brand-image

আশুরায়ে মুহাররাম : করণীয় ও বর্জনীয়

401689225664.jpg

◈ ◈ ◈ আশুরায়ে মুহাররাম : করণীয় ও বর্জনীয় ◈ ◈ ◈

একদিকে জ্ঞানের স্বল্পতা অন্যদিকে মীর মোশাররফ হোসেন এর সাহিত্যরসে সমৃদ্ধ অথচ ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক রসদে পূর্ণ বিখ্যাত উপন্যাস 'বিষাদ সিন্ধু'র ব্যাপক জনপ্রিয়তার কল্যাণে ভারত উপমহাদেশের মুসলিমগণ ১০ই মুহাররামকে কেবল কারবালার মর্মান্তিক ইতিহাস হিসেবেই জানে। এ অঞ্চলে শীআদের সংখ্যা কম হলেও ওইদিনে সর্বত্র হুসাইন (রা.) এর শহীদ হওয়ার যে মর্মান্তিক ও হৃদয়স্পর্শী আলোচনা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ও পুলিশী প্রহরায় শোক মিছিলসহ নানা অনুষ্ঠান সাধারণ মানুষের কোমল হৃদয়ে দাগ কেটেছে। উপরন্তু, সুন্নী মুসলিমদের মধ্যেও বেশ কিছু ভণ্ড পীর-মুরীদ ও মাজারীরা এ দিনটাতে তাদের মাজার-খানকা দরবারী আয়োজনে উৎসবমুখর করে তোলে। ফলে অনেকেই এটাকে এখন ধর্মীয় একটি অনুষ্ঠান হিসেবেই বিবেচনা করে থাকে। এমতাবস্থায়, আগুরা বা ১০ই মুহাররাম কী? তা সর্বসাধারণকে জানানো আমাদের ঈমানী দাবী বলে মনে করছি।
مُحَرَّم(মুহাররাম) হিজরী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। চারটি পবিত্র মাসের মধ্যে এটি একটি (সহীহুল বুখারী: ৩১৯৭)। মুহাররাম শব্দটি "আরবী, যার অর্থ পবিত্র, সম্মানিত। প্রাচীনকাল থেকে এ মাসটি পবিত্র মাস হিসেবে গণ্য। অনুরূপ, عَاشُوْرَاء শব্দটিও আরবি, যার অর্থ দশমী বা ১০ম দিন। বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন মুহাররামের ১০ম তারিখকে আশুরা বলা হয়ে থাকে।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নাবী কারীম (সা.) যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় আসলেন তখন মদীনার ইহুদীদেরকে আশুরার সওম রাখতে দেখে তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা এদিনে কেন সওম রাখ"? উত্তরে তারা বলল, এ দিনটা অত্যন্ত পবিত্র ও সম্মানিত। কেননা, এই দিনে আল্লাহ তাআলা মূসা (আ) ও বানী ইসরাঈলকে ফেরআউনের কবল হতে পরিত্রাণ দিয়েছিলেন। এ কারণে আমরা সওমের মাধ্যমে ঈদ বা খুশি পালন করি, যেন তার স্মরণ সবসময় বিদ্যমান থাকে। রাসূলুল্লাহ বললেন, “মূসা (আ)-এর বিজয়ের দিন পালনে আমরা তোমাদের থেকে বেশী হকদার।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ নিজে সওম রাখলেন এবং সাহাবায়ে কিরামকে সপ্তম রাখার নির্দেশ দিলেন। (সহীহুল বুখারী: ২০০৪, ৩৩৯৭ ও সহীহ মুসলিম: ১১৩০)

📃 আশুরার সওয়ের সীলত:

১. আশুরার সওম ফির'আউনের কবল থেকে মূসা (আ) এর নাজাতের শুকরিয়া হিসেবে পালিত হয়।
২. এই সওম মূসা (আ) ও মুহাম্মাদী শরী'আতে চালু ছিল। আইয়ামে জাহেলিয়াতেও আশুরার সওম পালিত হত। (সহীহুল বুখারী: ২০০২)
৩. ২য় হিজরীতে রমাযানের সওম ফরয হওয়ার আগ পর্যন্ত এই সওম সকল মুসলিমের জন্য পালনীয় নিয়মিত সপ্তম হিসেবে গণ্য হত। ৪. এই সওমের ফযীলত হিসেবে বিগত এক বছরের গোনাহ মাফের কথা বলা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম: ১১৬২)
৫. এ ছাড়াও রমাযানের সপ্তমের পর মুহাররামের সওমকে শ্রেষ্ঠ সওম হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম: ১১৬৩)

📃 আশুরার প্রচলিত বিদ'আতসমূহ, যা বর্জন করতেই হবে

আশুরা উপলক্ষে মুসলিম দাবীদার ভ্রান্ত একটি দল শী'আ ও তাদের দ্বারা প্রভাবিত কতিপয় সুন্নী মিলে অগণিত শিরকী ও বিদ'আতী কর্মে লিপ্ত হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে কোটি টাকার অপচয় করা হয়। সরকারিভাবেও বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালিত হয়। মূসা (আ) এর খুশির বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ রাসূলের (সা.) সাওম পালনের এ দিনটিতে ৬১ হিজরীতে কাকতালীয়ভাবে তাঁর দৌহিত্র হুসাইন (রা.) শাহাদাত বরণ করেন। পরবর্তীকালে (৩৫২ হিজরীতে) শী'আ শাসক আহমাদ বিন বুইয়া দায়লামী ওরফে "মুইযযুদ্দৌলা" ১০ মুহাররামকে শোক দিবস ঘোষণা করে। এদিনে শীআদের অন্যতম কর্মসূচি হলো তাষিয়া প্রদর্শন করা। যার অর্থ-শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করা। তবে বিশেষ অর্থে শব্দটি হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত লাভের বিষাদময় স্মৃতিকে স্মরণ করে শী'আ সম্প্রদায়ের ওই দিনে তাঁর সমাধির প্রতীক বানিয়ে সেটা নিয়ে মিছিল করে শোক প্রকাশ করাকে বুঝায়। শী'আ মতবাদের উদ্ভব ইরাক ও ইরানে হলেও সেখানে এরূপ শোকমিছিলে তাযিয়া বহন করা হয় না। বাংলাদেশে মুঘল আমলে বিশেষত শাহ্ সুজা (১৬৩৯-১৬৫৯) বাংলার সুবেদার থাকাকালে শী'আদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। সম্ভবত, তখনই এখানে তাযিয়া মিছিলের প্রচলন হয়। [বাংলা পিডিয়া]
এভাবে তাষিয়ার নামে হুসাইন (রা.) এর ভুয়া ও বানোয়াট কবর তৈরি করে আমাদের দেশে প্রতিবছর রাজধানীসহ প্রায় প্রতিটি জেলার রাজপথে শোক মিছিল করা হয়। ঐ ভূয়া কবরে হুসাইনের রূহ হাযির হয়, ধারণা করে তাকে সালাম করা হয়। তার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে সিজদাহ করা হয়, মনোবাঞ্ছা পূরণ করার জন্য প্রার্থনা করা হয়। বুক চাপড়ানো হয়, বুকের কাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয়। “হায় হোসেন, হায় হোসেন” বলে মাতম করা হয়। লোহার শিকল ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে পেট ও পিঠে অনবরত আঘাত করে সারা শরীর রক্তাক্ত করা হয়। শিশুদের মাথায় আঘাত করে লাল রক্তে রঞ্জিত করা হয়।
আবার কোথাও কোথাও রক্তের নামে লাল রং ছিটানো হয়। রাস্তা-ঘাট রঙ-বেরঙের সাজে সাজানো হয়। হুসাইন (রা.) এর নামে “হাঁস/মোরগ পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে যুবক-যুবতীরা পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঐ বরকতের মোরগ ধরার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। সুসজ্জিত অশ্বারোহী দল লাঠি-তীর-বল্লম নিয়ে মিছিল করে কারবালা যুদ্ধের মহড়া দেয়। কালো পোষাক পরিধান বা কালো ব্যাজ ধারণ করে মিছিলের সম্মুখভাগে নারীরাও অংশ নেয়। আবার অনেকে শোকের মাস ভেবে এই মাসে বিয়ে-শাদী করা অন্যায় মনে করে। ঐ দিন অনেকে পানি পান করা এমনকি শিশুকে দুধ পান করানোও অন্যায় ভাবে।
অপরদিকে, উগ্র শী'আরা আয়েশা (রা.) এর নামে বেঁধে রাখা একটি বকরীকে লাঠিপেটা করে ও অস্ত্রাঘাতে রক্তাক্ত করে বদলা নেয় ও উল্লাসে ফেটে পড়ে। তাদের ধারণা- রাসূলের ইন্তিকালের পর আলী (রা.) খলীফা হতে পারেননি আয়েশা (রা) এর ষড়যন্ত্রের কারণে (নাউযুবিল্লাহ!)। একইভাবে ওমর, উসমান, মুআবিয়া, মুগীরা বিন শু'বা রাযিয়াল্লাহু 'আনহুম প্রমুখ সম্মানিত সাহাবীদেরকে এসময় বিভিন্নভাবে গালি দেওয়া হয়। এ ছাড়াও রেডিও-টিভি, পত্র-পত্রিকা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একথা বুঝানোর চেষ্টা করা হয় যে, আশুরায়ে মুহাররামের মূলবিষয় হল- ‘শাহাদাতে হুসাইন' (রা.) বা 'কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা' । অথচ প্রকৃত সত্য এসব থেকে অনেক দূরে।
আশুরা উপলক্ষে প্রচলিত উপর্যুক্ত বিদ'আতী অনুষ্ঠানাদির কোন অস্তিত্ব কিংবা শী'আ আক্বীদা কোন প্রমাণ সাহাবায়ে কেরামের যুগে পাওয়া যায় না। আল্লাহ ব্যতীত কাউকে সিজদা করা যেমন হারাম, তাযিয়ার নামে ভূয়া কবর যিয়ারত করাও তেমনি হারাম। এতদ্ব্যতীত কোনরূপ শোকগাঁথা বা মর্সিয়া অনুষ্ঠান বা শোকমিছিল ইসলামী শরী আর পরিপন্থী । কোন কবর বা সমাধিসৌধ, শহীদ মিনার বা স্মৃতিসৌধ, শিখা অনির্বাণ বা শিখা চিরন্তন প্রভৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করাও একই পর্যায়ে পড়ে।
অনুরূপভাবে সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহ হল সাহাবায়ে কেরামকে গালি দেওয়া। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “তোমরা আমার সাহাবীগণকে গালি দিয়ো না। কেননা (তাঁরা এমন উচ্চ মর্যাদার অধিকারী যে) তোমাদের কেউ যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, তবুও তাঁদের এক মুদ বা অর্ধ মুদ [১ মুদ= আনুমানিক ৬২৫ গ্রাম]-এর সমান সাওয়াব পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না” । (সহীহুল বুখারী: ৩৬৭৩ ও সহীহ মুসলিম: ২৫৪১)
তাছাড়া শোকের নামে দিবস পালন করা, বুক চাপড়ানো ও মাতম করা ইসলামী রীতি নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে শোকে কাতর হয়ে নিজ মুখে আঘাত করে, কাপড় ছিড়ে ফেলে ও জাহেলী যুগের মতো মাতম করে” (সহীহুল বুখারী: ১২৯৭ ও সহীহ মুসলিম: ১০৩)। অধিকন্তু, ঐসব শোকসভা বা শোক মিছিলে বাড়াবাড়ি করে সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তার পার্থক্য ভুলে হুসাইনের কবরে রূহের আগমন কল্পনা করা, সেখানে সিজদা করা, মাথা ঝুঁকানো, প্রার্থনা নিবেদন করা ইত্যাদি
পরিষ্কারভাবে শিরকের নামান্তর।

