয় । তাদের মধ্যে কোনো আভ্যন্তরীণ ও রাজনৈতিক ইস্যুগত মতপার্থক্য থাকলেও তা দৃশ্যমান নয় । সবাই একাট্টা হয়ে সারা দেশে আহলে হাদীস আন্দোলন বেগবান করার প্রয়াসে চেষ্টিত ।
বাংলাদেশে সংগঠন:
বাংলাদেশে মূলত শাহ ইসমাইল শহীদের জিহাদ আন্দোলনে উজ্জীবিত হয়ে উত্তরবঙ্গের বগুড়া, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, নীলফামারী এবং দক্ষিণের কুমিল্লা, সিলেট ইত্যাদি অঞ্চল থেকে অনেকেই জিহাদ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন, অনেকেই ফিরে এসে শাহ ইসমাইলের দীক্ষা প্রচারের কাজে জীবন অতিবাহিত করেন, আবার মিয়া নাযির হোসাইন দেহলাভীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে অনেকেই ফিরে এসে মাসলাকে আহলে হাদীস প্রচারে লিপ্ত হন । সবচেয়ে বড় আন্দোলন গড়ে ওঠে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থানার নারায়ণপুর এলাকায় । সেখানে জিহাদ আন্দোলনের আমীর মাওলানা এনায়েত আলী প্রায় এক যুগের মতো বসবাস করেন । এর ফলেই মূলত ঐ অঞ্চলে আহলে হাদীস আদর্শ ছড়িয়ে পড়ে । সেখানে আহলে হাদীসের সবচেয়ে বড় প্রভাব বিস্তার করেন রফী মণ্ডল; যিনি মাওলানা এনায়েত আলীর হাতে বাইআত হন । উল্লেখ্য, রফী উদ্দীন মণ্ডল ও তত্পুত্র আমীরুদ্দীন সাহেবদ্বয়ের ব্যাপক তত্পরতাকেই আহলে হাদীসের প্রথম সামষ্টিক কার্যক্রম বলে বিবেচনা করা হয়, যদিও তা ব্যক্তি উদ্যাগে ছিল, যা জিহাদ আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত ছিল ।
প্রথম সংগঠন: আঞ্জুমানে আহলে হাদীস বাঙ্গালা ও আসাম, ১৯১৪ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা হয় । যা ১৯১৬ সালে অল ইন্ডিয়া আহলে হাদীস কনফারেন্সের শাখা হিসাবে মর্যাদা পায় ।
দ্বিতীয় সংগঠন: নিখিল বঙ্গ ও আসাম জমঈয়তে আহলে হাদীস ।
প্রতিষ্ঠাকাল: ১৯৪৬, হারাগাছ, রংপুর ।
প্রতিষ্ঠাতা: আল্লামা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহেল কাফী আল কোরায়শী রহ. । দেশ ভাগ হলে ১৯৫৩ সালের ১০ই ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জেনারেল কমিটির এক সভায় নিখিল বঙ্গ ও আসাম জমঈয়তে আহলে হাদীস- এর নাম পরিবর্তন করে আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ব- পাক জমঈয়তে আহলে হাদীস করা হয় । ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে উক্ত নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীস রাখা হয় ।
তৃতীয় সংগঠন: আঞ্জুমানে আহলে হাদীস পশ্চিমবঙ্গ ।
প্রতিষ্ঠাকাল: ১৯৫১ ।
১৯৪৬ সালে নিখিল বঙ্গ ও আসাম জমঈয়তে আহলে হাদীস গঠিত হলেও পরের বছর ভারত বিভক্ত হওয়ায় জমঈয়তের সদর দফতর কলিকাতা হতে পূর্ব পাকিস্তানের পাবনায় স্থানান্তরিত হয় । ফলে পরিবর্তিত প্রয়োজনের তাগিদে ১৯৫১ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারী তারিখে কলিকাতার মিছরীগঞ্জ মসজিদে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনের মাধ্যমে 'আনজুমান আহলে হাদীস পশ্চিমবঙ্গ' গঠিত হয় । ........... ১৯৭৫ সালে আনজুমানের স্থলে পশ্চিমবঙ্গ 'জমঈয়তে আহলে হাদীস' নামকরণ করা হয় । বর্তমানে এই জমঈয়ত কেন্দ্রীয় জমঈয়তে আহলে হাদীস হিন্দ- এর প্রাদেশিক শাখা হিসাবে পরিগণিত । [ আহলেহাদীছ আন্দোলন, ৩৮৭ পৃ.]
