আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস, International Labor Day, عيد العمال العالمي
শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদা, ইসলামী দৃষ্টিকোণ।
আজ পহেলা মে, মে দিবস, আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস।
শ্রম
ও শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে প্রেরণার বাতিঘর হিসেবে বিশ্বময় আজকের দিবসটি পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে। অগণিত শ্রমজীবী ও মেহনতি মানুষের অধিকার সুরক্ষার দাবিতে এই দিনে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আওয়াজ ওঠে। সভা, সেমিনার, মিছিল, শোভাযাত্রা, সিম্পোজিয়াম কিংবা মানববন্ধনের হিড়িক পড়ে যায়। সবার দাবির মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে, শ্রমিকের নায্য পারিশ্রমিক নিশ্চিত এবং তাদের প্রতি চলা অবিচার বন্ধ করা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, নানাবিধ শ্রম আইন করেও শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। ক্যামেরার সামনে বড় গলায় শ্রমিক অধিকারের কথা বলে মুখে ফেনা উঠানো ব্যক্তিও শ্রমিকের প্রাপ্য আদায়ে গড়িমসি ঠিকই করেন। সারা মাস খাটিয়ে বেতন নিয়ে টালবাহানার অভিযোগও বহু রথী মহারথীর বিরুদ্ধে। বিশেষ করে আমাদের দেশে গার্মেন্টস শ্রমিকদের দূরাবস্হা অবর্ণনীয়।
দেশ, জাতি ও সভ্যতা বিনির্মাণে শ্রমিকদের ভূমিকা ও অবদান অপরিসীম। দূর্গ থেকে নিয়ে বাড়ীঘর, দালান কােঠা, প্রাসাদ, অট্টালিকা, কালভার্ট, ব্রীজ সব কিছুই তো অবদান এই শ্রমিকদের।
আম্বিয়ায়ে কিরাম দায়ী ইলাল্লাহ ও শ্রমিকের ভূমিকাতেই বিশ্ববাসীকে সভ্যতার শিক্ষা প্রদান করেছিলেন। প্রথম মানব কিংবা আবুল বাশার আদম আ: তিনি চাষাবাদ করেছেন, দাউদ আ: লৌহ শিল্লকে কাজে লাগিয়ে সমরাস্ত্রে তৈরীতে বিশ্বে পথিকৃৎের মর্যাদায় সর্বকালীন আসীন আছেন ও থাকবেন ইন শা আল্লাহ।
আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ সঃ ও মূসা আ: ছাগল চরিয়েছেন যেমন আমাদের নবী সাঃ ব্যবসা- বাণিজ্যও করেছেন।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে বিভিন্নভাবে শ্রম দিতে বলেছেন: তিনি বলেন :
لقد خلقنا الإنسان في كبد
অর্থাৎ আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি কষ্ট-ক্লেশের মধ্যে অর্থাৎ আজীবন সে জীবন জীবিকার সংগ্রামেই নিয়োজিত থাকবে।( সূরা আল বালাদ ০৪)।
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিসাবে পৃথিবীর সব খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার নিশ্চিত করেছে। শ্রমজীবী ও মেহনতি মানুষের যাবতীয় সমস্যার সঠিক, ন্যায়ানুগ, যুক্তি ও বাস্তবসম্মত সমাধান দিয়েছে। বৈধ পথে খেটে খাওয়াকে ইসলাম উৎসাহিত করেছে। বিশ্বনবি (সা.) নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন এবং এতেই খুব বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন।
মহানবি (সা.) ছিলেন শ্রমিকবান্ধব অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি এমন একটি সমাজব্যবস্থা কায়েমের রূপরেখা দিয়েছেন, যেখানে থাকবে না জুলুম-শোষণ কিংবা দুর্বলকে নিষ্পেষিত করার মতো ঘৃণ্য প্রবণতা। তিনি শিখিয়েছেন শ্রমিকও মানুষ, তাদেরও সম্মানের সঙ্গে বাঁচার অধিকার আছে। মানবতার মুক্তির মহাসনদ নামে খ্যাত বিদায় হজের ভাষণে তিনি বলেছেন ‘তোমাদের অধীনস্তদের প্রতি খেয়াল রাখবে। তোমরা যা খাবে তাদেরও তা খাওয়াবে, তোমরা যা পরবে তাদেরও তা পরাবে’। (মুসলিম, তিরমিজি)।