📃 আশুরায় আমাদের করণীয়

আশুরা উপলক্ষ্যে মুহাররামের ৯ ও ১০ তারিখ সওম পালন ছাড়া অন্য বিশেষ কোন ইবাদত নেই। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যখন আশুরার দিন সওম পালন করেন এবং লোকদেরকে সওম পালনের নির্দেশ দেন, তখন সাহাবীগণ বললেন, হে রাসূল (সা.) ! ইয়াহুদ এবং নাসারা এ দিনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ইন্‌শা আল্লাহ আগামী বছর আমরা ৯ তারিখেও সওম পালন করব । বর্ণনাকারী বলেন, , আগামী বছর আসার আগেই রাসূলুল্লাহ (সা.) মৃত্যু বরণ করেন । (সহীহ মুসলিম: ১১৩৪ ও ১৯১৬)
তবে হুসাইন (রা.) সহ সকল মৃত মুসলিমের জন্য 'আমভাবে দু'আ করা দূষণীয় নয় । সালাফগণ হুসাইন এর মর্মান্তিক মৃত্যুতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন । কিন্তু তাতে বাড়াবাড়ি করে শী'আদের ন্যায় ঐদিনকে শোক দিবস মনে করেন না। দুঃখ প্রকাশের ইসলামী রীতি হল: “ইন্না লিল্লা-হি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন' পাঠ করা (বাক্বারাহ ১৫৬) ও তাঁদের মুক্তির জন্য দু'আ করা । একথা সন্দেহাতীত যে, আশুরার সওমের সাথে হুসাইন (রা.) বিন আলী এর জন্ম বা মৃত্যুর কোন সম্পর্ক নেই। হুসাইন (রা.) এর জন্ম মদীনায় ৪র্থ হিজরীতে এবং মৃত্যু ইরাকের কুফা নগরীর নিকটবর্তী কারবালায় ৬১ হিজরীতে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মৃত্যুর ৫০ বছর পর ।
(ইবনু হাজার, আল-ইসাবাহ (২/৬৭-৭২, জীবনী: ১৭২৯)
সুতরাং শাহাদাতে হুসাইনের নিয়্যাতে পূর্ববর্ণিত সকল শিরকী ও বিদ'আতী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হবে এবং অন্যকে বিরত থাকার উপদেশ দিতে হবে। এদিনে সওম পালনকারী শাহাদাতে হুসাইনের নিয়্যাত করলে সওমের সওয়াবও পাবে না; বরং গুনাহগার হবে। কারণ, কারবালার ঘটনার ৫০ বছর পূর্বেই ইসলাম পূর্ণতা লাভ করেছে এবং অহীর আগমনও বন্ধ হয়ে গেছে। বনী ইসরাঈলের অসংখ্য নবী নিজ কওমের লোকদের হাতে নিহত হয়েছেন। মুসলমানদের প্রাণপ্রিয় খলীফা হযরত ওমর (রা.) মসজিদে নববীতে ফজরের সালাতরত অবস্থায়, উসমান ৮৩ বছরের বৃদ্ধ বয়সে নিজ গৃহে কুরআন তিলাওয়াতরত অবস্থায়, হযরত আলী (রা.) ফজরের জামা'আতে যাওয়ার পথে অতর্কিত আক্রান্ত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। হাসান (৩-৪৯হিঃ)-কে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। [আল-বিদায়াহ ৮/৪৪] আশারায়ে মুবাশশারাহর অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব হযরত ত্বালহা ও যুবায়ের মর্মান্তিকভাবে শহীদ হন। তাঁদের কারো মৃত্যু হুসাইন (রা.) -এর মৃত্যুর চাইতে কম দুঃখজনক ও মর্মান্তিক ছিল না। কিন্তু কারো জন্য দিনক্ষণ নির্ধারণ করে মাতম করা ও সরকারি ছুটি ঘোষণা করে শোকদিবস পালন করার কোন রীতি সাহাবী ও তাবেয়ীদের যুগে ছিল না। ইসলামী শরী'আতে এসব নিষিদ্ধ ।
প্রকৃতপক্ষে, এ দিনটি মূসা (আ) ও তাঁর কওমের নাজাতের দিন। দুঃখ-কষ্ট থেকে পরিত্রাণ লাভের পর তাওহীদ ভিত্তিক সুখময় জীবনে পদার্পণের দিন। আল্লাহর শত্রু ফিরআউনের পতনের দিন। অত্যাচারীর করাল গ্রাস থেকে মুমিনের মুক্তির দিন। শত্রুর কবল থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে স্রষ্টার উদ্দেশ্যে মুমিনের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন। এতদভিন্ন অবান্তর কিছু ফযীলত ও শোকের নামে অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত থাকা বাঞ্ছনীয়। উপরন্তু, নবীদের রেখে যাওয়া সুন্নাতকে কোন এক সাহাবীর মৃত্যুর শোক পালনের মাধ্যমে তুচ্ছ করা ঈমানী চেতনারও পরিপন্থী। আল্লাহ আমাদেরকে সকল প্রকার শিরকী ও বিদ'আতী কর্মকাণ্ড থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন।
আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে শুব্বানের দাওয়াতী কাজে অংশ গ্রহণ করুন!
(বিকাশ পার্সোনাল) ০১৭৬৫ ৮১২২৬১
জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীস বাংলাদেশ
৭৯/ক/৩, উত্তর যাত্রাবাড়ি, ঢাকা-১২০৪,
[email protected], www.shubbanbd.org, Facebook: /shubban◈ ◈ ◈ আশুরায়ে মুহাররাম : করণীয় ও বর্জনীয় ◈ ◈ ◈


একদিকে জ্ঞানের স্বল্পতা অন্যদিকে মীর মোশাররফ হোসেন এর সাহিত্যরসে সমৃদ্ধ অথচ ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক রসদে পূর্ণ বিখ্যাত উপন্যাস 'বিষাদ সিন্ধু'র ব্যাপক জনপ্রিয়তার কল্যাণে ভারত উপমহাদেশের মুসলিমগণ ১০ই মুহাররামকে কেবল কারবালার মর্মান্তিক ইতিহাস হিসেবেই জানে। এ অঞ্চলে শীআদের সংখ্যা কম হলেও ওইদিনে সর্বত্র হুসাইন (রা.) এর শহীদ হওয়ার যে মর্মান্তিক ও হৃদয়স্পর্শী আলোচনা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ও পুলিশী প্রহরায় শোক মিছিলসহ নানা অনুষ্ঠান সাধারণ মানুষের কোমল হৃদয়ে দাগ কেটেছে। উপরন্তু, সুন্নী মুসলিমদের মধ্যেও বেশ কিছু ভণ্ড পীর-মুরীদ ও মাজারীরা এ দিনটাতে তাদের মাজার-খানকা দরবারী আয়োজনে উৎসবমুখর করে তোলে। ফলে অনেকেই এটাকে এখন ধর্মীয় একটি অনুষ্ঠান হিসেবেই বিবেচনা করে থাকে। এমতাবস্থায়, আগুরা বা ১০ই মুহাররাম কী? তা সর্বসাধারণকে জানানো আমাদের ঈমানী দাবী বলে মনে করছি।
مُحَرَّم(মুহাররাম) হিজরী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। চারটি পবিত্র মাসের মধ্যে এটি একটি (সহীহুল বুখারী: ৩১৯৭)। মুহাররাম শব্দটি "আরবী, যার অর্থ পবিত্র, সম্মানিত। প্রাচীনকাল থেকে এ মাসটি পবিত্র মাস হিসেবে গণ্য। অনুরূপ, عَاشُوْرَاء শব্দটিও আরবি, যার অর্থ দশমী বা ১০ম দিন। বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন মুহাররামের ১০ম তারিখকে আশুরা বলা হয়ে থাকে।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নাবী কারীম (সা.) যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় আসলেন তখন মদীনার ইহুদীদেরকে আশুরার সওম রাখতে দেখে তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা এদিনে কেন সওম রাখ"? উত্তরে তারা বলল, এ দিনটা অত্যন্ত পবিত্র ও সম্মানিত। কেননা, এই দিনে আল্লাহ তাআলা মূসা (আ) ও বানী ইসরাঈলকে ফেরআউনের কবল হতে পরিত্রাণ দিয়েছিলেন। এ কারণে আমরা সওমের মাধ্যমে ঈদ বা খুশি পালন করি, যেন তার স্মরণ সবসময় বিদ্যমান থাকে। রাসূলুল্লাহ বললেন, “মূসা (আ)-এর বিজয়ের দিন পালনে আমরা তোমাদের থেকে বেশী হকদার।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ নিজে সওম রাখলেন এবং সাহাবায়ে কিরামকে সপ্তম রাখার নির্দেশ দিলেন। (সহীহুল বুখারী: ২০০৪, ৩৩৯৭ ও সহীহ মুসলিম: ১১৩০)

📃 আশুরার সওয়ের সীলত:

১. আশুরার সওম ফির'আউনের কবল থেকে মূসা (আ) এর নাজাতের শুকরিয়া হিসেবে পালিত হয়।
২. এই সওম মূসা (আ) ও মুহাম্মাদী শরী'আতে চালু ছিল। আইয়ামে জাহেলিয়াতেও আশুরার সওম পালিত হত। (সহীহুল বুখারী: ২০০২)
৩. ২য় হিজরীতে রমাযানের সওম ফরয হওয়ার আগ পর্যন্ত এই সওম সকল মুসলিমের জন্য পালনীয় নিয়মিত সপ্তম হিসেবে গণ্য হত। ৪. এই সওমের ফযীলত হিসেবে বিগত এক বছরের গোনাহ মাফের কথা বলা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম: ১১৬২)
৫. এ ছাড়াও রমাযানের সপ্তমের পর মুহাররামের সওমকে শ্রেষ্ঠ সওম হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম: ১১৬৩)

📃 আশুরার প্রচলিত বিদ'আতসমূহ, যা বর্জন করতেই হবে

আশুরা উপলক্ষে মুসলিম দাবীদার ভ্রান্ত একটি দল শী'আ ও তাদের দ্বারা প্রভাবিত কতিপয় সুন্নী মিলে অগণিত শিরকী ও বিদ'আতী কর্মে লিপ্ত হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে কোটি টাকার অপচয় করা হয়। সরকারিভাবেও বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালিত হয়। মূসা (আ) এর খুশির বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ রাসূলের (সা.) সাওম পালনের এ দিনটিতে ৬১ হিজরীতে কাকতালীয়ভাবে তাঁর দৌহিত্র হুসাইন (রা.) শাহাদাত বরণ করেন। পরবর্তীকালে (৩৫২ হিজরীতে) শী'আ শাসক আহমাদ বিন বুইয়া দায়লামী ওরফে "মুইযযুদ্দৌলা" ১০ মুহাররামকে শোক দিবস ঘোষণা করে। এদিনে শীআদের অন্যতম কর্মসূচি হলো তাষিয়া প্রদর্শন করা। যার অর্থ-শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করা। তবে বিশেষ অর্থে শব্দটি হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত লাভের বিষাদময় স্মৃতিকে স্মরণ করে শী'আ সম্প্রদায়ের ওই দিনে তাঁর সমাধির প্রতীক বানিয়ে সেটা নিয়ে মিছিল করে শোক প্রকাশ করাকে বুঝায়। শী'আ মতবাদের উদ্ভব ইরাক ও ইরানে হলেও সেখানে এরূপ শোকমিছিলে তাযিয়া বহন করা হয় না। বাংলাদেশে মুঘল আমলে বিশেষত শাহ্ সুজা (১৬৩৯-১৬৫৯) বাংলার সুবেদার থাকাকালে শী'আদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। সম্ভবত, তখনই এখানে তাযিয়া মিছিলের প্রচলন হয়। [বাংলা পিডিয়া]
এভাবে তাষিয়ার নামে হুসাইন (রা.) এর ভুয়া ও বানোয়াট কবর তৈরি করে আমাদের দেশে প্রতিবছর রাজধানীসহ প্রায় প্রতিটি জেলার রাজপথে শোক মিছিল করা হয়। ঐ ভূয়া কবরে হুসাইনের রূহ হাযির হয়, ধারণা করে তাকে সালাম করা হয়। তার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে সিজদাহ করা হয়, মনোবাঞ্ছা পূরণ করার জন্য প্রার্থনা করা হয়। বুক চাপড়ানো হয়, বুকের কাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয়। “হায় হোসেন, হায় হোসেন” বলে মাতম করা হয়। লোহার শিকল ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে পেট ও পিঠে অনবরত আঘাত করে সারা শরীর রক্তাক্ত করা হয়। শিশুদের মাথায় আঘাত করে লাল রক্তে রঞ্জিত করা হয়।
আবার কোথাও কোথাও রক্তের নামে লাল রং ছিটানো হয়। রাস্তা-ঘাট রঙ-বেরঙের সাজে সাজানো হয়। হুসাইন (রা.) এর নামে “হাঁস/মোরগ পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে যুবক-যুবতীরা পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঐ বরকতের মোরগ ধরার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। সুসজ্জিত অশ্বারোহী দল লাঠি-তীর-বল্লম নিয়ে মিছিল করে কারবালা যুদ্ধের মহড়া দেয়। কালো পোষাক পরিধান বা কালো ব্যাজ ধারণ করে মিছিলের সম্মুখভাগে নারীরাও অংশ নেয়। আবার অনেকে শোকের মাস ভেবে এই মাসে বিয়ে-শাদী করা অন্যায় মনে করে। ঐ দিন অনেকে পানি পান করা এমনকি শিশুকে দুধ পান করানোও অন্যায় ভাবে।
অপরদিকে, উগ্র শী'আরা আয়েশা (রা.) এর নামে বেঁধে রাখা একটি বকরীকে লাঠিপেটা করে ও অস্ত্রাঘাতে রক্তাক্ত করে বদলা নেয় ও উল্লাসে ফেটে পড়ে। তাদের ধারণা- রাসূলের ইন্তিকালের পর আলী (রা.) খলীফা হতে পারেননি আয়েশা (রা) এর ষড়যন্ত্রের কারণে (নাউযুবিল্লাহ!)। একইভাবে ওমর, উসমান, মুআবিয়া, মুগীরা বিন শু'বা রাযিয়াল্লাহু 'আনহুম প্রমুখ সম্মানিত সাহাবীদেরকে এসময় বিভিন্নভাবে গালি দেওয়া হয়। এ ছাড়াও রেডিও-টিভি, পত্র-পত্রিকা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একথা বুঝানোর চেষ্টা করা হয় যে, আশুরায়ে মুহাররামের মূলবিষয় হল- ‘শাহাদাতে হুসাইন' (রা.) বা 'কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা' । অথচ প্রকৃত সত্য এসব থেকে অনেক দূরে।
আশুরা উপলক্ষে প্রচলিত উপর্যুক্ত বিদ'আতী অনুষ্ঠানাদির কোন অস্তিত্ব কিংবা শী'আ আক্বীদা কোন প্রমাণ সাহাবায়ে কেরামের যুগে পাওয়া যায় না। আল্লাহ ব্যতীত কাউকে সিজদা করা যেমন হারাম, তাযিয়ার নামে ভূয়া কবর যিয়ারত করাও তেমনি হারাম। এতদ্ব্যতীত কোনরূপ শোকগাঁথা বা মর্সিয়া অনুষ্ঠান বা শোকমিছিল ইসলামী শরী আর পরিপন্থী । কোন কবর বা সমাধিসৌধ, শহীদ মিনার বা স্মৃতিসৌধ, শিখা অনির্বাণ বা শিখা চিরন্তন প্রভৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করাও একই পর্যায়ে পড়ে।
অনুরূপভাবে সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহ হল সাহাবায়ে কেরামকে গালি দেওয়া। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “তোমরা আমার সাহাবীগণকে গালি দিয়ো না। কেননা (তাঁরা এমন উচ্চ মর্যাদার অধিকারী যে) তোমাদের কেউ যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, তবুও তাঁদের এক মুদ বা অর্ধ মুদ [১ মুদ= আনুমানিক ৬২৫ গ্রাম]-এর সমান সাওয়াব পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না” । (সহীহুল বুখারী: ৩৬৭৩ ও সহীহ মুসলিম: ২৫৪১)
তাছাড়া শোকের নামে দিবস পালন করা, বুক চাপড়ানো ও মাতম করা ইসলামী রীতি নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে শোকে কাতর হয়ে নিজ মুখে আঘাত করে, কাপড় ছিড়ে ফেলে ও জাহেলী যুগের মতো মাতম করে” (সহীহুল বুখারী: ১২৯৭ ও সহীহ মুসলিম: ১০৩)। অধিকন্তু, ঐসব শোকসভা বা শোক মিছিলে বাড়াবাড়ি করে সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তার পার্থক্য ভুলে হুসাইনের কবরে রূহের আগমন কল্পনা করা, সেখানে সিজদা করা, মাথা ঝুঁকানো, প্রার্থনা নিবেদন করা ইত্যাদি
পরিষ্কারভাবে শিরকের নামান্তর।

