তাযিয়া, মাতম, তাযিয়া মিছিল : দলীল- যুক্তি, জবাব এবং সংক্ষিপ্ত ঐতিহাসিক বিবরণ
মিরপুরে যে জায়গাতে দারুস সুন্নাহ অবস্থিত, তার পাশেই শিয়া ক্যাম্প। এছাড়াও একটু দূরে তাদের কয়েকটি ক্যাম্প আছে । (এমনকি মিথ্যুকরা আমাদের মসজিদকে শিআ মসজিদ নামে অপপ্রচার করে) সেই সুবাদে মুহাররমের তাযিয়া মিছিল প্রতিবছরই দেখে আসছি । আমি খুব আশ্চর্য হই তাদের এসব আচার দেখে। একজন সুস্থ বিবেকবান মানুষ কিভাবে এটাকে মেনে নেয়, কিভাবে এটাকে ধর্মাচার হিসেবে পালন করে, কিভাবে এটাকে শোক প্রকাশ করা বলে তা প্রলয়কাল
পর্যন্ত আমাদের অজানা থেকে যাবে হয়তো ।
হোসাইন রা. রাসূলের দৌহিত্র, প্রিয় পাত্র, জান্নাতে যুবকদের সর্দার, উম্মাহর গর্ব, চেতনার উত্স, বীরত্ব ও সাহসের উপমা, পরহেজগারিতা ও সত্যাশ্রয়ীর বিরল দৃষ্টান্ত, আমাদের শেরে তাজ । শিয়া এবং তাদের সমর্থনপুষ্ট তথাকথিত সুন্নীরা যে দাবী করে আমরা হোসাইনকে রা. ভালবাসি না- তা নির্জলা মিথ্যা অপবাদ, বাস্তবতাবিবর্জিত ।
অনুরুপ ইয়াযিদ কোনো সাহাবি নয়, কোনো নেককার পরহেজগার আল্লাহওয়ালা বান্দাও নয় যে, তার অনুসৃত রীতি আমাদের অনুসরণ করতে হবে, তার পক্ষে সাফাই গাইতে হবে । তার ব্যাপারে আমাদের আকীদা তাই যা আহলুস সুন্নাহ ওয়ালা জামাআতের ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহ. বলেছেন- "আমরা তাকে ভালবাসি না, গালিগালাজও করি না । কোনো ঈমানদার কি ইয়াযিদকে ভালবাসতে পারে? [শরহুল ওসিয়্যাতিল কুবরা লি ইবনি তাইমিয়া, আব্দুল আযিয রাজেহি, খ: ১০, পৃ: ১২]
আমি তাযিয়া মিছিল নিয়ে কথা বলতে চাই । তাযিয়া অর্থ শোক প্রকাশ । হোসাইন রা. ১০ই মুহাররম ৬১ হিজরিতে ইরাকের কারবালায় চরম সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে শাহাদাত বরণ করেন । সেই উপলক্ষ্যে শিয়ারা তাযিয়া মিছিল করে শোক প্রকাশ করে । যদিও তাযিয়া মিছিল দেখে কারো মনে হবে না যে, তারা শোক প্রকাশ করছে । ১-১০ মুহাররম এই দশ দিন ঢোলের গগনবিদারি শব্দে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয় । সলাতের সময়েও তারা রেহাই দেয় না । বাসায় থাকা তো কঠিন হয়ে পড়ে । অসুস্থ মানুষের এমন কানফাটা আওয়াজে কি অবস্থা হয় আল্লাহ্ই ভালো জানেন। তাযিয়া মিছিলে অংশগ্রহণকারী প্রায় সকলেই কিশোর যুবক, অনেকেই নেশাখোর, ধর্ম বুঝেই না, ইসলামও বুঝে না, শিয়া ধর্মও বুঝে না । মুহাররম আসলেই গাঁজা টানে আর ঢোল পেটায় । শোক প্রকাশের নামে আনন্দ প্রকাশ করে থাকে ।
তাযিয়া ও ও তাযিয়া মিছিলের ইতিহাস:
ক) তাযিয়ার (শোক প্রকাশ) ইতিহাস:
খ) তাযিয়া মিছিলের ইতিহাস ।
তাযিয়ার ইতিহাস:
আমরা এখানে তাযিয়া ও মাতমের বিপক্ষের দলিলগুলো উপস্থাপন করব না। কারণ মাতমের বিরুদ্ধে স্বয়ং শিয়াদের কিতাবেই ভুরি ভুরি প্রমাণ বিদ্যমান। আমরা কেবল ওই সকল দলিলের জবাব দেয়ার চেষ্টা করব যেগুলো দিয়ে শিয়ারা তাযিয়া ও মাতমের পক্ষে সাফাই গায়। তারা তাযিয়ার স্বপক্ষে ঐতিহাসিকভাবে যেসব দলীল উপস্থাপন করে:
১. কারবালা প্রান্তরে আলে বাইতের
যে সকল নারী ও শিশুরা জীবিত ছিলেন, তারা হোসাইন রা.- এর মর্মান্তিক শাহাদাতে চরম বেদনাহত হয়ে কান্নাকাটি ও রোনাজারি করেছেন, যা শোক বা তাযিয়ারই প্রমাণ করে।
২. আলে বাইতকে কুফা থেকে দামেশকে ইয়াযিদের নিকটে যাওয়ার পথিমধ্যে বেদনাবিধুর হয়ে সবাই কান্নাকাটি বা শোক প্রকাশ করে ।
৩. দামেশক থেকে মদীনায় ফিরলে মদীনাবাসী আলে বাইতের শোকাহত সদস্যদের দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন । তারাও তাদের সাথে সহমর্মিতা প্রকাশ করেন ।
৪. ইমাম মাকরিযী তার 'খুতাতে' উল্লেখ করেছেন,
لما رأت هند زوجه يزيد رأس الحسين بكت ودخلت على يزيد متهوكة الحجاب وهي تصيح...