সম্ভবত বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীসকে দ্বিতীয় সংগঠন মনে করে অর্বাচীন কিছু বালকের দল বেজায় খুশি । কিন্তু বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীস কে বাংলা অঞ্চলের দ্বিতীয় সংগঠন হিসাবে পরিচিত করে দেয়াতে খুশিতে আটখানা হওয়ার কিছু নাই । জ্ঞানপাপী, উগ্র ও নিজ দলের অন্ধ ভক্তকূলই কেবল এতে খুশি হতে পারে এবং অতি উত্সাহ নিয়ে বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীসকে মূল বা প্রথম সংগঠন নয় হিসাবে অপপ্রচার করতে পারে । এটা জাহেলি যুগের সেই حمية الجاهلية বা জাহেলিয়াতের গোত্রপ্রীতির মতোই । সত্য মিথ্যা যাচাই না করে, ভালভাবে ইতিহাস না পড়ে এবং সর্বপ্রাচীন আহলে হাদীস সংগঠনটির বিরোধিতা করে মনের খাহেশ মেটানোর জন্যই এই অপপ্রচার ।
কারণ আমরা জেনে আসলাম যে, বাংলা ভাষাভাষী আহলে হাদীসদের মাঝে যে কয়েকটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা লাভ করে তার প্রথমটি তথা 'আনজুমানে আহলে হাদীস বাঙ্গালা ও আসাম' দুই বছরের মাথায় অল ইন্ডিয়া আহলে হাদীস কনফারেন্সের শাখা হিসাবে মর্যাদা পায় । ফলে বাংলা ভাষাভাষী আহলে হাদীসদের মাঝে কোনো জাতীয় সংগঠন বিদ্যমান থাকে না । এবং এজন্যই 'নিখিল বঙ্গ ও আসাম জমঈয়তে আহলে হাদীস' গঠিত হয় । যা দেশভাগের পরে পূর্ব- পাক জমঈয়তে আহলে হাদীস এবং সর্বশেষ বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীস নাম ধারণ করে । অন্যদিকে, দেশভাগের কারণে আনজুমানে আহলে হাদীস পশ্চিমবঙ্গ গঠিত হয়, পরবর্তী সময়ে তা জমঈয়তে আহলে হাদীস হিন্দ- এর প্রাদেশিক শাখা হিসাবে পরিগণিত হয় । ইতিহাসের এই সরল সত্য জানার পরেও কেউ যদি দাবী করে জমঈয়তে আহলে হাদীস মূল সংগঠন নয়, বিশেষ করে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সেটি আহলে হাদীস জনগোষ্ঠীর মূল ও প্রাচীন সংগঠন নয় তাহলে তাকে ভারতে গিয়ে মূল সংগঠন বের করে তাতে যুক্ত হওয়ার অনুরোধ রইল । বাংলাদেশে নয় ।
আলোচনার শেষে আর দুইটি সংগঠনের কথা উল্লেখ না করলে এবং সেদু'টি জমঈয়তেরও পূর্বে গঠিত হওয়া সত্ত্বেও জমঈয়ত প্রতিষ্ঠার হেতু কী- তা স্পষ্ট না করলে আমার সমালোচক বন্ধুবর্গ মহাসুযোগ পেয়ে যাবেন এবং আমাকে ও জমঈয়তকে একহাত নিয়ে নেবেন । কাজেই তা খোলাসা করা প্রয়োজন ।