📃 আশুরায় আমাদের করণীয়

আশুরা উপলক্ষ্যে মুহাররামের ৯ ও ১০ তারিখ সওম পালন ছাড়া অন্য বিশেষ কোন ইবাদত নেই। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যখন আশুরার দিন সওম পালন করেন এবং লোকদেরকে সওম পালনের নির্দেশ দেন, তখন সাহাবীগণ বললেন, হে রাসূল (সা.) ! ইয়াহুদ এবং নাসারা এ দিনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ইন্‌শা আল্লাহ আগামী বছর আমরা ৯ তারিখেও সওম পালন করব । বর্ণনাকারী বলেন, , আগামী বছর আসার আগেই রাসূলুল্লাহ (সা.) মৃত্যু বরণ করেন । (সহীহ মুসলিম: ১১৩৪ ও ১৯১৬)
তবে হুসাইন (রা.) সহ সকল মৃত মুসলিমের জন্য 'আমভাবে দু'আ করা দূষণীয় নয় । সালাফগণ হুসাইন এর মর্মান্তিক মৃত্যুতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন । কিন্তু তাতে বাড়াবাড়ি করে শী'আদের ন্যায় ঐদিনকে শোক দিবস মনে করেন না। দুঃখ প্রকাশের ইসলামী রীতি হল: “ইন্না লিল্লা-হি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন' পাঠ করা (বাক্বারাহ ১৫৬) ও তাঁদের মুক্তির জন্য দু'আ করা । একথা সন্দেহাতীত যে, আশুরার সওমের সাথে হুসাইন (রা.) বিন আলী এর জন্ম বা মৃত্যুর কোন সম্পর্ক নেই। হুসাইন (রা.) এর জন্ম মদীনায় ৪র্থ হিজরীতে এবং মৃত্যু ইরাকের কুফা নগরীর নিকটবর্তী কারবালায় ৬১ হিজরীতে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মৃত্যুর ৫০ বছর পর ।
(ইবনু হাজার, আল-ইসাবাহ (২/৬৭-৭২, জীবনী: ১৭২৯)
সুতরাং শাহাদাতে হুসাইনের নিয়্যাতে পূর্ববর্ণিত সকল শিরকী ও বিদ'আতী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হবে এবং অন্যকে বিরত থাকার উপদেশ দিতে হবে। এদিনে সওম পালনকারী শাহাদাতে হুসাইনের নিয়্যাত করলে সওমের সওয়াবও পাবে না; বরং গুনাহগার হবে। কারণ, কারবালার ঘটনার ৫০ বছর পূর্বেই ইসলাম পূর্ণতা লাভ করেছে এবং অহীর আগমনও বন্ধ হয়ে গেছে। বনী ইসরাঈলের অসংখ্য নবী নিজ কওমের লোকদের হাতে নিহত হয়েছেন। মুসলমানদের প্রাণপ্রিয় খলীফা হযরত ওমর (রা.) মসজিদে নববীতে ফজরের সালাতরত অবস্থায়, উসমান ৮৩ বছরের বৃদ্ধ বয়সে নিজ গৃহে কুরআন তিলাওয়াতরত অবস্থায়, হযরত আলী (রা.) ফজরের জামা'আতে যাওয়ার পথে অতর্কিত আক্রান্ত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। হাসান (৩-৪৯হিঃ)-কে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। [আল-বিদায়াহ ৮/৪৪] আশারায়ে মুবাশশারাহর অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব হযরত ত্বালহা ও যুবায়ের মর্মান্তিকভাবে শহীদ হন। তাঁদের কারো মৃত্যু হুসাইন (রা.) -এর মৃত্যুর চাইতে কম দুঃখজনক ও মর্মান্তিক ছিল না। কিন্তু কারো জন্য দিনক্ষণ নির্ধারণ করে মাতম করা ও সরকারি ছুটি ঘোষণা করে শোকদিবস পালন করার কোন রীতি সাহাবী ও তাবেয়ীদের যুগে ছিল না। ইসলামী শরী'আতে এসব নিষিদ্ধ ।
প্রকৃতপক্ষে, এ দিনটি মূসা (আ) ও তাঁর কওমের নাজাতের দিন। দুঃখ-কষ্ট থেকে পরিত্রাণ লাভের পর তাওহীদ ভিত্তিক সুখময় জীবনে পদার্পণের দিন। আল্লাহর শত্রু ফিরআউনের পতনের দিন। অত্যাচারীর করাল গ্রাস থেকে মুমিনের মুক্তির দিন। শত্রুর কবল থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে স্রষ্টার উদ্দেশ্যে মুমিনের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন। এতদভিন্ন অবান্তর কিছু ফযীলত ও শোকের নামে অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত থাকা বাঞ্ছনীয়। উপরন্তু, নবীদের রেখে যাওয়া সুন্নাতকে কোন এক সাহাবীর মৃত্যুর শোক পালনের মাধ্যমে তুচ্ছ করা ঈমানী চেতনারও পরিপন্থী। আল্লাহ আমাদেরকে সকল প্রকার শিরকী ও বিদ'আতী কর্মকাণ্ড থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন।
আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে শুব্বানের দাওয়াতী কাজে অংশ গ্রহণ করুন!
(বিকাশ পার্সোনাল) ০১৭৬৫ ৮১২২৬১
জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীস বাংলাদেশ
৭৯/ক/৩, উত্তর যাত্রাবাড়ি, ঢাকা-১২০৪,
[email protected], www.shubbanbd.org, Facebook: /shubban◈ ◈ ◈ আশুরায়ে মুহাররাম : করণীয় ও বর্জনীয় ◈ ◈ ◈

একদিকে জ্ঞানের স্বল্পতা অন্যদিকে মীর মোশাররফ হোসেন এর সাহিত্যরসে সমৃদ্ধ অথচ ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক রসদে পূর্ণ বিখ্যাত উপন্যাস 'বিষাদ সিন্ধু'র ব্যাপক জনপ্রিয়তার কল্যাণে ভারত উপমহাদেশের মুসলিমগণ ১০ই মুহাররামকে কেবল কারবালার মর্মান্তিক ইতিহাস হিসেবেই জানে। এ অঞ্চলে শীআদের সংখ্যা কম হলেও ওইদিনে সর্বত্র হুসাইন (রা.) এর শহীদ হওয়ার যে মর্মান্তিক ও হৃদয়স্পর্শী আলোচনা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ও পুলিশী প্রহরায় শোক মিছিলসহ নানা অনুষ্ঠান সাধারণ মানুষের কোমল হৃদয়ে দাগ কেটেছে। উপরন্তু, সুন্নী মুসলিমদের মধ্যেও বেশ কিছু ভণ্ড পীর-মুরীদ ও মাজারীরা এ দিনটাতে তাদের মাজার-খানকা দরবারী আয়োজনে উৎসবমুখর করে তোলে। ফলে অনেকেই এটাকে এখন ধর্মীয় একটি অনুষ্ঠান হিসেবেই বিবেচনা করে থাকে। এমতাবস্থায়, আগুরা বা ১০ই মুহাররাম কী? তা সর্বসাধারণকে জানানো আমাদের ঈমানী দাবী বলে মনে করছি।
مُحَرَّم(মুহাররাম) হিজরী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। চারটি পবিত্র মাসের মধ্যে এটি একটি (সহীহুল বুখারী: ৩১৯৭)। মুহাররাম শব্দটি "আরবী, যার অর্থ পবিত্র, সম্মানিত। প্রাচীনকাল থেকে এ মাসটি পবিত্র মাস হিসেবে গণ্য। অনুরূপ, عَاشُوْرَاء শব্দটিও আরবি, যার অর্থ দশমী বা ১০ম দিন। বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন মুহাররামের ১০ম তারিখকে আশুরা বলা হয়ে থাকে।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নাবী কারীম (সা.) যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় আসলেন তখন মদীনার ইহুদীদেরকে আশুরার সওম রাখতে দেখে তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা এদিনে কেন সওম রাখ"? উত্তরে তারা বলল, এ দিনটা অত্যন্ত পবিত্র ও সম্মানিত। কেননা, এই দিনে আল্লাহ তাআলা মূসা (আ) ও বানী ইসরাঈলকে ফেরআউনের কবল হতে পরিত্রাণ দিয়েছিলেন। এ কারণে আমরা সওমের মাধ্যমে ঈদ বা খুশি পালন করি, যেন তার স্মরণ সবসময় বিদ্যমান থাকে। রাসূলুল্লাহ বললেন, “মূসা (আ)-এর বিজয়ের দিন পালনে আমরা তোমাদের থেকে বেশী হকদার।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ নিজে সওম রাখলেন এবং সাহাবায়ে কিরামকে সপ্তম রাখার নির্দেশ দিলেন। (সহীহুল বুখারী: ২০০৪, ৩৩৯৭ ও সহীহ মুসলিম: ১১৩০)

📃 আশুরার সওয়ের সীলত:

১. আশুরার সওম ফির'আউনের কবল থেকে মূসা (আ) এর নাজাতের শুকরিয়া হিসেবে পালিত হয়।
২. এই সওম মূসা (আ) ও মুহাম্মাদী শরী'আতে চালু ছিল। আইয়ামে জাহেলিয়াতেও আশুরার সওম পালিত হত। (সহীহুল বুখারী: ২০০২)
৩. ২য় হিজরীতে রমাযানের সওম ফরয হওয়ার আগ পর্যন্ত এই সওম সকল মুসলিমের জন্য পালনীয় নিয়মিত সপ্তম হিসেবে গণ্য হত। ৪. এই সওমের ফযীলত হিসেবে বিগত এক বছরের গোনাহ মাফের কথা বলা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম: ১১৬২)
৫. এ ছাড়াও রমাযানের সপ্তমের পর মুহাররামের সওমকে শ্রেষ্ঠ সওম হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম: ১১৬৩)