ইয়াজিদের স্ত্রী হিন্দ হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর মাথা দেখে কান্না করলেন এবং ইয়াজিদের দরবারে চিৎকার করতে করতে প্রবেশ করলেন, এমনকি সেসময় তার হিজাব ঠিক ছিল না ।
জবাব : উপরের দলিলগুলো পর্যালোচনা করার মত দলিল হিসেবে কি আপনার মনে হয়? এগুলো দিয়ে কি প্রতি বছর তাজিয়ার স্বপক্ষে দলিল দেয়া কোনো বিবেকবান মানুষের কাজ হতে পারে? অথচ এগুলো দিয়েই শিয়াদের বড় বড় আলেমরা তাযিয়ার স্বপক্ষে গলাবাজি করে থাকে । সাধারণ মানুষদেরকে ধোঁকায় ফেলে। ধর্মের নামে অধর্মের চর্চা করে এবং ধর্মকে ব্যবসার দারুন উপায় হিসেবে গ্রহণ করে ।
উল্লিখিত দলিলগুলোর ব্যাপারে আমরা শুধু এটুকুই বলব যে, হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাতের প্রাক্কালে বা শাহাদাতের সংবাদ শুনে মুসলিম মাত্রই শোকাহত হয়ে পড়েন । কারণ তিনি রাসুলের প্রিয় দৌহিত্র, ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহার কলিজার টুকরা, জান্নাতে যুবকদের সরদার, মুসলিম উম্মাহর সিংহ শার্দুল। খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রকৃত মুসলিমরা সকলেই শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন । কিন্তু তাই বলে তারা প্রতিবছর এর জন্য শোক প্রকাশ করেন নাই, তাজিয়া বের করেন নাই, মাতম করেন নাই, তাজিয়া মিছিলের নামে মুশরিকদের রথ যাত্রার মত অনুষ্ঠান করেন না ।
এই অবস্থা তো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওফাতের পর হয়েছিল । সাহাবায়ে কেরাম দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলেন । তাই বলে কেউ কি পরবর্তীতে শোক দিবস পালন করেছেন? রাসূলের জন্য তাজিয়া মিছিল বের করেছেন? মাতম করেছেন? জাহিলি যুগের মত বিলাপ করেছেন?
৫. عَنْ أَنَسٍ قَالَ : قَنَتَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ شَهْرًا يَدْعُو عَلَى رِعْلٍ، وَذَكْوَان
আনাস রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক মাস কুনুত পড়েছেন । রে'ল এবং জাকওয়ান গোত্রের বিরুদ্ধে বদদোয়া করেছেন । [সহীহুল বুখারী, হা. নং: ১৩০৩]
শিয়ারা বলে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কতিপয় ক্বারী সাহাবীর মর্মান্তিক মৃত্যুর কারণে দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে তাদের হত্যাকারী রে'ল এবং জাকওয়ান গোত্রের বিরুদ্ধে এক মাস পর্যন্ত কুনুত পড়েছেন । কাজেই দীর্ঘ সময় ধরেও মাতম বা শোক প্রকাশ করা যায় ।
জবাব :
প্রথমত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শোক প্রকাশের জন্য এক মাস কুনুত পড়েননি বরং তিনি হত্যাকারী গোত্রের বিরুদ্ধে বদদোয়া করেছেন । দ্বিতীয়ত, যদি শোক প্রকাশ করতেই হয় তাহলে তো মাতম কিংবা তাযিয়া মিছিল নয় বরং সালাতে কুনুত পড়তে হবে । কিন্তু শিয়ারা কি তা করে নাকি তাযিয়া মিছিলের নামে শোকের পরিবর্তে আনন্দের প্রকাশ করে?