১৯৪৬ সালেরও অনেক আগে 'জামাআতে মুজাহিদিন' নামে একটি সংগঠন বাংলার উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুরের চিরিরবন্দরকেন্দ্রীক প্রতিষ্ঠা লাভ করে । এই সংগঠনটি মূলত জিহাদ আন্দোলনে মুজাহিদ ও প্রয়োজনীয় রসদপত্রের যোগান দিতে গঠিত হয়েছিল । মাওলানা যিল্লুর রহমান সালাফী, মাওলানা জয়নাল আবেদীন (যিনি শুব্বানের সাবেক সহ- সভাপতি, বর্তমান কাঞ্চনপুর এলাহিয়া ফাযিল বিএ মাদ্রাসার সহকারী অধ্যাপক শাইখ আব্দুল মালেক মাদানীর আপন নানা) প্রমুখ এতে নেতৃত্ব দেন । 'আল মুজাহিদ' নামে তাদের পত্রিকাও প্রকাশিত হতো । প্রকাশক এখনো জীবিত, নীলফামারীতে বসবাস করেন । জিহাদ আন্দোলন শেষ হলে এবং ভারতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ গঠিত হলে সাধারণ হিন্দু - মুসলিম স্বাধীনতার প্রশ্নে ঐ দুই দলের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে । ফলে জামাআতে মুজাহিদিনের কার্যক্রম একপ্রকার স্তিমিত হয়ে যায় । (এখন সেই সংগঠনের কোনো কার্যক্রম নেই) পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জামাআতে মুজাহিদিনকে পুনর্গঠন করা অথবা সেখানে যোগদান করে আহলে হাদীস সমাজকে একত্রিত করা চরম বোকামি বিধায় বাঙ্গালা অঞ্চলের জন্য একটি জাতীয় প্লাটফর্মের আবশ্যকতা দেখা যায় । জাতীয় সেই প্লাটফর্মটি নিখিল বঙ্গ ও আসাম জমঈয়তে আহলে হাদীস হয়ে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীস নাম ধারণ করে ।
দ্বিতীয় সংগঠনটি হলো 'জামায়াতে গোরাবায়ে আহলে হাদীস' । আগেই বলা হয়েছে ১৮৯৫ সালে ভারতে জামাআতে গোরাবায়ে আহলে হাদীস প্রতিষ্ঠিত হয় । তারই শাখা হিসেবে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা ইত্যাদি এলাকায় সংগঠনটির কর্মতত্পরতা লক্ষ্য করা যায় । এখন সংগঠনটির কার্যক্রম দৃশ্যমান নয় । পূর্বে এও উল্লেখ করা হয়েছে যে, আহলে হাদীসদের সর্বভারতীয় প্লাটফর্মের প্রয়োজনে 'অল ইন্ডিয়া আহলে হাদীস কনফারেন্স' গঠিত হয় । বাইআত ও ইমারতের প্রশ্নে গোরাবায়ে আহলে হাদীসের সাথে অল ইন্ডিয়া একমত ছিল না । এজন্য হয়তোবা একসাথে কাজ করাও সম্ভব হয়নি । বাংলাদেশের গোরাবায়ে আহলে হাদীসেও বাইয়াত ও ইমারতের প্রচলন আছে এবং বাইআত ও ইমারত না থাকায় এখনো তারা জমঈয়তকে সমর্থন করে না ।
আবার প্রথমত, গোরাবার কার্যক্রম এতটাই নির্দিষ্ট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল যে সেটাকে জাতীয় সংগঠনে রূপ দেয়া প্রায় অসম্ভব ছিল । এমনটা সম্ভব নয় যে, আল্লামা আব্দুল্লাহেল কাফী আল কোরায়শী জমঈয়ত গঠনের পূর্বে তাদের সম্পর্কে জানতেন না । তিনি জানতেন । কিন্তু সারা বাংলা অঞ্চলে আহলে হাদীসদের বৃহত্তর প্লাটফর্ম গড়ে তোলার লক্ষ্যে জাতীয় সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক ছিল ।
দ্বিতীয়ত, বাইআত ও ইমারতের প্রশ্নে আল্লামা কোরায়শী গোরাবার সাথে একমত ছিলেন না ।