📃 আশুরার প্রচলিত বিদ'আতসমূহ, যা বর্জন করতেই হবে

আশুরা উপলক্ষে মুসলিম দাবীদার ভ্রান্ত একটি দল শী'আ ও তাদের দ্বারা প্রভাবিত কতিপয় সুন্নী মিলে অগণিত শিরকী ও বিদ'আতী কর্মে লিপ্ত হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে কোটি টাকার অপচয় করা হয়। সরকারিভাবেও বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালিত হয়। মূসা (আ) এর খুশির বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ রাসূলের (সা.) সাওম পালনের এ দিনটিতে ৬১ হিজরীতে কাকতালীয়ভাবে তাঁর দৌহিত্র হুসাইন (রা.) শাহাদাত বরণ করেন। পরবর্তীকালে (৩৫২ হিজরীতে) শী'আ শাসক আহমাদ বিন বুইয়া দায়লামী ওরফে "মুইযযুদ্দৌলা" ১০ মুহাররামকে শোক দিবস ঘোষণা করে। এদিনে শীআদের অন্যতম কর্মসূচি হলো তাষিয়া প্রদর্শন করা। যার অর্থ-শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করা। তবে বিশেষ অর্থে শব্দটি হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত লাভের বিষাদময় স্মৃতিকে স্মরণ করে শী'আ সম্প্রদায়ের ওই দিনে তাঁর সমাধির প্রতীক বানিয়ে সেটা নিয়ে মিছিল করে শোক প্রকাশ করাকে বুঝায়। শী'আ মতবাদের উদ্ভব ইরাক ও ইরানে হলেও সেখানে এরূপ শোকমিছিলে তাযিয়া বহন করা হয় না। বাংলাদেশে মুঘল আমলে বিশেষত শাহ্ সুজা (১৬৩৯-১৬৫৯) বাংলার সুবেদার থাকাকালে শী'আদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। সম্ভবত, তখনই এখানে তাযিয়া মিছিলের প্রচলন হয়। [বাংলা পিডিয়া]
এভাবে তাষিয়ার নামে হুসাইন (রা.) এর ভুয়া ও বানোয়াট কবর তৈরি করে আমাদের দেশে প্রতিবছর রাজধানীসহ প্রায় প্রতিটি জেলার রাজপথে শোক মিছিল করা হয়। ঐ ভূয়া কবরে হুসাইনের রূহ হাযির হয়, ধারণা করে তাকে সালাম করা হয়। তার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে সিজদাহ করা হয়, মনোবাঞ্ছা পূরণ করার জন্য প্রার্থনা করা হয়। বুক চাপড়ানো হয়, বুকের কাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয়। “হায় হোসেন, হায় হোসেন” বলে মাতম করা হয়। লোহার শিকল ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে পেট ও পিঠে অনবরত আঘাত করে সারা শরীর রক্তাক্ত করা হয়। শিশুদের মাথায় আঘাত করে লাল রক্তে রঞ্জিত করা হয়।
আবার কোথাও কোথাও রক্তের নামে লাল রং ছিটানো হয়। রাস্তা-ঘাট রঙ-বেরঙের সাজে সাজানো হয়। হুসাইন (রা.) এর নামে “হাঁস/মোরগ পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে যুবক-যুবতীরা পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঐ বরকতের মোরগ ধরার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। সুসজ্জিত অশ্বারোহী দল লাঠি-তীর-বল্লম নিয়ে মিছিল করে কারবালা যুদ্ধের মহড়া দেয়। কালো পোষাক পরিধান বা কালো ব্যাজ ধারণ করে মিছিলের সম্মুখভাগে নারীরাও অংশ নেয়। আবার অনেকে শোকের মাস ভেবে এই মাসে বিয়ে-শাদী করা অন্যায় মনে করে। ঐ দিন অনেকে পানি পান করা এমনকি শিশুকে দুধ পান করানোও অন্যায় ভাবে।
অপরদিকে, উগ্র শী'আরা আয়েশা (রা.) এর নামে বেঁধে রাখা একটি বকরীকে লাঠিপেটা করে ও অস্ত্রাঘাতে রক্তাক্ত করে বদলা নেয় ও উল্লাসে ফেটে পড়ে। তাদের ধারণা- রাসূলের ইন্তিকালের পর আলী (রা.) খলীফা হতে পারেননি আয়েশা (রা) এর ষড়যন্ত্রের কারণে (নাউযুবিল্লাহ!)। একইভাবে ওমর, উসমান, মুআবিয়া, মুগীরা বিন শু'বা রাযিয়াল্লাহু 'আনহুম প্রমুখ সম্মানিত সাহাবীদেরকে এসময় বিভিন্নভাবে গালি দেওয়া হয়। এ ছাড়াও রেডিও-টিভি, পত্র-পত্রিকা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একথা বুঝানোর চেষ্টা করা হয় যে, আশুরায়ে মুহাররামের মূলবিষয় হল- ‘শাহাদাতে হুসাইন' (রা.) বা 'কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা' । অথচ প্রকৃত সত্য এসব থেকে অনেক দূরে।
আশুরা উপলক্ষে প্রচলিত উপর্যুক্ত বিদ'আতী অনুষ্ঠানাদির কোন অস্তিত্ব কিংবা শী'আ আক্বীদা কোন প্রমাণ সাহাবায়ে কেরামের যুগে পাওয়া যায় না। আল্লাহ ব্যতীত কাউকে সিজদা করা যেমন হারাম, তাযিয়ার নামে ভূয়া কবর যিয়ারত করাও তেমনি হারাম। এতদ্ব্যতীত কোনরূপ শোকগাঁথা বা মর্সিয়া অনুষ্ঠান বা শোকমিছিল ইসলামী শরী আর পরিপন্থী । কোন কবর বা সমাধিসৌধ, শহীদ মিনার বা স্মৃতিসৌধ, শিখা অনির্বাণ বা শিখা চিরন্তন প্রভৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করাও একই পর্যায়ে পড়ে।
অনুরূপভাবে সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহ হল সাহাবায়ে কেরামকে গালি দেওয়া। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “তোমরা আমার সাহাবীগণকে গালি দিয়ো না। কেননা (তাঁরা এমন উচ্চ মর্যাদার অধিকারী যে) তোমাদের কেউ যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, তবুও তাঁদের এক মুদ বা অর্ধ মুদ [১ মুদ= আনুমানিক ৬২৫ গ্রাম]-এর সমান সাওয়াব পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না” । (সহীহুল বুখারী: ৩৬৭৩ ও সহীহ মুসলিম: ২৫৪১)
তাছাড়া শোকের নামে দিবস পালন করা, বুক চাপড়ানো ও মাতম করা ইসলামী রীতি নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে শোকে কাতর হয়ে নিজ মুখে আঘাত করে, কাপড় ছিড়ে ফেলে ও জাহেলী যুগের মতো মাতম করে” (সহীহুল বুখারী: ১২৯৭ ও সহীহ মুসলিম: ১০৩)। অধিকন্তু, ঐসব শোকসভা বা শোক মিছিলে বাড়াবাড়ি করে সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তার পার্থক্য ভুলে হুসাইনের কবরে রূহের আগমন কল্পনা করা, সেখানে সিজদা করা, মাথা ঝুঁকানো, প্রার্থনা নিবেদন করা ইত্যাদি
পরিষ্কারভাবে শিরকের নামান্তর।

📃 আশুরায় আমাদের করণীয়

আশুরা উপলক্ষ্যে মুহাররামের ৯ ও ১০ তারিখ সওম পালন ছাড়া অন্য বিশেষ কোন ইবাদত নেই। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যখন আশুরার দিন সওম পালন করেন এবং লোকদেরকে সওম পালনের নির্দেশ দেন, তখন সাহাবীগণ বললেন, হে রাসূল (সা.) ! ইয়াহুদ এবং নাসারা এ দিনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ইন্‌শা আল্লাহ আগামী বছর আমরা ৯ তারিখেও সওম পালন করব । বর্ণনাকারী বলেন, , আগামী বছর আসার আগেই রাসূলুল্লাহ (সা.) মৃত্যু বরণ করেন । (সহীহ মুসলিম: ১১৩৪ ও ১৯১৬)
তবে হুসাইন (রা.) সহ সকল মৃত মুসলিমের জন্য 'আমভাবে দু'আ করা দূষণীয় নয় । সালাফগণ হুসাইন এর মর্মান্তিক মৃত্যুতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন । কিন্তু তাতে বাড়াবাড়ি করে শী'আদের ন্যায় ঐদিনকে শোক দিবস মনে করেন না। দুঃখ প্রকাশের ইসলামী রীতি হল: “ইন্না লিল্লা-হি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন' পাঠ করা (বাক্বারাহ ১৫৬) ও তাঁদের মুক্তির জন্য দু'আ করা । একথা সন্দেহাতীত যে, আশুরার সওমের সাথে হুসাইন (রা.) বিন আলী এর জন্ম বা মৃত্যুর কোন সম্পর্ক নেই। হুসাইন (রা.) এর জন্ম মদীনায় ৪র্থ হিজরীতে এবং মৃত্যু ইরাকের কুফা নগরীর নিকটবর্তী কারবালায় ৬১ হিজরীতে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মৃত্যুর ৫০ বছর পর ।
(ইবনু হাজার, আল-ইসাবাহ (২/৬৭-৭২, জীবনী: ১৭২৯)
সুতরাং শাহাদাতে হুসাইনের নিয়্যাতে পূর্ববর্ণিত সকল শিরকী ও বিদ'আতী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হবে এবং অন্যকে বিরত থাকার উপদেশ দিতে হবে। এদিনে সওম পালনকারী শাহাদাতে হুসাইনের নিয়্যাত করলে সওমের সওয়াবও পাবে না; বরং গুনাহগার হবে। কারণ, কারবালার ঘটনার ৫০ বছর পূর্বেই ইসলাম পূর্ণতা লাভ করেছে এবং অহীর আগমনও বন্ধ হয়ে গেছে। বনী ইসরাঈলের অসংখ্য নবী নিজ কওমের লোকদের হাতে নিহত হয়েছেন। মুসলমানদের প্রাণপ্রিয় খলীফা হযরত ওমর (রা.) মসজিদে নববীতে ফজরের সালাতরত অবস্থায়, উসমান ৮৩ বছরের বৃদ্ধ বয়সে নিজ গৃহে কুরআন তিলাওয়াতরত অবস্থায়, হযরত আলী (রা.) ফজরের জামা'আতে যাওয়ার পথে অতর্কিত আক্রান্ত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। হাসান (৩-৪৯হিঃ)-কে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। [আল-বিদায়াহ ৮/৪৪] আশারায়ে মুবাশশারাহর অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব হযরত ত্বালহা ও যুবায়ের মর্মান্তিকভাবে শহীদ হন। তাঁদের কারো মৃত্যু হুসাইন (রা.) -এর মৃত্যুর চাইতে কম দুঃখজনক ও মর্মান্তিক ছিল না। কিন্তু কারো জন্য দিনক্ষণ নির্ধারণ করে মাতম করা ও সরকারি ছুটি ঘোষণা করে শোকদিবস পালন করার কোন রীতি সাহাবী ও তাবেয়ীদের যুগে ছিল না। ইসলামী শরী'আতে এসব নিষিদ্ধ ।
প্রকৃতপক্ষে, এ দিনটি মূসা (আ) ও তাঁর কওমের নাজাতের দিন। দুঃখ-কষ্ট থেকে পরিত্রাণ লাভের পর তাওহীদ ভিত্তিক সুখময় জীবনে পদার্পণের দিন। আল্লাহর শত্রু ফিরআউনের পতনের দিন। অত্যাচারীর করাল গ্রাস থেকে মুমিনের মুক্তির দিন। শত্রুর কবল থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে স্রষ্টার উদ্দেশ্যে মুমিনের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন। এতদভিন্ন অবান্তর কিছু ফযীলত ও শোকের নামে অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত থাকা বাঞ্ছনীয়। উপরন্তু, নবীদের রেখে যাওয়া সুন্নাতকে কোন এক সাহাবীর মৃত্যুর শোক পালনের মাধ্যমে তুচ্ছ করা ঈমানী চেতনারও পরিপন্থী। আল্লাহ আমাদেরকে সকল প্রকার শিরকী ও বিদ'আতী কর্মকাণ্ড থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন।
আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে শুব্বানের দাওয়াতী কাজে অংশ গ্রহণ করুন!
(বিকাশ পার্সোনাল) ০১৭৬৫ ৮১২২৬১
জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীস বাংলাদেশ
৭৯/ক/৩, উত্তর যাত্রাবাড়ি, ঢাকা-১২০৪,
[email protected], www.shubbanbd.org, Facebook: /shubban◈ ◈ ◈ আশুরায়ে মুহাররাম : করণীয় ও বর্জনীয় ◈ ◈ ◈

একদিকে জ্ঞানের স্বল্পতা অন্যদিকে মীর মোশাররফ হোসেন এর সাহিত্যরসে সমৃদ্ধ অথচ ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক রসদে পূর্ণ বিখ্যাত উপন্যাস 'বিষাদ সিন্ধু'র ব্যাপক জনপ্রিয়তার কল্যাণে ভারত উপমহাদেশের মুসলিমগণ ১০ই মুহাররামকে কেবল কারবালার মর্মান্তিক ইতিহাস হিসেবেই জানে। এ অঞ্চলে শীআদের সংখ্যা কম হলেও ওইদিনে সর্বত্র হুসাইন (রা.) এর শহীদ হওয়ার যে মর্মান্তিক ও হৃদয়স্পর্শী আলোচনা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ও পুলিশী প্রহরায় শোক মিছিলসহ নানা অনুষ্ঠান সাধারণ মানুষের কোমল হৃদয়ে দাগ কেটেছে। উপরন্তু, সুন্নী মুসলিমদের মধ্যেও বেশ কিছু ভণ্ড পীর-মুরীদ ও মাজারীরা এ দিনটাতে তাদের মাজার-খানকা দরবারী আয়োজনে উৎসবমুখর করে তোলে। ফলে অনেকেই এটাকে এখন ধর্মীয় একটি অনুষ্ঠান হিসেবেই বিবেচনা করে থাকে। এমতাবস্থায়, আগুরা বা ১০ই মুহাররাম কী? তা সর্বসাধারণকে জানানো আমাদের ঈমানী দাবী বলে মনে করছি।
مُحَرَّم(মুহাররাম) হিজরী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। চারটি পবিত্র মাসের মধ্যে এটি একটি (সহীহুল বুখারী: ৩১৯৭)। মুহাররাম শব্দটি "আরবী, যার অর্থ পবিত্র, সম্মানিত। প্রাচীনকাল থেকে এ মাসটি পবিত্র মাস হিসেবে গণ্য। অনুরূপ, عَاشُوْرَاء শব্দটিও আরবি, যার অর্থ দশমী বা ১০ম দিন। বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন মুহাররামের ১০ম তারিখকে আশুরা বলা হয়ে থাকে।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নাবী কারীম (সা.) যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় আসলেন তখন মদীনার ইহুদীদেরকে আশুরার সওম রাখতে দেখে তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা এদিনে কেন সওম রাখ"? উত্তরে তারা বলল, এ দিনটা অত্যন্ত পবিত্র ও সম্মানিত। কেননা, এই দিনে আল্লাহ তাআলা মূসা (আ) ও বানী ইসরাঈলকে ফেরআউনের কবল হতে পরিত্রাণ দিয়েছিলেন। এ কারণে আমরা সওমের মাধ্যমে ঈদ বা খুশি পালন করি, যেন তার স্মরণ সবসময় বিদ্যমান থাকে। রাসূলুল্লাহ বললেন, “মূসা (আ)-এর বিজয়ের দিন পালনে আমরা তোমাদের থেকে বেশী হকদার।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ নিজে সওম রাখলেন এবং সাহাবায়ে কিরামকে সপ্তম রাখার নির্দেশ দিলেন। (সহীহুল বুখারী: ২০০৪, ৩৩৯৭ ও সহীহ মুসলিম: ১১৩০)

📃 আশুরার সওয়ের সীলত:

১. আশুরার সওম ফির'আউনের কবল থেকে মূসা (আ) এর নাজাতের শুকরিয়া হিসেবে পালিত হয়।
২. এই সওম মূসা (আ) ও মুহাম্মাদী শরী'আতে চালু ছিল। আইয়ামে জাহেলিয়াতেও আশুরার সওম পালিত হত। (সহীহুল বুখারী: ২০০২)
৩. ২য় হিজরীতে রমাযানের সওম ফরয হওয়ার আগ পর্যন্ত এই সওম সকল মুসলিমের জন্য পালনীয় নিয়মিত সপ্তম হিসেবে গণ্য হত। ৪. এই সওমের ফযীলত হিসেবে বিগত এক বছরের গোনাহ মাফের কথা বলা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম: ১১৬২)
৫. এ ছাড়াও রমাযানের সপ্তমের পর মুহাররামের সওমকে শ্রেষ্ঠ সওম হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম: ১১৬৩)