৬. আবু তালেব এবং খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা একই বছর তথা নবুয়তের দশম বছরে মৃত্যুবরণ করেন। তাদের মৃত্যুতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এত শোকাহত হয়ে পড়েন যে সে বছরকে আমুল হুজুন বা দুশ্চিন্তার বছর বলে অভিহিত করা হয়। অর্থাৎ পুরো একটি বছর নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে কাটিয়েছেন। সুতরাং কারো মৃত্যুর জন্য দীর্ঘদিন পর্যন্ত চিন্তা ক্লিষ্ট হয়ে থাকা যায়।
জবাব :
শিয়ারা যে কত ধূর্ত তা তাদের উল্লিখিত দলিল প্রদানের মাধ্যমেই স্পষ্ট হয়। বাংলায় যাকে বলে "কিসের সাথে কি, পান্তা ভাতে ঘি" ।
প্রথমত, দুশ্চিন্তার বছর বলতে এমনটি নয় যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সারাটি বছর দুশ্চিন্তায় কাটিয়েছেন, শোক পালন করেছেন। বরং এর মূল অর্থ হলো, মক্কার প্রতিকূল পরিবেশে ইসলামী দাওয়াতের পথ যখন রুদ্ধ হচ্ছিল, কাফের মুশরিকদের অত্যাচার বৃদ্ধি পাচ্ছিল, রাসূল এবং সাহাবায়ে কেরামের জীবন হুমকির মুখে পড়ছিল সেই মুহূর্তে আবু তালেব রাসুলের পাশে দাঁড়িয়েছেন, কাফেরদের থেকে রক্ষা করছিলেন। অন্যদিকে খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা রাসূলকে শান্তনার বাণী শোনাচ্ছিলেন, মানসিক প্রশান্তি দিচ্ছিলেন। তো তাদের দু'জনের চলে যাওয়ার কারণে কাফেরদের থেকে হামলার আশঙ্কায় নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন ।
দ্বিতীয়ত, চিন্তাগ্রস্হ হয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি কোন বিলাপ বা মাতম করেছেন, তাযিয়া প্রকাশ করেছেন, নিজের কাপড় ছিঁড়ে ফেলেছেন, নিজের গালে আঘাত করেছেন? তা যদি না হয় তাহলে এই দলিলের ভিত্তিতে তাজিয়া বা তাজিয়া মিছিলের পক্ষে কী সমর্থন পাওয়া যায়?
৭. ইমাম তিরমিজি তার সুনানে হাসান ও হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুমার মর্যাদা অধ্যায়ে বর্ণনা করেন,
حَدَّثَنَا أَبُو سَعِيدٍ الْأَشَجُّ ، قَالَ : حَدَّثَنَا أَبُو خَالِدٍ الْأَحْمَرُ ، قَالَ : حَدَّثَنَا رَزِينٌ ، قَالَ : حَدَّثَتْنِي سَلْمَى قَالَتْ : دَخَلْتُ عَلَى أُمِّ سَلَمَةَ وَهِيَ تَبْكِي، فَقُلْتُ : مَا يُبْكِيكِ ؟ قَالَتْ : رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - تَعْنِي فِي الْمَنَامِ - وَعَلَى رَأْسِهِ وَلِحْيَتِهِ التُّرَابُ، فَقُلْتُ : مَا لَكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ ؟ قَالَ : " شَهِدْتُ قَتْلَ الْحُسَيْنِ آنِفًا ".
...... সালমা বলেন, আমি উম্মে সালামার নিকটে প্রবেশ করলাম, সেই মুহূর্তে তিনি কাঁদছিলেন। আমি বললাম আপনি কাঁদছেন কেন? তিনি বললেন আমি স্বপ্নে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি তার দাঁড়িতে এবং মাথায় মাটি লেগে আছে। আমি বললাম আল্লাহর রাসূল আপনার কি হয়েছে? তিনি বললেন আমি এইমাত্র হোসাইন এর নিহত হওয়া দেখলাম।
জবাব: আল্লামা মোবারকপুরী তার তুহফাতুল আহওয়াজিতে হাদিসটিকে দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ হাদিসের রাবি সালমা অপরিচিত । কাজেই এই হাদীসটি গ্রহণযোগ্য নয়।
৮. উম্মু সালাম রা. শোক প্রকাশ করেন । কারণ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে হোসাইন রা.- এর শাহাদাত সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন বিশেষভাবে । মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত আছে,
أن النبي صلى الله عليه وسلم دفع إليها قارورة فيها تربة من كربلاء وقال لها إن جبريل أعلمني أن أمتي تقتل الحسين فأعطاني هذه التربة فإذا صارت دما عبيطا فاعلمي أن الحسين قد قتل........... فلما صارت دما عبيطا صارخت أم سلمة فتصارخت نساء المدينة حتى سمع من المدينة رجة ما سمع مثلها قط.