নবিজি (সা.) খেটে খাওয়া শ্রমজীবীকে ভীষণ ভালোবাসতেন। মক্কা বিজয়ের দিন কাবা ঘরে প্রথম প্রবেশের সময় তিনি শ্রমজীবী বেলাল (রা.) ও খাব্বাব (রা.)কে সঙ্গে রেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, বেলাল (রা.)কে ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন বানিয়েছিলেন। অথচ ইসলাম পূর্ব যুগে হাবশী গোলাম বেলালের কোনো সামাজিক মর্যাদা ছিল না। ইসলাম বেলাল (রা.)কে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছে। আনাস (রা.) বলেন, আমি দশ বছর নবিজি (সা.)-এর খেদমত করেছি। অথচ দীর্ঘ এ সময়ে তিনি কখনো আমাকে ধমক দেননি। তিনি খেতে বসলে আমাকে সঙ্গে নিয়েই খেতেন। একই প্লেটে খেতাম আমরা।
শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বনবি (সা.) সোচ্চার ছিলেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবি কারিম (সা.) বলেন,
أعطوا الأجير أجره قبل أن يجف عرقه
তোমরা ঘাম শুকানোর আগে শ্রমিককে তার মজুরি দিয়ে দাও। ইবনে মাজাহ, হাদিস নং-২৪৪৩ শাইখ আলবানী রহঃ হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদিসে বিশ্বনবি (সা.) বলেন, আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেছেন, ‘কিয়ামতের দিবসে আমি নিজে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হব। এক ব্যক্তি, যে আমার নামে ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করল। আরেক ব্যক্তি, যে কোনো স্বাধীন মানুষকে বিক্রি করে তার মূল্য ভোগ করল। অপর ব্যক্তি, যে কোনো শ্রমিক নিয়োগ করে তার থেকে পুরো কাজ আদায় করেও তার পারিশ্রমিক দেয় না। বুখারি, হাদিস নং ২২২৭।
নবী সাঃ আরো ইরশাদ করেন:
ما أكل احد طعاما قط خيرا من أن يأكل من عمل يده
নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য আজ পর্যন্ত তোমাদের মধ্যে কেউ গ্রহণ করেনি। সহীহ বুখারী।
তবে শ্রমিকদের অবশ্যই নিখুঁত ও আমানতদারীর সাথে কাজ করতে হবে। নবী সাঃ বলেন:
إن الله يحب إذا عمل أحدكم عملا أن يتقنه
মহান আল্লাহ এটা অত্যাধিক পছন্দ করেন যে তোমরা যখন কোন কাজ করবে সেটি নৈপুণ্যের সাথে নিখুঁতভাবে করবে। তাবারানী ও আবূ ইয়া'লা। শাইখ আলবানী রহঃ হাদীসটিকে বিভিন্নভাবে বর্ণিত সনদের ভিত্তিতে সহীহ বলেছেন।
শ্রমিকদের মালিকদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি ভালবাসা থাকতে হবে। সামান্য অজুহাতে ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ মারাত্মক গর্হিত কাজ। কিয়ামত দিবসে এরা রেহাই পাবে না। এক হজার টাকার মালিক নয় অথচ কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট করে করে দিচ্ছে। এরা দেশ ও জাতির শত্রু। দেশকে ভালবাসুন, দেশের মানুষকে ভালবাসুন, সুখী সুন্দর ও সমৃদ্ধশীল বাংলাদেশ গড়ার পিছনে ভুমিকা রাখুন। মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে তাওফীক দান করুন, আমীন।
অধ্যাপক ড আব্দুল্লাহ ফারুক
সভাপতি, বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলে হাদীস