📃 আশুরার প্রচলিত বিদ'আতসমূহ, যা বর্জন করতেই হবে

আশুরা উপলক্ষে মুসলিম দাবীদার ভ্রান্ত একটি দল শী'আ ও তাদের দ্বারা প্রভাবিত কতিপয় সুন্নী মিলে অগণিত শিরকী ও বিদ'আতী কর্মে লিপ্ত হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে কোটি টাকার অপচয় করা হয়। সরকারিভাবেও বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালিত হয়। মূসা (আ) এর খুশির বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ রাসূলের (সা.) সাওম পালনের এ দিনটিতে ৬১ হিজরীতে কাকতালীয়ভাবে তাঁর দৌহিত্র হুসাইন (রা.) শাহাদাত বরণ করেন। পরবর্তীকালে (৩৫২ হিজরীতে) শী'আ শাসক আহমাদ বিন বুইয়া দায়লামী ওরফে "মুইযযুদ্দৌলা" ১০ মুহাররামকে শোক দিবস ঘোষণা করে। এদিনে শীআদের অন্যতম কর্মসূচি হলো তাষিয়া প্রদর্শন করা। যার অর্থ-শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করা। তবে বিশেষ অর্থে শব্দটি হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত লাভের বিষাদময় স্মৃতিকে স্মরণ করে শী'আ সম্প্রদায়ের ওই দিনে তাঁর সমাধির প্রতীক বানিয়ে সেটা নিয়ে মিছিল করে শোক প্রকাশ করাকে বুঝায়। শী'আ মতবাদের উদ্ভব ইরাক ও ইরানে হলেও সেখানে এরূপ শোকমিছিলে তাযিয়া বহন করা হয় না। বাংলাদেশে মুঘল আমলে বিশেষত শাহ্ সুজা (১৬৩৯-১৬৫৯) বাংলার সুবেদার থাকাকালে শী'আদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। সম্ভবত, তখনই এখানে তাযিয়া মিছিলের প্রচলন হয়। [বাংলা পিডিয়া]
এভাবে তাষিয়ার নামে হুসাইন (রা.) এর ভুয়া ও বানোয়াট কবর তৈরি করে আমাদের দেশে প্রতিবছর রাজধানীসহ প্রায় প্রতিটি জেলার রাজপথে শোক মিছিল করা হয়। ঐ ভূয়া কবরে হুসাইনের রূহ হাযির হয়, ধারণা করে তাকে সালাম করা হয়। তার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে সিজদাহ করা হয়, মনোবাঞ্ছা পূরণ করার জন্য প্রার্থনা করা হয়। বুক চাপড়ানো হয়, বুকের কাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয়। “হায় হোসেন, হায় হোসেন” বলে মাতম করা হয়। লোহার শিকল ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে পেট ও পিঠে অনবরত আঘাত করে সারা শরীর রক্তাক্ত করা হয়। শিশুদের মাথায় আঘাত করে লাল রক্তে রঞ্জিত করা হয়।
আবার কোথাও কোথাও রক্তের নামে লাল রং ছিটানো হয়। রাস্তা-ঘাট রঙ-বেরঙের সাজে সাজানো হয়। হুসাইন (রা.) এর নামে “হাঁস/মোরগ পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে যুবক-যুবতীরা পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঐ বরকতের মোরগ ধরার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। সুসজ্জিত অশ্বারোহী দল লাঠি-তীর-বল্লম নিয়ে মিছিল করে কারবালা যুদ্ধের মহড়া দেয়। কালো পোষাক পরিধান বা কালো ব্যাজ ধারণ করে মিছিলের সম্মুখভাগে নারীরাও অংশ নেয়। আবার অনেকে শোকের মাস ভেবে এই মাসে বিয়ে-শাদী করা অন্যায় মনে করে। ঐ দিন অনেকে পানি পান করা এমনকি শিশুকে দুধ পান করানোও অন্যায় ভাবে।
অপরদিকে, উগ্র শী'আরা আয়েশা (রা.) এর নামে বেঁধে রাখা একটি বকরীকে লাঠিপেটা করে ও অস্ত্রাঘাতে রক্তাক্ত করে বদলা নেয় ও উল্লাসে ফেটে পড়ে। তাদের ধারণা- রাসূলের ইন্তিকালের পর আলী (রা.) খলীফা হতে পারেননি আয়েশা (রা) এর ষড়যন্ত্রের কারণে (নাউযুবিল্লাহ!)। একইভাবে ওমর, উসমান, মুআবিয়া, মুগীরা বিন শু'বা রাযিয়াল্লাহু 'আনহুম প্রমুখ সম্মানিত সাহাবীদেরকে এসময় বিভিন্নভাবে গালি দেওয়া হয়। এ ছাড়াও রেডিও-টিভি, পত্র-পত্রিকা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একথা বুঝানোর চেষ্টা করা হয় যে, আশুরায়ে মুহাররামের মূলবিষয় হল- ‘শাহাদাতে হুসাইন' (রা.) বা 'কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা' । অথচ প্রকৃত সত্য এসব থেকে অনেক দূরে।
আশুরা উপলক্ষে প্রচলিত উপর্যুক্ত বিদ'আতী অনুষ্ঠানাদির কোন অস্তিত্ব কিংবা শী'আ আক্বীদা কোন প্রমাণ সাহাবায়ে কেরামের যুগে পাওয়া যায় না। আল্লাহ ব্যতীত কাউকে সিজদা করা যেমন হারাম, তাযিয়ার নামে ভূয়া কবর যিয়ারত করাও তেমনি হারাম। এতদ্ব্যতীত কোনরূপ শোকগাঁথা বা মর্সিয়া অনুষ্ঠান বা শোকমিছিল ইসলামী শরী আর পরিপন্থী । কোন কবর বা সমাধিসৌধ, শহীদ মিনার বা স্মৃতিসৌধ, শিখা অনির্বাণ বা শিখা চিরন্তন প্রভৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করাও একই পর্যায়ে পড়ে।
অনুরূপভাবে সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহ হল সাহাবায়ে কেরামকে গালি দেওয়া। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “তোমরা আমার সাহাবীগণকে গালি দিয়ো না। কেননা (তাঁরা এমন উচ্চ মর্যাদার অধিকারী যে) তোমাদের কেউ যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, তবুও তাঁদের এক মুদ বা অর্ধ মুদ [১ মুদ= আনুমানিক ৬২৫ গ্রাম]-এর সমান সাওয়াব পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না” । (সহীহুল বুখারী: ৩৬৭৩ ও সহীহ মুসলিম: ২৫৪১)
তাছাড়া শোকের নামে দিবস পালন করা, বুক চাপড়ানো ও মাতম করা ইসলামী রীতি নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে শোকে কাতর হয়ে নিজ মুখে আঘাত করে, কাপড় ছিড়ে ফেলে ও জাহেলী যুগের মতো মাতম করে” (সহীহুল বুখারী: ১২৯৭ ও সহীহ মুসলিম: ১০৩)। অধিকন্তু, ঐসব শোকসভা বা শোক মিছিলে বাড়াবাড়ি করে সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তার পার্থক্য ভুলে হুসাইনের কবরে রূহের আগমন কল্পনা করা, সেখানে সিজদা করা, মাথা ঝুঁকানো, প্রার্থনা নিবেদন করা ইত্যাদি
পরিষ্কারভাবে শিরকের নামান্তর।

📃 আশুরায় আমাদের করণীয়

আশুরা উপলক্ষ্যে মুহাররামের ৯ ও ১০ তারিখ সওম পালন ছাড়া অন্য বিশেষ কোন ইবাদত নেই। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যখন আশুরার দিন সওম পালন করেন এবং লোকদেরকে সওম পালনের নির্দেশ দেন, তখন সাহাবীগণ বললেন, হে রাসূল (সা.) ! ইয়াহুদ এবং নাসারা এ দিনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ইন্‌শা আল্লাহ আগামী বছর আমরা ৯ তারিখেও সওম পালন করব । বর্ণনাকারী বলেন, , আগামী বছর আসার আগেই রাসূলুল্লাহ (সা.) মৃত্যু বরণ করেন । (সহীহ মুসলিম: ১১৩৪ ও ১৯১৬)
তবে হুসাইন (রা.) সহ সকল মৃত মুসলিমের জন্য 'আমভাবে দু'আ করা দূষণীয় নয় । সালাফগণ হুসাইন এর মর্মান্তিক মৃত্যুতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন । কিন্তু তাতে বাড়াবাড়ি করে শী'আদের ন্যায় ঐদিনকে শোক দিবস মনে করেন না। দুঃখ প্রকাশের ইসলামী রীতি হল: “ইন্না লিল্লা-হি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন' পাঠ করা (বাক্বারাহ ১৫৬) ও তাঁদের মুক্তির জন্য দু'আ করা । একথা সন্দেহাতীত যে, আশুরার সওমের সাথে হুসাইন (রা.) বিন আলী এর জন্ম বা মৃত্যুর কোন সম্পর্ক নেই। হুসাইন (রা.) এর জন্ম মদীনায় ৪র্থ হিজরীতে এবং মৃত্যু ইরাকের কুফা নগরীর নিকটবর্তী কারবালায় ৬১ হিজরীতে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মৃত্যুর ৫০ বছর পর ।
(ইবনু হাজার, আল-ইসাবাহ (২/৬৭-৭২, জীবনী: ১৭২৯)
সুতরাং শাহাদাতে হুসাইনের নিয়্যাতে পূর্ববর্ণিত সকল শিরকী ও বিদ'আতী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হবে এবং অন্যকে বিরত থাকার উপদেশ দিতে হবে। এদিনে সওম পালনকারী শাহাদাতে হুসাইনের নিয়্যাত করলে সওমের সওয়াবও পাবে না; বরং গুনাহগার হবে। কারণ, কারবালার ঘটনার ৫০ বছর পূর্বেই ইসলাম পূর্ণতা লাভ করেছে এবং অহীর আগমনও বন্ধ হয়ে গেছে। বনী ইসরাঈলের অসংখ্য নবী নিজ কওমের লোকদের হাতে নিহত হয়েছেন। মুসলমানদের প্রাণপ্রিয় খলীফা হযরত ওমর (রা.) মসজিদে নববীতে ফজরের সালাতরত অবস্থায়, উসমান ৮৩ বছরের বৃদ্ধ বয়সে নিজ গৃহে কুরআন তিলাওয়াতরত অবস্থায়, হযরত আলী (রা.) ফজরের জামা'আতে যাওয়ার পথে অতর্কিত আক্রান্ত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। হাসান (৩-৪৯হিঃ)-কে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। [আল-বিদায়াহ ৮/৪৪] আশারায়ে মুবাশশারাহর অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব হযরত ত্বালহা ও যুবায়ের মর্মান্তিকভাবে শহীদ হন। তাঁদের কারো মৃত্যু হুসাইন (রা.) -এর মৃত্যুর চাইতে কম দুঃখজনক ও মর্মান্তিক ছিল না। কিন্তু কারো জন্য দিনক্ষণ নির্ধারণ করে মাতম করা ও সরকারি ছুটি ঘোষণা করে শোকদিবস পালন করার কোন রীতি সাহাবী ও তাবেয়ীদের যুগে ছিল না। ইসলামী শরী'আতে এসব নিষিদ্ধ ।
প্রকৃতপক্ষে, এ দিনটি মূসা (আ) ও তাঁর কওমের নাজাতের দিন। দুঃখ-কষ্ট থেকে পরিত্রাণ লাভের পর তাওহীদ ভিত্তিক সুখময় জীবনে পদার্পণের দিন। আল্লাহর শত্রু ফিরআউনের পতনের দিন। অত্যাচারীর করাল গ্রাস থেকে মুমিনের মুক্তির দিন। শত্রুর কবল থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে স্রষ্টার উদ্দেশ্যে মুমিনের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন। এতদভিন্ন অবান্তর কিছু ফযীলত ও শোকের নামে অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত থাকা বাঞ্ছনীয়। উপরন্তু, নবীদের রেখে যাওয়া সুন্নাতকে কোন এক সাহাবীর মৃত্যুর শোক পালনের মাধ্যমে তুচ্ছ করা ঈমানী চেতনারও পরিপন্থী। আল্লাহ আমাদেরকে সকল প্রকার শিরকী ও বিদ'আতী কর্মকাণ্ড থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন।
আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে শুব্বানের দাওয়াতী কাজে অংশ গ্রহণ করুন!
(বিকাশ পার্সোনাল) ০১৭৬৫ ৮১২২৬১
জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীস বাংলাদেশ
৭৯/ক/৩, উত্তর যাত্রাবাড়ি, ঢাকা-১২০৪,
[email protected], www.shubbanbd.org, Facebook: /shubban◈ ◈ ◈ আশুরায়ে মুহাররাম : করণীয় ও বর্জনীয় ◈ ◈ ◈

একদিকে জ্ঞানের স্বল্পতা অন্যদিকে মীর মোশাররফ হোসেন এর সাহিত্যরসে সমৃদ্ধ অথচ ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক রসদে পূর্ণ বিখ্যাত উপন্যাস 'বিষাদ সিন্ধু'র ব্যাপক জনপ্রিয়তার কল্যাণে ভারত উপমহাদেশের মুসলিমগণ ১০ই মুহাররামকে কেবল কারবালার মর্মান্তিক ইতিহাস হিসেবেই জানে। এ অঞ্চলে শীআদের সংখ্যা কম হলেও ওইদিনে সর্বত্র হুসাইন (রা.) এর শহীদ হওয়ার যে মর্মান্তিক ও হৃদয়স্পর্শী আলোচনা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ও পুলিশী প্রহরায় শোক মিছিলসহ নানা অনুষ্ঠান সাধারণ মানুষের কোমল হৃদয়ে দাগ কেটেছে। উপরন্তু, সুন্নী মুসলিমদের মধ্যেও বেশ কিছু ভণ্ড পীর-মুরীদ ও মাজারীরা এ দিনটাতে তাদের মাজার-খানকা দরবারী আয়োজনে উৎসবমুখর করে তোলে। ফলে অনেকেই এটাকে এখন ধর্মীয় একটি অনুষ্ঠান হিসেবেই বিবেচনা করে থাকে। এমতাবস্থায়, আগুরা বা ১০ই মুহাররাম কী? তা সর্বসাধারণকে জানানো আমাদের ঈমানী দাবী বলে মনে করছি।
مُحَرَّم(মুহাররাম) হিজরী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। চারটি পবিত্র মাসের মধ্যে এটি একটি (সহীহুল বুখারী: ৩১৯৭)। মুহাররাম শব্দটি "আরবী, যার অর্থ পবিত্র, সম্মানিত। প্রাচীনকাল থেকে এ মাসটি পবিত্র মাস হিসেবে গণ্য। অনুরূপ, عَاشُوْرَاء শব্দটিও আরবি, যার অর্থ দশমী বা ১০ম দিন। বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন মুহাররামের ১০ম তারিখকে আশুরা বলা হয়ে থাকে।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নাবী কারীম (সা.) যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় আসলেন তখন মদীনার ইহুদীদেরকে আশুরার সওম রাখতে দেখে তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা এদিনে কেন সওম রাখ"? উত্তরে তারা বলল, এ দিনটা অত্যন্ত পবিত্র ও সম্মানিত। কেননা, এই দিনে আল্লাহ তাআলা মূসা (আ) ও বানী ইসরাঈলকে ফেরআউনের কবল হতে পরিত্রাণ দিয়েছিলেন। এ কারণে আমরা সওমের মাধ্যমে ঈদ বা খুশি পালন করি, যেন তার স্মরণ সবসময় বিদ্যমান থাকে। রাসূলুল্লাহ বললেন, “মূসা (আ)-এর বিজয়ের দিন পালনে আমরা তোমাদের থেকে বেশী হকদার।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ নিজে সওম রাখলেন এবং সাহাবায়ে কিরামকে সপ্তম রাখার নির্দেশ দিলেন। (সহীহুল বুখারী: ২০০৪, ৩৩৯৭ ও সহীহ মুসলিম: ১১৩০)