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে একটা কাঁচের পাত্র দিলেন, যাতে কারবালার মাটি ছিল এবং বললেন, আমাকে জিবরিল জানালেন যে, আমার উম্মাত হোসাইকে হত্যা করবে । তিনিই আমাকে এই মাটি দিয়েছন। যখন তুমি কাঁচের পাত্রটিকে লাল বর্ণ ধারণ করতে দেখবে তখন বুঝবে নিও হোসাইনকে হত্যা করা হয়েছে ।................ এরপর হোসাইন রা. এর শাহাদাতের দিন উম্মু সালামা দেখলেন, পাত্রের রং লাল হয়ে গেছে । এ দৃশ্য দেখে তিনি চিতকার করে উঠলেন । মদীনায় মহিলারাও এমন চিতকার করে উঠল, ফলে মদীনায় এমন আওয়াজের প্রতিধ্বনি হলো, যা আগে কখনো শোনা যায়নি ।
ইমাম আহমাদ তার 'মুসনাদে' হা.নং : ২৬৫২৪, ইমাম তবারনী তার 'মু'জামুল কাবিরে' ও ইমাম হাইসামী তার 'মাজমাউয যাওয়ায়েদে' ৯/১৯২ নিয়ে এসেছেন ।
জবাব :
মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হাদিসটি হলো,
حَدَّثَنَا وَكِيعٌ ، قَالَ : حَدَّثَنِي عَبْدُ اللَّهِ بْنُ سَعِيدٍ ، عَنْ أَبِيهِ ، عَنْ عَائِشَةَ ، أَوْ أُمِّ سَلَمَةَ ، قَالَ وَكِيعٌ : شَكَّ هُوَ - يَعْنِي عَبْدَ اللَّهِ بْنَ سَعِيدٍ - أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ لِإِحْدَاهُمَا : " لَقَدْ دَخَلَ عَلَيَّ الْبَيْتَ مَلَكٌ لَمْ يَدْخُلْ عَلَيَّ قَبْلَهَا، فَقَالَ لِي : إِنَّ ابْنَكَ هَذَا حُسَيْنٌ مَقْتُولٌ، وَإِنْ شِئْتَ أَرَيْتُكَ مِنْ تُرْبَةِ الْأَرْضِ الَّتِي يُقْتَلُ بِهَا ". قَالَ : " فَأَخْرَجَ تُرْبَةً حَمْرَاءَ ".
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আজকে আমার নিকটে এমন একজন ফেরেশতা এসেছিলেন যিনি আগে কখনো আসেননি। এসে তিনি বললেন আপনার এই সন্তান তথা হুসাইন নিহত হবে। আপনি যদি চান তাহলে তার নিহত স্থানের মাটি আপনাকে দেখাতে পারি। এরপর তিনি লাল মাটি বের করে আমাকে দেখালেন ।
মুসনাদে আহমাদ এতোটুকুই এসেছে । আল্লামা শোয়াইব অরনাউত বলেছেন, হাদীসটি বিভিন্ন শাহেদের কারণে হাসান। যদিও এই সনদটিতে বিচ্ছিন্নতা আছে। শেখ আলবানিও হাসান বলেছেন। [সিলসিলা সহিহা, ৮২২ নং হাদীসের তাহকীক]
কিন্তু পরের অংশটি অর্থাৎ হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর শাহাদাতের দিন কাঁচের পাত্রে সংরক্ষিত কারবালার মাটি লাল বর্ণ ধারণ করল এবং তা দেখে উম্মে সালামা চিৎকার করে উঠলেন- অংশটুকু বর্ণিত হয়েছে ইমাম হাইসামির মাজমাউয যাওয়ায়েদে' ৯/১৯২ । শেখ আলবানী এই অংশটুকু কে মাউজু তথা জাল বলেছেন । এ ব্যাপারে মুহাদ্দিসদের বক্তব্য হলো, হাদীসটি দুর্বল, দলিলযোগ্য নয় । কারণ হাদিসের মাদারুল ইসলাম (مدار الإسناد) বা যাকে কেন্দ্র করে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে তার নাম আমর বিন সাবেত । তার ব্যাপারে মুহাদ্দিসদের ঐক্যমত হলো, সে গ্রহণযোগ্য নয় । যেমন,
১. ইয়াহিয়া বিন মাইন বলেন,
ليس بثقة ولا مأمون
সে নির্ভরযোগ্য নয়, বিশ্বস্ত নয় ।
২. আবু যুরআ বলেন,
ضعيف الحديث
দুর্বল রাবি ।
[তাহাযীবুল কামাল, ৮/৯]
৩. আব্দুল্লাহ বিন মোবারক বলেন,
لا تحدثوا عن عمرو بن ثابت فإنه كان يسب السلف
তোমরা আমর বিন সাবেত থেকে হাদীস বর্ণনা করিও না কেননা সে সালাফদের গালি দিত ।
৪. ইমাম বুখারী বলেন,
ليس بالقوي عندهم
সে মুহাদ্দিসদের নিকটে শক্তিশালী নয় ।
৫. আবু দাউদ বলেন,
رافضي خبيث
সে রাফিজি নিকৃষ্ট ।
৬. ইবনু হিব্বান বলেন,
يروي الموضوعات عن الأثبات
সে নির্ভরযোগ্য রাবিদের থেকে বানোয়াট হাদিস বর্ণনা করে।
৭. ইমাম ইজলি বলেন,
شديد التشيع غال فيه واهي في الحديث