তৃতীয়ত, সেসময় আহলে হাদীস অঞ্চলগুলোতে বড় বড় আলেমগণ নেতৃত্ব দিতেন এবং তাদের একক কর্তৃত্ব বজায় ছিল । তাদেরকে পীর সাহেবও বলা হতো । তবে তা প্রচলিত পীরগিরি ছিল না । আল্লামা কোরায়শী তার বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টি দিয়ে দেখেন এভাবে বিচ্ছিন্ন থাকলে বৃহত্তর আহলে হাদীস জনগোষ্ঠীর জাতীয় জীবনে কখনো উন্নতি হবে না । একসময় তারা অস্তিত্ব সংকটে পড়বে, এবং একেক আলেম একেক ফাতাওয়া দেয়ার কারণে আকীদা আমলে এক হওয়া সত্ত্বেও আহলে হাদীস জনগোষ্ঠী ভিন্ন ভিন্ন আমলে ও চিন্তায় বিভক্ত হয়ে পড়বে । তারা নামে হবে আহলে হাদীস, কর্মী হবে অন্য মানহাজ ও সংগঠনের । কাজেই আহলে হাদীসদের এমন একটি বৃহত্তর সংগঠন প্রতিষ্ঠা আবশ্যক ছিল যা বাংলা অঞ্চলের সকল আহলে হাদীসকে একত্রিত করতে পারে, তাদেরকে জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে, যে ইসলামের জন্য পাকিস্তান ভারত থেকে পৃথক হলো সেই ইসলাম যেন পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র হয় এবং আহলে হাদীসগণ যেন পিওর ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে সেজন্য পুরো বাংলা ভাষাভাষী আহলে হাদীসদের জাতীয় প্লাটফর্মে একীভূত হয়ে কাজ করার দৃঢ় বাসনা নিয়ে আল্লামা কোরায়শী নিখিল বঙ্গ ও আসাম জমঈয়তে আহলে হাদীস গঠন করেন । যা দেশ ভাগের পর পূর্ব- পাক জমঈয়তে আহলে হাদীস এবং স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীস হিসেবে পরিচিত হয় ।
আল্লাহর শপথ! আমি এই প্রবন্ধে জ্ঞাতসারে সামান্যতম পক্ষপাতিত্ব করি নি । অজ্ঞাতসারে হলে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাচ্ছে । উল্লিখিত আলোচনায় একজন নিরপেক্ষ পাঠক যদি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন তাহলে আমি ধন্য । আমি আমার এই লেখা একটি বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চেষ্টা করেছি, তা হলো বাংলাদেশে আহলে হাদীসদের মূল সংগঠন কোনটি? এখন মূল সংগঠন থেকে বের হওয়া যাবে কি না, বিভক্তির সময় এমন কোনো প্রেক্ষাপট ছিল কি না, আবারো ঐক্যবদ্ধ হওয়া সম্ভব কি না, জমঈয়ত তার নীতি আদর্শে অটল কি না- এসব অন্য আলাপ । যারা পড়বেন একটি প্রশ্নের জবাবের জন্যই পড়বেন । তা না হলে খেই হারিয়ে ফেলবেন ।
আমার এই লেখা পড়ে যদি সন্দিগ্ধ কোনো জমঈয়ত বা শুব্বান কর্মীর অস্থিরতা কেটে যায়, আমাদের অন্যান্য সংগঠনের কর্মী ভাইদের সম্বিত ফিরে আসে এবং আমাদের বিরোধী ভাইদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হয় তবেই এই লেখা স্বার্থক ।
তানযীল আহমাদ
মিরপুর, ঢাকা ।
১৭ই রমাযান ১৪৪৪, ৯ই এপ্রিল, ২০২৩ ।

Facebook