📃 আশুরার সওয়ের সীলত:

১. আশুরার সওম ফির'আউনের কবল থেকে মূসা (আ) এর নাজাতের শুকরিয়া হিসেবে পালিত হয়।
২. এই সওম মূসা (আ) ও মুহাম্মাদী শরী'আতে চালু ছিল। আইয়ামে জাহেলিয়াতেও আশুরার সওম পালিত হত। (সহীহুল বুখারী: ২০০২)
৩. ২য় হিজরীতে রমাযানের সওম ফরয হওয়ার আগ পর্যন্ত এই সওম সকল মুসলিমের জন্য পালনীয় নিয়মিত সপ্তম হিসেবে গণ্য হত। ৪. এই সওমের ফযীলত হিসেবে বিগত এক বছরের গোনাহ মাফের কথা বলা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম: ১১৬২)
৫. এ ছাড়াও রমাযানের সপ্তমের পর মুহাররামের সওমকে শ্রেষ্ঠ সওম হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম: ১১৬৩)

📃 আশুরার প্রচলিত বিদ'আতসমূহ, যা বর্জন করতেই হবে

আশুরা উপলক্ষে মুসলিম দাবীদার ভ্রান্ত একটি দল শী'আ ও তাদের দ্বারা প্রভাবিত কতিপয় সুন্নী মিলে অগণিত শিরকী ও বিদ'আতী কর্মে লিপ্ত হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে কোটি টাকার অপচয় করা হয়। সরকারিভাবেও বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালিত হয়। মূসা (আ) এর খুশির বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ রাসূলের (সা.) সাওম পালনের এ দিনটিতে ৬১ হিজরীতে কাকতালীয়ভাবে তাঁর দৌহিত্র হুসাইন (রা.) শাহাদাত বরণ করেন। পরবর্তীকালে (৩৫২ হিজরীতে) শী'আ শাসক আহমাদ বিন বুইয়া দায়লামী ওরফে "মুইযযুদ্দৌলা" ১০ মুহাররামকে শোক দিবস ঘোষণা করে। এদিনে শীআদের অন্যতম কর্মসূচি হলো তাষিয়া প্রদর্শন করা। যার অর্থ-শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করা। তবে বিশেষ অর্থে শব্দটি হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত লাভের বিষাদময় স্মৃতিকে স্মরণ করে শী'আ সম্প্রদায়ের ওই দিনে তাঁর সমাধির প্রতীক বানিয়ে সেটা নিয়ে মিছিল করে শোক প্রকাশ করাকে বুঝায়। শী'আ মতবাদের উদ্ভব ইরাক ও ইরানে হলেও সেখানে এরূপ শোকমিছিলে তাযিয়া বহন করা হয় না। বাংলাদেশে মুঘল আমলে বিশেষত শাহ্ সুজা (১৬৩৯-১৬৫৯) বাংলার সুবেদার থাকাকালে শী'আদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। সম্ভবত, তখনই এখানে তাযিয়া মিছিলের প্রচলন হয়। [বাংলা পিডিয়া]
এভাবে তাষিয়ার নামে হুসাইন (রা.) এর ভুয়া ও বানোয়াট কবর তৈরি করে আমাদের দেশে প্রতিবছর রাজধানীসহ প্রায় প্রতিটি জেলার রাজপথে শোক মিছিল করা হয়। ঐ ভূয়া কবরে হুসাইনের রূহ হাযির হয়, ধারণা করে তাকে সালাম করা হয়। তার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে সিজদাহ করা হয়, মনোবাঞ্ছা পূরণ করার জন্য প্রার্থনা করা হয়। বুক চাপড়ানো হয়, বুকের কাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয়। “হায় হোসেন, হায় হোসেন” বলে মাতম করা হয়। লোহার শিকল ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে পেট ও পিঠে অনবরত আঘাত করে সারা শরীর রক্তাক্ত করা হয়। শিশুদের মাথায় আঘাত করে লাল রক্তে রঞ্জিত করা হয়।
আবার কোথাও কোথাও রক্তের নামে লাল রং ছিটানো হয়। রাস্তা-ঘাট রঙ-বেরঙের সাজে সাজানো হয়। হুসাইন (রা.) এর নামে “হাঁস/মোরগ পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে যুবক-যুবতীরা পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঐ বরকতের মোরগ ধরার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। সুসজ্জিত অশ্বারোহী দল লাঠি-তীর-বল্লম নিয়ে মিছিল করে কারবালা যুদ্ধের মহড়া দেয়। কালো পোষাক পরিধান বা কালো ব্যাজ ধারণ করে মিছিলের সম্মুখভাগে নারীরাও অংশ নেয়। আবার অনেকে শোকের মাস ভেবে এই মাসে বিয়ে-শাদী করা অন্যায় মনে করে। ঐ দিন অনেকে পানি পান করা এমনকি শিশুকে দুধ পান করানোও অন্যায় ভাবে।
অপরদিকে, উগ্র শী'আরা আয়েশা (রা.) এর নামে বেঁধে রাখা একটি বকরীকে লাঠিপেটা করে ও অস্ত্রাঘাতে রক্তাক্ত করে বদলা নেয় ও উল্লাসে ফেটে পড়ে। তাদের ধারণা- রাসূলের ইন্তিকালের পর আলী (রা.) খলীফা হতে পারেননি আয়েশা (রা) এর ষড়যন্ত্রের কারণে (নাউযুবিল্লাহ!)। একইভাবে ওমর, উসমান, মুআবিয়া, মুগীরা বিন শু'বা রাযিয়াল্লাহু 'আনহুম প্রমুখ সম্মানিত সাহাবীদেরকে এসময় বিভিন্নভাবে গালি দেওয়া হয়। এ ছাড়াও রেডিও-টিভি, পত্র-পত্রিকা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একথা বুঝানোর চেষ্টা করা হয় যে, আশুরায়ে মুহাররামের মূলবিষয় হল- ‘শাহাদাতে হুসাইন' (রা.) বা 'কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা' । অথচ প্রকৃত সত্য এসব থেকে অনেক দূরে।
আশুরা উপলক্ষে প্রচলিত উপর্যুক্ত বিদ'আতী অনুষ্ঠানাদির কোন অস্তিত্ব কিংবা শী'আ আক্বীদা কোন প্রমাণ সাহাবায়ে কেরামের যুগে পাওয়া যায় না। আল্লাহ ব্যতীত কাউকে সিজদা করা যেমন হারাম, তাযিয়ার নামে ভূয়া কবর যিয়ারত করাও তেমনি হারাম। এতদ্ব্যতীত কোনরূপ শোকগাঁথা বা মর্সিয়া অনুষ্ঠান বা শোকমিছিল ইসলামী শরী আর পরিপন্থী । কোন কবর বা সমাধিসৌধ, শহীদ মিনার বা স্মৃতিসৌধ, শিখা অনির্বাণ বা শিখা চিরন্তন প্রভৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করাও একই পর্যায়ে পড়ে।
অনুরূপভাবে সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহ হল সাহাবায়ে কেরামকে গালি দেওয়া। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “তোমরা আমার সাহাবীগণকে গালি দিয়ো না। কেননা (তাঁরা এমন উচ্চ মর্যাদার অধিকারী যে) তোমাদের কেউ যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, তবুও তাঁদের এক মুদ বা অর্ধ মুদ [১ মুদ= আনুমানিক ৬২৫ গ্রাম]-এর সমান সাওয়াব পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না” । (সহীহুল বুখারী: ৩৬৭৩ ও সহীহ মুসলিম: ২৫৪১)
তাছাড়া শোকের নামে দিবস পালন করা, বুক চাপড়ানো ও মাতম করা ইসলামী রীতি নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে শোকে কাতর হয়ে নিজ মুখে আঘাত করে, কাপড় ছিড়ে ফেলে ও জাহেলী যুগের মতো মাতম করে” (সহীহুল বুখারী: ১২৯৭ ও সহীহ মুসলিম: ১০৩)। অধিকন্তু, ঐসব শোকসভা বা শোক মিছিলে বাড়াবাড়ি করে সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তার পার্থক্য ভুলে হুসাইনের কবরে রূহের আগমন কল্পনা করা, সেখানে সিজদা করা, মাথা ঝুঁকানো, প্রার্থনা নিবেদন করা ইত্যাদি
পরিষ্কারভাবে শিরকের নামান্তর।

📃 আশুরায় আমাদের করণীয়

আশুরা উপলক্ষ্যে মুহাররামের ৯ ও ১০ তারিখ সওম পালন ছাড়া অন্য বিশেষ কোন ইবাদত নেই। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যখন আশুরার দিন সওম পালন করেন এবং লোকদেরকে সওম পালনের নির্দেশ দেন, তখন সাহাবীগণ বললেন, হে রাসূল (সা.) ! ইয়াহুদ এবং নাসারা এ দিনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ইন্‌শা আল্লাহ আগামী বছর আমরা ৯ তারিখেও সওম পালন করব । বর্ণনাকারী বলেন, , আগামী বছর আসার আগেই রাসূলুল্লাহ (সা.) মৃত্যু বরণ করেন । (সহীহ মুসলিম: ১১৩৪ ও ১৯১৬)
তবে হুসাইন (রা.) সহ সকল মৃত মুসলিমের জন্য 'আমভাবে দু'আ করা দূষণীয় নয় । সালাফগণ হুসাইন এর মর্মান্তিক মৃত্যুতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন । কিন্তু তাতে বাড়াবাড়ি করে শী'আদের ন্যায় ঐদিনকে শোক দিবস মনে করেন না। দুঃখ প্রকাশের ইসলামী রীতি হল: “ইন্না লিল্লা-হি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন' পাঠ করা (বাক্বারাহ ১৫৬) ও তাঁদের মুক্তির জন্য দু'আ করা । একথা সন্দেহাতীত যে, আশুরার সওমের সাথে হুসাইন (রা.) বিন আলী এর জন্ম বা মৃত্যুর কোন সম্পর্ক নেই। হুসাইন (রা.) এর জন্ম মদীনায় ৪র্থ হিজরীতে এবং মৃত্যু ইরাকের কুফা নগরীর নিকটবর্তী কারবালায় ৬১ হিজরীতে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মৃত্যুর ৫০ বছর পর ।
(ইবনু হাজার, আল-ইসাবাহ (২/৬৭-৭২, জীবনী: ১৭২৯)
সুতরাং শাহাদাতে হুসাইনের নিয়্যাতে পূর্ববর্ণিত সকল শিরকী ও বিদ'আতী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হবে এবং অন্যকে বিরত থাকার উপদেশ দিতে হবে। এদিনে সওম পালনকারী শাহাদাতে হুসাইনের নিয়্যাত করলে সওমের সওয়াবও পাবে না; বরং গুনাহগার হবে। কারণ, কারবালার ঘটনার ৫০ বছর পূর্বেই ইসলাম পূর্ণতা লাভ করেছে এবং অহীর আগমনও বন্ধ হয়ে গেছে। বনী ইসরাঈলের অসংখ্য নবী নিজ কওমের লোকদের হাতে নিহত হয়েছেন। মুসলমানদের প্রাণপ্রিয় খলীফা হযরত ওমর (রা.) মসজিদে নববীতে ফজরের সালাতরত অবস্থায়, উসমান ৮৩ বছরের বৃদ্ধ বয়সে নিজ গৃহে কুরআন তিলাওয়াতরত অবস্থায়, হযরত আলী (রা.) ফজরের জামা'আতে যাওয়ার পথে অতর্কিত আক্রান্ত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। হাসান (৩-৪৯হিঃ)-কে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। [আল-বিদায়াহ ৮/৪৪] আশারায়ে মুবাশশারাহর অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব হযরত ত্বালহা ও যুবায়ের মর্মান্তিকভাবে শহীদ হন। তাঁদের কারো মৃত্যু হুসাইন (রা.) -এর মৃত্যুর চাইতে কম দুঃখজনক ও মর্মান্তিক ছিল না। কিন্তু কারো জন্য দিনক্ষণ নির্ধারণ করে মাতম করা ও সরকারি ছুটি ঘোষণা করে শোকদিবস পালন করার কোন রীতি সাহাবী ও তাবেয়ীদের যুগে ছিল না। ইসলামী শরী'আতে এসব নিষিদ্ধ ।
প্রকৃতপক্ষে, এ দিনটি মূসা (আ) ও তাঁর কওমের নাজাতের দিন। দুঃখ-কষ্ট থেকে পরিত্রাণ লাভের পর তাওহীদ ভিত্তিক সুখময় জীবনে পদার্পণের দিন। আল্লাহর শত্রু ফিরআউনের পতনের দিন। অত্যাচারীর করাল গ্রাস থেকে মুমিনের মুক্তির দিন। শত্রুর কবল থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে স্রষ্টার উদ্দেশ্যে মুমিনের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন। এতদভিন্ন অবান্তর কিছু ফযীলত ও শোকের নামে অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত থাকা বাঞ্ছনীয়। উপরন্তু, নবীদের রেখে যাওয়া সুন্নাতকে কোন এক সাহাবীর মৃত্যুর শোক পালনের মাধ্যমে তুচ্ছ করা ঈমানী চেতনারও পরিপন্থী। আল্লাহ আমাদেরকে সকল প্রকার শিরকী ও বিদ'আতী কর্মকাণ্ড থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন।
আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে শুব্বানের দাওয়াতী কাজে অংশ গ্রহণ করুন!
(বিকাশ পার্সোনাল) ০১৭৬৫ ৮১২২৬১
জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীস বাংলাদেশ
৭৯/ক/৩, উত্তর যাত্রাবাড়ি, ঢাকা-১২০৪,
[email protected], www.shubbanbd.org, Facebook: /shubban◈ ◈ ◈ আশুরায়ে মুহাররাম : করণীয় ও বর্জনীয় ◈ ◈ ◈