কঠোর শিয়া، হাদিসের ক্ষেত্রে সন্দেহযুক্ত রাবি ।
[তাহযীবুল কামাল, ২১/৫৫৪-৫৫৮]
৮ . ইবনু হিব্বান বলেন,
عمرو بن ثابت بن هرمز الكوفي كنيته أبو ثابت وهو الذي يقال له بن أبي المقدام يروي عن أبيه روى عنه العراقيون مات سنة ثنتين وسبعين وقد قيل سنة سبعين ومائة كان ممن يروي الموضوعات لا يحل ذكره إلا على سبيل الاعتبار
আমোর বিন সাবেত বিন হুর্মুজ আল কুফি । উপনাম আবু সাবেত । তাকে আবু মিকদামও বলা হয় । তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, ইরাকবাসী তার থেকে বর্ণনা করে । ৭২ কিংবা ১৭০ হিজরীতে মারা যান । বানোয়াট হাদিস বর্ণনা করেন । সতর্ক করা ছাড়া তাকে উল্লেখ করা যাবে না ।
[কিতাবুল মাজরুহীন, ২/৭৬]
সুতরাং উম্মে সালামার কারুরা তথা কাঁচের পাত্র সংক্রান্ত উল্লিখিত হাদিসটিও সর্বসম্মতক্রমে বাতিল, অগ্রহণযোগ্য ।
উপরন্ত, শোক প্রকাশের ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
لَا يَحِلُّ لِامْرَأَةٍ تُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ أَنْ تُحِدَّ عَلَى مَيِّتٍ فَوْقَ ثَلَاثِ لَيَالٍ، إِلَّا عَلَى زَوْجٍ أَرْبَعَةَ أَشْهُرٍ وَعَشْرًا
আল্লাহ এবং আখেরাতকে বিশ্বাস করে এমন মেয়ে মানুষের জন্য মৃত ব্যক্তি উপলক্ষে তিন দিনের বেশি শোক পালন জায়েজ নয়, তবে স্বামী মারা গেলে চার মাস দশ দিন শোক পালন করতে পারবে ।
[সহিহুল বুখারী, হা. নং: ৫৩৩৬, ৫৩৩৭, সহীহ মুসলিম, হা.নং: ১৪৮৬, ১৪৮৮, সুনানে আবু দাউদ, হা. নং: ২২৯৯]
এখানে লক্ষ্যনীয় যে, শোক পালনের বিধানটি কেবল মহিলাদের জন্যই নির্দিষ্ট । তাদের নিকটাত্মীয় কেউ মারা গেলে তিন দিন শোক পালন করতে পারবে এবং স্বামী মারা গেলে চার মাস দশ দিন শোক পালন করতে হবে । একটি মু'জাল (দুর্বল) হাদিসে এসেছে পিতা মারা গেলে সাত দিন শোক পালন করতে পারবে । তবে কোথাও পুরুষ মানুষকে শোক পালন করতে হবে মর্মে বর্ণিত হয়নি । কাজেই পুরুষের শোক পালনের কোনো বিধান নেই । শোক পালন কেবল মহিলাদের জন্যই । এটা তাদের সৃষ্টিগত দুর্বলতা এবং মানসিক অস্থিরতা অত্যধিক হওয়ার কারণেই । শোক পালন করতে না পারার অর্থ মোটেও এই নয় যে, দুঃখই না পাওয়া । বরং নিকটাত্মীয় মারা গেলে অথবা উম্মাহর গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তি মারা গেলে মুসলিম হিসেবে অবশ্যই আমরা দুঃখ পাবো । কিন্তু ইসলামের শোক পালনের যে বিধান তথা সৌন্দর্য গ্রহণ না করা, সুগন্ধি গ্রহণ না করা, প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের না হওয়া ইত্যাদি বিধান পুরুষদের জন্য নয়, তা কেবল মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট । [ফাতাওয়া শাইখ বিন বায]
তাহলে প্রথমত, শিয়ারা কিভাবে হাজার বছর পরেও হোসাইন রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর শোক পালনের নামে বিধর্মীদের কর্মকান্ড ও উৎসব পবিত্র মনে করে পালন করে?
দ্বিতীয়ত, শোক যদি পালন করতেই হয় তাহলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য শোক পালন করা হয় না কেন? অথচ তার মৃত্যুতে হাসান বিন সাবেত রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছিলেন,
وما فقد الماضون مثل محمد
ولا مثله حتى القيامة يفقد
অতীতের কেউ মুহাম্মাদের মতো কাউকে হারায়নি । কেয়ামত পর্যন্ত তার মত কাউকে হারাতে হবে না ।
তৃতীয়ত, ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহা, আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহুর জন্য তারা কেন কোনো শোক পালন করে না? এটা কি স্ববিরোধী অবস্থান নয়?