একদিকে জ্ঞানের স্বল্পতা অন্যদিকে মীর মোশাররফ হোসেন এর সাহিত্যরসে সমৃদ্ধ অথচ ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক রসদে পূর্ণ বিখ্যাত উপন্যাস 'বিষাদ সিন্ধু'র ব্যাপক জনপ্রিয়তার কল্যাণে ভারত উপমহাদেশের মুসলিমগণ ১০ই মুহাররামকে কেবল কারবালার মর্মান্তিক ইতিহাস হিসেবেই জানে। এ অঞ্চলে শীআদের সংখ্যা কম হলেও ওইদিনে সর্বত্র হুসাইন (রা.) এর শহীদ হওয়ার যে মর্মান্তিক ও হৃদয়স্পর্শী আলোচনা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ও পুলিশী প্রহরায় শোক মিছিলসহ নানা অনুষ্ঠান সাধারণ মানুষের কোমল হৃদয়ে দাগ কেটেছে। উপরন্তু, সুন্নী মুসলিমদের মধ্যেও বেশ কিছু ভণ্ড পীর-মুরীদ ও মাজারীরা এ দিনটাতে তাদের মাজার-খানকা দরবারী আয়োজনে উৎসবমুখর করে তোলে। ফলে অনেকেই এটাকে এখন ধর্মীয় একটি অনুষ্ঠান হিসেবেই বিবেচনা করে থাকে। এমতাবস্থায়, আগুরা বা ১০ই মুহাররাম কী? তা সর্বসাধারণকে জানানো আমাদের ঈমানী দাবী বলে মনে করছি।
مُحَرَّم(মুহাররাম) হিজরী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। চারটি পবিত্র মাসের মধ্যে এটি একটি (সহীহুল বুখারী: ৩১৯৭)। মুহাররাম শব্দটি "আরবী, যার অর্থ পবিত্র, সম্মানিত। প্রাচীনকাল থেকে এ মাসটি পবিত্র মাস হিসেবে গণ্য। অনুরূপ, عَاشُوْرَاء শব্দটিও আরবি, যার অর্থ দশমী বা ১০ম দিন। বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন মুহাররামের ১০ম তারিখকে আশুরা বলা হয়ে থাকে।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নাবী কারীম (সা.) যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় আসলেন তখন মদীনার ইহুদীদেরকে আশুরার সওম রাখতে দেখে তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা এদিনে কেন সওম রাখ"? উত্তরে তারা বলল, এ দিনটা অত্যন্ত পবিত্র ও সম্মানিত। কেননা, এই দিনে আল্লাহ তাআলা মূসা (আ) ও বানী ইসরাঈলকে ফেরআউনের কবল হতে পরিত্রাণ দিয়েছিলেন। এ কারণে আমরা সওমের মাধ্যমে ঈদ বা খুশি পালন করি, যেন তার স্মরণ সবসময় বিদ্যমান থাকে। রাসূলুল্লাহ বললেন, “মূসা (আ)-এর বিজয়ের দিন পালনে আমরা তোমাদের থেকে বেশী হকদার।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ নিজে সওম রাখলেন এবং সাহাবায়ে কিরামকে সপ্তম রাখার নির্দেশ দিলেন। (সহীহুল বুখারী: ২০০৪, ৩৩৯৭ ও সহীহ মুসলিম: ১১৩০)

📃 আশুরার সওয়ের সীলত:

১. আশুরার সওম ফির'আউনের কবল থেকে মূসা (আ) এর নাজাতের শুকরিয়া হিসেবে পালিত হয়।
২. এই সওম মূসা (আ) ও মুহাম্মাদী শরী'আতে চালু ছিল। আইয়ামে জাহেলিয়াতেও আশুরার সওম পালিত হত। (সহীহুল বুখারী: ২০০২)
৩. ২য় হিজরীতে রমাযানের সওম ফরয হওয়ার আগ পর্যন্ত এই সওম সকল মুসলিমের জন্য পালনীয় নিয়মিত সপ্তম হিসেবে গণ্য হত। ৪. এই সওমের ফযীলত হিসেবে বিগত এক বছরের গোনাহ মাফের কথা বলা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম: ১১৬২)
৫. এ ছাড়াও রমাযানের সপ্তমের পর মুহাররামের সওমকে শ্রেষ্ঠ সওম হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম: ১১৬৩)

📃 আশুরার প্রচলিত বিদ'আতসমূহ, যা বর্জন করতেই হবে

আশুরা উপলক্ষে মুসলিম দাবীদার ভ্রান্ত একটি দল শী'আ ও তাদের দ্বারা প্রভাবিত কতিপয় সুন্নী মিলে অগণিত শিরকী ও বিদ'আতী কর্মে লিপ্ত হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে কোটি টাকার অপচয় করা হয়। সরকারিভাবেও বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালিত হয়। মূসা (আ) এর খুশির বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ রাসূলের (সা.) সাওম পালনের এ দিনটিতে ৬১ হিজরীতে কাকতালীয়ভাবে তাঁর দৌহিত্র হুসাইন (রা.) শাহাদাত বরণ করেন। পরবর্তীকালে (৩৫২ হিজরীতে) শী'আ শাসক আহমাদ বিন বুইয়া দায়লামী ওরফে "মুইযযুদ্দৌলা" ১০ মুহাররামকে শোক দিবস ঘোষণা করে। এদিনে শীআদের অন্যতম কর্মসূচি হলো তাষিয়া প্রদর্শন করা। যার অর্থ-শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করা। তবে বিশেষ অর্থে শব্দটি হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত লাভের বিষাদময় স্মৃতিকে স্মরণ করে শী'আ সম্প্রদায়ের ওই দিনে তাঁর সমাধির প্রতীক বানিয়ে সেটা নিয়ে মিছিল করে শোক প্রকাশ করাকে বুঝায়। শী'আ মতবাদের উদ্ভব ইরাক ও ইরানে হলেও সেখানে এরূপ শোকমিছিলে তাযিয়া বহন করা হয় না। বাংলাদেশে মুঘল আমলে বিশেষত শাহ্ সুজা (১৬৩৯-১৬৫৯) বাংলার সুবেদার থাকাকালে শী'আদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। সম্ভবত, তখনই এখানে তাযিয়া মিছিলের প্রচলন হয়। [বাংলা পিডিয়া]
এভাবে তাষিয়ার নামে হুসাইন (রা.) এর ভুয়া ও বানোয়াট কবর তৈরি করে আমাদের দেশে প্রতিবছর রাজধানীসহ প্রায় প্রতিটি জেলার রাজপথে শোক মিছিল করা হয়। ঐ ভূয়া কবরে হুসাইনের রূহ হাযির হয়, ধারণা করে তাকে সালাম করা হয়। তার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে সিজদাহ করা হয়, মনোবাঞ্ছা পূরণ করার জন্য প্রার্থনা করা হয়। বুক চাপড়ানো হয়, বুকের কাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয়। “হায় হোসেন, হায় হোসেন” বলে মাতম করা হয়। লোহার শিকল ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে পেট ও পিঠে অনবরত আঘাত করে সারা শরীর রক্তাক্ত করা হয়। শিশুদের মাথায় আঘাত করে লাল রক্তে রঞ্জিত করা হয়।
আবার কোথাও কোথাও রক্তের নামে লাল রং ছিটানো হয়। রাস্তা-ঘাট রঙ-বেরঙের সাজে সাজানো হয়। হুসাইন (রা.) এর নামে “হাঁস/মোরগ পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে যুবক-যুবতীরা পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঐ বরকতের মোরগ ধরার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। সুসজ্জিত অশ্বারোহী দল লাঠি-তীর-বল্লম নিয়ে মিছিল করে কারবালা যুদ্ধের মহড়া দেয়। কালো পোষাক পরিধান বা কালো ব্যাজ ধারণ করে মিছিলের সম্মুখভাগে নারীরাও অংশ নেয়। আবার অনেকে শোকের মাস ভেবে এই মাসে বিয়ে-শাদী করা অন্যায় মনে করে। ঐ দিন অনেকে পানি পান করা এমনকি শিশুকে দুধ পান করানোও অন্যায় ভাবে।
অপরদিকে, উগ্র শী'আরা আয়েশা (রা.) এর নামে বেঁধে রাখা একটি বকরীকে লাঠিপেটা করে ও অস্ত্রাঘাতে রক্তাক্ত করে বদলা নেয় ও উল্লাসে ফেটে পড়ে। তাদের ধারণা- রাসূলের ইন্তিকালের পর আলী (রা.) খলীফা হতে পারেননি আয়েশা (রা) এর ষড়যন্ত্রের কারণে (নাউযুবিল্লাহ!)। একইভাবে ওমর, উসমান, মুআবিয়া, মুগীরা বিন শু'বা রাযিয়াল্লাহু 'আনহুম প্রমুখ সম্মানিত সাহাবীদেরকে এসময় বিভিন্নভাবে গালি দেওয়া হয়। এ ছাড়াও রেডিও-টিভি, পত্র-পত্রিকা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একথা বুঝানোর চেষ্টা করা হয় যে, আশুরায়ে মুহাররামের মূলবিষয় হল- ‘শাহাদাতে হুসাইন' (রা.) বা 'কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা' । অথচ প্রকৃত সত্য এসব থেকে অনেক দূরে।
আশুরা উপলক্ষে প্রচলিত উপর্যুক্ত বিদ'আতী অনুষ্ঠানাদির কোন অস্তিত্ব কিংবা শী'আ আক্বীদা কোন প্রমাণ সাহাবায়ে কেরামের যুগে পাওয়া যায় না। আল্লাহ ব্যতীত কাউকে সিজদা করা যেমন হারাম, তাযিয়ার নামে ভূয়া কবর যিয়ারত করাও তেমনি হারাম। এতদ্ব্যতীত কোনরূপ শোকগাঁথা বা মর্সিয়া অনুষ্ঠান বা শোকমিছিল ইসলামী শরী আর পরিপন্থী । কোন কবর বা সমাধিসৌধ, শহীদ মিনার বা স্মৃতিসৌধ, শিখা অনির্বাণ বা শিখা চিরন্তন প্রভৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করাও একই পর্যায়ে পড়ে।
অনুরূপভাবে সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহ হল সাহাবায়ে কেরামকে গালি দেওয়া। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “তোমরা আমার সাহাবীগণকে গালি দিয়ো না। কেননা (তাঁরা এমন উচ্চ মর্যাদার অধিকারী যে) তোমাদের কেউ যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, তবুও তাঁদের এক মুদ বা অর্ধ মুদ [১ মুদ= আনুমানিক ৬২৫ গ্রাম]-এর সমান সাওয়াব পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না” । (সহীহুল বুখারী: ৩৬৭৩ ও সহীহ মুসলিম: ২৫৪১)
তাছাড়া শোকের নামে দিবস পালন করা, বুক চাপড়ানো ও মাতম করা ইসলামী রীতি নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে শোকে কাতর হয়ে নিজ মুখে আঘাত করে, কাপড় ছিড়ে ফেলে ও জাহেলী যুগের মতো মাতম করে” (সহীহুল বুখারী: ১২৯৭ ও সহীহ মুসলিম: ১০৩)। অধিকন্তু, ঐসব শোকসভা বা শোক মিছিলে বাড়াবাড়ি করে সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তার পার্থক্য ভুলে হুসাইনের কবরে রূহের আগমন কল্পনা করা, সেখানে সিজদা করা, মাথা ঝুঁকানো, প্রার্থনা নিবেদন করা ইত্যাদি
পরিষ্কারভাবে শিরকের নামান্তর।