অথচ আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকেও খারিজী আব্দুর রহমান বিন মুলজিম শহীদ করেছে । হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহুকেও বিষপান করে হত্যা করা হয়েছে । শোক পালন করতে হলে প্রথমত তাদের জন্য পালন করা উচিত ।
দ্বিতীয় বিষয় : তাজিয়া মিছিলের ইতিহাস
শিয়ারা দশই মহররম হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর শোক পালনের জন্য সকলেই মিলে যে মিছিল বের করে, প্রতিকী ঘোড়া সাজায়, রাস্তায় রাস্তায় প্রদর্শন করে, ঢোল তবলা বাজিয়ে মাতম করে এগুলোর ইতিহাস জানা দরকার ।
তাজিয়া মিছিল ও মাতমের যে চিত্র আমরা অবলোকন করছি তা ঐতিহাসিকভাবে চারটি পর্যায় অতিক্রম করে বর্তমান পর্যন্ত পৌঁছেছে ।
প্রথম পর্যায় :
আব্বাসীয় খলিফা আল মুতি লিল্লাহর আমলে ৩৩৪ হিজরিতে শিয়া রাজনীতিবিদ মুইজুদ্দৌলা বাগদাদে বুয়াইহিয়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। পরে ইরাক এবং ইরানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলেও তারা তাদের রাজ্য বিস্তার করে। নিঃসন্দেহে এটি ছিল আব্বাসীয় খেলাফতের পিঠে ছুরি মেরে নতুন একটি রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়া। এই রাষ্ট্রটি শিয়া ধর্ম মতের উপরে প্রতিষ্ঠিত ছিল। মেয়াদকাল ছিল ৩৩৪ থেকে ৪৪৭ হিজরী পর্যন্ত। এই সময়েই ৩৫২ হিজরীতে মুইজুদ্দৌলা ব্যাপক লোকসমাগম করে ১০ই মুহররম তাজিয়া মিছিল বের করে। ইতিহাসের কিতাবগুলোতে এর আকর্ষণীয় বর্ণনা দেয়া আছে। তার নির্দেশ মোতাবেক বাজারের দোকানপাট বন্ধ করা হতো, মহিলাদেরকে বের হতে নির্দেশ দেয়া হতো, রাস্তায় বিলাপ করার, নিজের গালে এবং শরীরে আঘাত করার এবং কাপড় ছিড়ে ফেলার নির্দেশ দেয়া হতো। এ সময় শিয়াদের আধিপত্য এত বেশি ছিল যে সুন্নিরা মুখ বুঁজে সব সহ্য করতো । তাজিয়া মিছিল এই সময় থেকেই শুরু হয়। এবং শুরু থেকেই সেটি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেতে থাকে।
দ্বিতীয় পর্যায় :
ওবায়দিয়ারা মরক্কোয় ২৯৮ থেকে ৩৬১ পর্যন্ত শাসনকার্য চালায়। এরপর সেখান থেকে চলে আসে মিশরে। মিশরে ৩৬২ হিজরীতে শিয়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। যারা নিজেদেরকে ফাতিমি শিয়া বলে পরিচয় দেয়। আসলে তারা ওবায়দিয়া। বাগদাদের দেখাদেখি মিশরেও ৩৬২ এর পরে তাজিয়া মিছিল আয়োজন করা হয় । ব্যাপক লোকসমাগম করে কায়রোতে হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর শোক প্রকাশ করা হয় । সুলতানের পক্ষ থেকে লোকদেরকে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়, গরিব দুঃখী মানুষকে অকাতরে দান করা হয় । অন্যদিকে যুবকেরা শোক প্রকাশের নিমিত্তে আজগুবি আজগুবি খেলাধুলা আবিষ্কার করে । এভাবে তারা হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর শোক প্রকাশ করে । অন্যদিকে সিরিয়ার আলেপ্পোতে ৩৩৩ হিজরিতে হামদানিরা ক্ষমতা দখল করে । তারাও ছিল শিয়া বংশোদ্ভুত । মিশর ও বাগদাদের দেখাদেখি আলেপ্পোতেও ১০ই মহররম ব্যাপক জাঁকজমকের সাথে তাজিয়া মিছিলের আয়োজন করা হয়। মোটকথা, হিজরী চতুর্থ শতাব্দী আব্বাসীয় খেলাফতের জন্য অত্যন্ত পীড়াদায়ক ছিল । তারা শিয়াদেরকে রাজনীতিতে এনে রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে যে মারাত্মক ভুল করেছিলেন তার খেসারত দিতে হয়েছে বাগদাদ, মিশর, বাহরাইন, এবং আলেপ্পোতে । এসব অঞ্চলে যথাক্রমে বুআইহিয়া, ওবায়দিয়া, কারামতিয়া এবং হামদানিরা স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে এবং শিয়া ধর্মমত প্রচার করে । তাজিয়া মিছিল এই সময়েই ব্যাপকভাবে সারা ফেলে এবং শিয়ারা এটাকে দ্বীনের অংশ মনে করে। ৪৪৭ হিজরীতে বুয়াইহিয়াদের ক্ষমতা শেষ হলে ইরাকে তাজিয়া মিছিল বন্ধ হয় । আলেপ্পোতে হামদানিদের ক্ষমতা ৩৯৪ হিজরীতে শেষ হয় এবং তাজিয়া মিছিল বন্ধ হয় । ৫৬৭ হিজরিতে মিশরে উবাইদিয়ারা পরাজিত হলে সেখানেও তা বন্ধ হয় । ৩৮১ হিজরীতে আব্বাসীয় খলিফা আল কাদের বিল্লাহ ক্ষমতা ক্ষমতায় আরোহন করে শিয়াদের দৌরাত্ম কমিয়ে ফেলেন । তিনি খেলাফতের শৌর্য বীর্য ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। শিয়ারা দুর্বল হতে থাকে । অতঃপর সেলজুকরা ক্ষমতায় আসলে (৪৪৭-৬৫৬) শিয়ারা আরো বেশি দুর্বল হয়। সেলজুকরা ছিল সুন্নি। তারা সুন্নি এবং সুন্নি ওলামায়ে কেরামের পৃষ্ঠপোষকতা করত। তাদের ক্ষমতারোহনের পড়ই বুয়াইহিয়ারা দুর্বল হতে থাকে। শিয়া ধর্মমতের অগ্রযাত্রা থেমে যায়। আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের সঠিক মতাদর্শ শান্তিপূর্ণভাবে প্রচারিত হতে থাকে।
তৃতীয় পর্যায়ে :
সাফাবি সাম্রাজ্যের আমলে (১৫০১- ১৭৩৬)। মুঘলদের প্রতিষ্ঠিত ইলখানিয়া সাম্রাজ্যের পতনের পর বিভিন্ন ছোট ছোট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এগুলোর মধ্যে এসেছিল তৈমুরী সাম্রাজ্য (১৩৭০- ১৫০৬) অন্যতম। ১৫০১ সালের পড়ে তৈমুরি সাম্রাজ্য দুর্বল হতে থাকে। এ সময়ে তুর্কি বংশোদ্ভুত শিয়া আলেম সফিউদ্দিন বিন ইসহাক আরদিবিলী (৬৫০- ৭৩৫) শিয়া ধর্মমত প্রচার করতে থাকেন। পরবর্তীতে তার পঞ্চম অধঃস্তন পুরুষ ইসমাইল প্রথম ১৫০১ সালে আজারবাইজানের শাসন ক্ষমতা দখল করেন। এরপর ইরান, ইরাক, আরমেনিয়া, জর্জিয়া, তুর্কমেনিস্তান, আফগানিস্তান, বাহরাইন এবং মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে সাফাবি সাম্রাজ্য গঠন করেন। এই সাম্রাজ্য শিয়া ধর্মমত প্রচারের জন্য উঠে পড়ে লেগে যায়। তাজিয়া মিছিল নতুন প্রাণ ফিরে পায়, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায়। সুন্নী আলেমদেরকে হত্যা করা হয়। বিশেষ করে ইসমাইল প্রথম (১৫০১-১৫২৪), এবং আব্বাস প্রথমের আমলে (১৫৮৭-১৬২৯) তাজিয়া মিছিল ব্যাপক আকারে আয়োজন করা হয়। মহররম উপলক্ষে কবিতার আসর, শোকের আসর, মিছিল, খাবার বিতরণ, মাতম, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে আঘাত, কাপড় ছিঁড়ে ফেলা, শরীরকে রক্তাক্ত করা, হায় হোসাইন হায় হোসাইন বলে চিৎকার করা তাজিয়া মিছিলের আবশ্যকীয় অনুষঙ্গ হয়ে পড়ে। উল্লেখ্য, উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতানগণ শিয়াদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান না নিলে পুরো মধ্যপ্রাচ্য শিয়া ধর্মমতে ছেয়ে যেত। শিয়ারা যেমন সুন্নী আলেমদের হত্যা করা শুরু করে, তাদের উপরে অমানবিক নির্যাতন করে, তেমনি উসমানীয় সুলতানরা সুন্নিদের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। আর এ শিয়াদের কারণেই উসমানীয়রা অভ্যন্তরীণভাবে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হন। এবং বলা চলে শিয়াদের কারণেই উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন অনেকটা ত্বরান্বিত হয়। মোটকথা, এসময় তাজিয়া মিছিল ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। পরবর্তীতে শিয়া আলেমরা এর স্বপক্ষে লেখালেখি করতে থাকে। তাজিয়া মিছিল একটি আবশ্যকীয় ধর্মীয় ইবাদতে পরিণত হয় এবং রাষ্ট্র এর জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। ১৭৩৬ সালের পরে সাফাবি সাম্রাজ্য ধ্বংস হলে ইরান সহ সাফাবি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোতে সুন্নিগণ সুন্নি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। ফলে তাযিয়া মিছিল আবারও জৌলুস হারায়।
চতুর্থ পর্যায় বা আধুনিক পর্যায় :
১৯৭৯ সালে শাহ বংশের শেষ শাহ রেজা শাহ পহলবীর পতনের পর ইরানে শিয়া বিপ্লব হয়। শিয়ারা সুন্নিদেরকে তাড়িয়ে দিয়ে আবারো ইরানের ক্ষমতা দখল করে। আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের নিয়ম নীতির কারণে শিয়ারা ইরানের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করে। এরপর শিয়া ধর্মকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া হয়। শুধু তাই নয় রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরে শিয়া ধর্মকে বাধ্যবাধকতা করা হয়। এরই ফলে তাজিয়া মিছিল আবারো নতুন করে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ব্যাপক জাঁকজমকের সাথে পালিত হয়। ইরানের সরকার এর জন্য সার্বিক সহযোগিতা করে।
উপমহাদেশে তাযিয়া মিছিল :
উপমহাদেশে কখন থেকে তাজিয়া মিছিলের প্রবর্তন হয়, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। বাংলাদেশে মুগল আমলে বিশেষত শাহ সুজা (১৬৩৯-১৬৫৯) বাংলার সুবেদার থাকাকালে শিয়াদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। সম্ভবত তখনই এখানে তাজিয়া মিছিলের প্রচলন হয়। বাদশা আকবরের আমলে আগ্রা দুর্গ থেকে তাজিয়া বের হতো যা মুগল তাজিয়া নামে অবহিত হয়েছে। শাহ সুজার সময়ে সৈয়দ মীর মুরাদ ১০৫২ হিজরি সনে (১৬৪২ খ্রি.) ঢাকার ঐতিহাসিক হোসেনী দালান নির্মাণ করেন। ঢাকার নায়েব-নাজিমদের অধিকাংশ ছিলেন শিয়া। তাঁদের দ্বারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ইমামবারা নির্মিত হয়। ঢাকা, মানিকগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, অষ্টগ্রাম, সৈয়দপুর, সিলেট ইত্যাদি স্থানে ইমামবারা আছে। [সূত্র: উইকিপিডিয়া]
মাতমের বৈঠকের রুকুন :
মুহাররম উপলক্ষে শিয়ারা মাতম বৈঠকের বিশেষ আয়োজন করে থাকে। সেখানে হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং কারবালার মর্মান্তিক কাহিনী আকর্ষণীয় পদ্ধতিতে শ্রোতাদের নিকটে পেশ করা হয়। মাতম বৈঠকের রুকন ছয়টি :
১. ভূমিকা
২. কবিতা পাঠ । কবিতা বা কাসীদায় কারবালার মর্মান্তিক কাহিনী, আহলে বাইতের মর্যাদা এবং শিয়া আলিমদের ত্যাগ সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়।
৩. নির্ধারিত বিষয়ের উপর বক্তব্য। কাসিদা পাঠের পরে যে- কোনো একটি বিষয়ের উপরে বক্তা সাহেব বক্তব্য প্রদান করে। তবে এক্ষেত্রে শর্ত হলো, সেই বক্তব্য যেন আকর্ষণীয় হয় ও নতুনত্বে ভরা থাকে। বক্তব্যে উচ্চাঙ্গের সাহিত্য ব্যবহার করে শ্রোতার মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়।
৪. রতব- গুরিয । এর অর্থ হল বক্তব্য দিতে দিতে এমন অবস্থার সৃষ্টি করা যেন শ্রোতারা বেহুশের পর্যায়ে চলে যায়। এই বিশেষ অবস্থা সৃষ্টির উদ্দেশ্য হলো, যেন সবাই কারবালার মুসিবতের কথা স্মরণ করে ব্যথিত হয়।
৫. মুসিবা। এ পর্যায়ে সকলেই কান্না শুরু করে, বেহুশ হয়ে পড়ে, হায় হোসাইন হায় হোসাইন বলতে বলতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মোটকথা, সে নিজেকে একজন কারবালার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে চিন্তা করে এবং ব্যথায় কাতর হয়ে পড়ে। মাতমের অনুষ্ঠানের এটিই মূল লক্ষ্য।
৬. দোয়া। সর্বশেষে দোয়া পাঠের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষনা করা হয়।
তাজিয়া মিছিল এবং রাসুলের একটি হাদিস :
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
لا تقومُ الساعةَ حتى تلحق قبائلٌ من أمّتي بالمشركينَ ، وحتى يُعْبَدَوا الأوثانُ
ততদিন পর্যন্ত কেয়ামত হবে না যতদিন না আমার উম্মতের কতিপয় দল মুশরিকদের সাথে মিলে যাবে এবং মূর্তিপূজা করবে। [সুনানে তিরমিজি, হা.নং: ২২১৯]
অর্থাৎ তাদের এবাদত- বন্দেগী, আচার- অনুষ্ঠান, শিরকি কর্মকান্ড এবং এদের শিরকি কর্মকান্ড একই রকম হবে। এই হাদিসের বাস্তব প্রতিফলন হলো তাজিয়া মিছিল। তাজিয়া মিছিল দেখলে এটা কি দুর্গাপূজা, রথযাত্রা নাকি হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর শোক পালন তা পার্থক্য করার কোনো উপায় নাই।
আল্লাহ তালা তাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন এবং আমাদেরকে তাদের সকল ষড়যন্ত্র থেকে হেফাজত করুন- আমীন ।
তানযীল আহমাদ
মিরপুর, ঢাকা ।
৯ই মুহাররম ১৪৪৫
২৭ জুলাই ২০২৩ ।