📃 আশুরায় আমাদের করণীয়

আশুরা উপলক্ষ্যে মুহাররামের ৯ ও ১০ তারিখ সওম পালন ছাড়া অন্য বিশেষ কোন ইবাদত নেই। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যখন আশুরার দিন সওম পালন করেন এবং লোকদেরকে সওম পালনের নির্দেশ দেন, তখন সাহাবীগণ বললেন, হে রাসূল (সা.) ! ইয়াহুদ এবং নাসারা এ দিনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ইন্‌শা আল্লাহ আগামী বছর আমরা ৯ তারিখেও সওম পালন করব । বর্ণনাকারী বলেন, , আগামী বছর আসার আগেই রাসূলুল্লাহ (সা.) মৃত্যু বরণ করেন । (সহীহ মুসলিম: ১১৩৪ ও ১৯১৬)
তবে হুসাইন (রা.) সহ সকল মৃত মুসলিমের জন্য 'আমভাবে দু'আ করা দূষণীয় নয় । সালাফগণ হুসাইন এর মর্মান্তিক মৃত্যুতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন । কিন্তু তাতে বাড়াবাড়ি করে শী'আদের ন্যায় ঐদিনকে শোক দিবস মনে করেন না। দুঃখ প্রকাশের ইসলামী রীতি হল: “ইন্না লিল্লা-হি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন' পাঠ করা (বাক্বারাহ ১৫৬) ও তাঁদের মুক্তির জন্য দু'আ করা । একথা সন্দেহাতীত যে, আশুরার সওমের সাথে হুসাইন (রা.) বিন আলী এর জন্ম বা মৃত্যুর কোন সম্পর্ক নেই। হুসাইন (রা.) এর জন্ম মদীনায় ৪র্থ হিজরীতে এবং মৃত্যু ইরাকের কুফা নগরীর নিকটবর্তী কারবালায় ৬১ হিজরীতে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মৃত্যুর ৫০ বছর পর ।
(ইবনু হাজার, আল-ইসাবাহ (২/৬৭-৭২, জীবনী: ১৭২৯)
সুতরাং শাহাদাতে হুসাইনের নিয়্যাতে পূর্ববর্ণিত সকল শিরকী ও বিদ'আতী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হবে এবং অন্যকে বিরত থাকার উপদেশ দিতে হবে। এদিনে সওম পালনকারী শাহাদাতে হুসাইনের নিয়্যাত করলে সওমের সওয়াবও পাবে না; বরং গুনাহগার হবে। কারণ, কারবালার ঘটনার ৫০ বছর পূর্বেই ইসলাম পূর্ণতা লাভ করেছে এবং অহীর আগমনও বন্ধ হয়ে গেছে। বনী ইসরাঈলের অসংখ্য নবী নিজ কওমের লোকদের হাতে নিহত হয়েছেন। মুসলমানদের প্রাণপ্রিয় খলীফা হযরত ওমর (রা.) মসজিদে নববীতে ফজরের সালাতরত অবস্থায়, উসমান ৮৩ বছরের বৃদ্ধ বয়সে নিজ গৃহে কুরআন তিলাওয়াতরত অবস্থায়, হযরত আলী (রা.) ফজরের জামা'আতে যাওয়ার পথে অতর্কিত আক্রান্ত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। হাসান (৩-৪৯হিঃ)-কে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। [আল-বিদায়াহ ৮/৪৪] আশারায়ে মুবাশশারাহর অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব হযরত ত্বালহা ও যুবায়ের মর্মান্তিকভাবে শহীদ হন। তাঁদের কারো মৃত্যু হুসাইন (রা.) -এর মৃত্যুর চাইতে কম দুঃখজনক ও মর্মান্তিক ছিল না। কিন্তু কারো জন্য দিনক্ষণ নির্ধারণ করে মাতম করা ও সরকারি ছুটি ঘোষণা করে শোকদিবস পালন করার কোন রীতি সাহাবী ও তাবেয়ীদের যুগে ছিল না। ইসলামী শরী'আতে এসব নিষিদ্ধ ।
প্রকৃতপক্ষে, এ দিনটি মূসা (আ) ও তাঁর কওমের নাজাতের দিন। দুঃখ-কষ্ট থেকে পরিত্রাণ লাভের পর তাওহীদ ভিত্তিক সুখময় জীবনে পদার্পণের দিন। আল্লাহর শত্রু ফিরআউনের পতনের দিন। অত্যাচারীর করাল গ্রাস থেকে মুমিনের মুক্তির দিন। শত্রুর কবল থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে স্রষ্টার উদ্দেশ্যে মুমিনের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন। এতদভিন্ন অবান্তর কিছু ফযীলত ও শোকের নামে অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত থাকা বাঞ্ছনীয়। উপরন্তু, নবীদের রেখে যাওয়া সুন্নাতকে কোন এক সাহাবীর মৃত্যুর শোক পালনের মাধ্যমে তুচ্ছ করা ঈমানী চেতনারও পরিপন্থী। আল্লাহ আমাদেরকে সকল প্রকার শিরকী ও বিদ'আতী কর্মকাণ্ড থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন।
আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে শুব্বানের দাওয়াতী কাজে অংশ গ্রহণ করুন!
(বিকাশ পার্সোনাল) ০১৭৬৫ ৮১২২৬১
জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীস বাংলাদেশ
৭৯/ক/৩, উত্তর যাত্রাবাড়ি, ঢাকা-১২০৪,
[email protected], www.shubbanbd.org, Facebook: /shubban◈ ◈ ◈ আশুরায়ে মুহাররাম : করণীয় ও বর্জনীয় ◈ ◈ ◈

একদিকে জ্ঞানের স্বল্পতা অন্যদিকে মীর মোশাররফ হোসেন এর সাহিত্যরসে সমৃদ্ধ অথচ ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক রসদে পূর্ণ বিখ্যাত উপন্যাস 'বিষাদ সিন্ধু'র ব্যাপক জনপ্রিয়তার কল্যাণে ভারত উপমহাদেশের মুসলিমগণ ১০ই মুহাররামকে কেবল কারবালার মর্মান্তিক ইতিহাস হিসেবেই জানে। এ অঞ্চলে শীআদের সংখ্যা কম হলেও ওইদিনে সর্বত্র হুসাইন (রা.) এর শহীদ হওয়ার যে মর্মান্তিক ও হৃদয়স্পর্শী আলোচনা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ও পুলিশী প্রহরায় শোক মিছিলসহ নানা অনুষ্ঠান সাধারণ মানুষের কোমল হৃদয়ে দাগ কেটেছে। উপরন্তু, সুন্নী মুসলিমদের মধ্যেও বেশ কিছু ভণ্ড পীর-মুরীদ ও মাজারীরা এ দিনটাতে তাদের মাজার-খানকা দরবারী আয়োজনে উৎসবমুখর করে তোলে। ফলে অনেকেই এটাকে এখন ধর্মীয় একটি অনুষ্ঠান হিসেবেই বিবেচনা করে থাকে। এমতাবস্থায়, আগুরা বা ১০ই মুহাররাম কী? তা সর্বসাধারণকে জানানো আমাদের ঈমানী দাবী বলে মনে করছি।
مُحَرَّم(মুহাররাম) হিজরী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। চারটি পবিত্র মাসের মধ্যে এটি একটি (সহীহুল বুখারী: ৩১৯৭)। মুহাররাম শব্দটি "আরবী, যার অর্থ পবিত্র, সম্মানিত। প্রাচীনকাল থেকে এ মাসটি পবিত্র মাস হিসেবে গণ্য। অনুরূপ, عَاشُوْرَاء শব্দটিও আরবি, যার অর্থ দশমী বা ১০ম দিন। বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন মুহাররামের ১০ম তারিখকে আশুরা বলা হয়ে থাকে।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নাবী কারীম (সা.) যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় আসলেন তখন মদীনার ইহুদীদেরকে আশুরার সওম রাখতে দেখে তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা এদিনে কেন সওম রাখ"? উত্তরে তারা বলল, এ দিনটা অত্যন্ত পবিত্র ও সম্মানিত। কেননা, এই দিনে আল্লাহ তাআলা মূসা (আ) ও বানী ইসরাঈলকে ফেরআউনের কবল হতে পরিত্রাণ দিয়েছিলেন। এ কারণে আমরা সওমের মাধ্যমে ঈদ বা খুশি পালন করি, যেন তার স্মরণ সবসময় বিদ্যমান থাকে। রাসূলুল্লাহ বললেন, “মূসা (আ)-এর বিজয়ের দিন পালনে আমরা তোমাদের থেকে বেশী হকদার।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ নিজে সওম রাখলেন এবং সাহাবায়ে কিরামকে সপ্তম রাখার নির্দেশ দিলেন। (সহীহুল বুখারী: ২০০৪, ৩৩৯৭ ও সহীহ মুসলিম: ১১৩০)

📃 আশুরার সওয়ের সীলত:

১. আশুরার সওম ফির'আউনের কবল থেকে মূসা (আ) এর নাজাতের শুকরিয়া হিসেবে পালিত হয়।
২. এই সওম মূসা (আ) ও মুহাম্মাদী শরী'আতে চালু ছিল। আইয়ামে জাহেলিয়াতেও আশুরার সওম পালিত হত। (সহীহুল বুখারী: ২০০২)
৩. ২য় হিজরীতে রমাযানের সওম ফরয হওয়ার আগ পর্যন্ত এই সওম সকল মুসলিমের জন্য পালনীয় নিয়মিত সপ্তম হিসেবে গণ্য হত। ৪. এই সওমের ফযীলত হিসেবে বিগত এক বছরের গোনাহ মাফের কথা বলা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম: ১১৬২)
৫. এ ছাড়াও রমাযানের সপ্তমের পর মুহাররামের সওমকে শ্রেষ্ঠ সওম হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম: ১১৬৩)

📃 আশুরার প্রচলিত বিদ'আতসমূহ, যা বর্জন করতেই হবে

আশুরা উপলক্ষে মুসলিম দাবীদার ভ্রান্ত একটি দল শী'আ ও তাদের দ্বারা প্রভাবিত কতিপয় সুন্নী মিলে অগণিত শিরকী ও বিদ'আতী কর্মে লিপ্ত হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে কোটি টাকার অপচয় করা হয়। সরকারিভাবেও বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালিত হয়। মূসা (আ) এর খুশির বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ রাসূলের (সা.) সাওম পালনের এ দিনটিতে ৬১ হিজরীতে কাকতালীয়ভাবে তাঁর দৌহিত্র হুসাইন (রা.) শাহাদাত বরণ করেন। পরবর্তীকালে (৩৫২ হিজরীতে) শী'আ শাসক আহমাদ বিন বুইয়া দায়লামী ওরফে "মুইযযুদ্দৌলা" ১০ মুহাররামকে শোক দিবস ঘোষণা করে। এদিনে শীআদের অন্যতম কর্মসূচি হলো তাষিয়া প্রদর্শন করা। যার অর্থ-শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করা। তবে বিশেষ অর্থে শব্দটি হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত লাভের বিষাদময় স্মৃতিকে স্মরণ করে শী'আ সম্প্রদায়ের ওই দিনে তাঁর সমাধির প্রতীক বানিয়ে সেটা নিয়ে মিছিল করে শোক প্রকাশ করাকে বুঝায়। শী'আ মতবাদের উদ্ভব ইরাক ও ইরানে হলেও সেখানে এরূপ শোকমিছিলে তাযিয়া বহন করা হয় না। বাংলাদেশে মুঘল আমলে বিশেষত শাহ্ সুজা (১৬৩৯-১৬৫৯) বাংলার সুবেদার থাকাকালে শী'আদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। সম্ভবত, তখনই এখানে তাযিয়া মিছিলের প্রচলন হয়। [বাংলা পিডিয়া]
এভাবে তাষিয়ার নামে হুসাইন (রা.) এর ভুয়া ও বানোয়াট কবর তৈরি করে আমাদের দেশে প্রতিবছর রাজধানীসহ প্রায় প্রতিটি জেলার রাজপথে শোক মিছিল করা হয়। ঐ ভূয়া কবরে হুসাইনের রূহ হাযির হয়, ধারণা করে তাকে সালাম করা হয়। তার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে সিজদাহ করা হয়, মনোবাঞ্ছা পূরণ করার জন্য প্রার্থনা করা হয়। বুক চাপড়ানো হয়, বুকের কাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয়। “হায় হোসেন, হায় হোসেন” বলে মাতম করা হয়। লোহার শিকল ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে পেট ও পিঠে অনবরত আঘাত করে সারা শরীর রক্তাক্ত করা হয়। শিশুদের মাথায় আঘাত করে লাল রক্তে রঞ্জিত করা হয়।
আবার কোথাও কোথাও রক্তের নামে লাল রং ছিটানো হয়। রাস্তা-ঘাট রঙ-বেরঙের সাজে সাজানো হয়। হুসাইন (রা.) এর নামে “হাঁস/মোরগ পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে যুবক-যুবতীরা পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঐ বরকতের মোরগ ধরার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। সুসজ্জিত অশ্বারোহী দল লাঠি-তীর-বল্লম নিয়ে মিছিল করে কারবালা যুদ্ধের মহড়া দেয়। কালো পোষাক পরিধান বা কালো ব্যাজ ধারণ করে মিছিলের সম্মুখভাগে নারীরাও অংশ নেয়। আবার অনেকে শোকের মাস ভেবে এই মাসে বিয়ে-শাদী করা অন্যায় মনে করে। ঐ দিন অনেকে পানি পান করা এমনকি শিশুকে দুধ পান করানোও অন্যায় ভাবে।
অপরদিকে, উগ্র শী'আরা আয়েশা (রা.) এর নামে বেঁধে রাখা একটি বকরীকে লাঠিপেটা করে ও অস্ত্রাঘাতে রক্তাক্ত করে বদলা নেয় ও উল্লাসে ফেটে পড়ে। তাদের ধারণা- রাসূলের ইন্তিকালের পর আলী (রা.) খলীফা হতে পারেননি আয়েশা (রা) এর ষড়যন্ত্রের কারণে (নাউযুবিল্লাহ!)। একইভাবে ওমর, উসমান, মুআবিয়া, মুগীরা বিন শু'বা রাযিয়াল্লাহু 'আনহুম প্রমুখ সম্মানিত সাহাবীদেরকে এসময় বিভিন্নভাবে গালি দেওয়া হয়। এ ছাড়াও রেডিও-টিভি, পত্র-পত্রিকা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একথা বুঝানোর চেষ্টা করা হয় যে, আশুরায়ে মুহাররামের মূলবিষয় হল- ‘শাহাদাতে হুসাইন' (রা.) বা 'কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা' । অথচ প্রকৃত সত্য এসব থেকে অনেক দূরে।
আশুরা উপলক্ষে প্রচলিত উপর্যুক্ত বিদ'আতী অনুষ্ঠানাদির কোন অস্তিত্ব কিংবা শী'আ আক্বীদা কোন প্রমাণ সাহাবায়ে কেরামের যুগে পাওয়া যায় না। আল্লাহ ব্যতীত কাউকে সিজদা করা যেমন হারাম, তাযিয়ার নামে ভূয়া কবর যিয়ারত করাও তেমনি হারাম। এতদ্ব্যতীত কোনরূপ শোকগাঁথা বা মর্সিয়া অনুষ্ঠান বা শোকমিছিল ইসলামী শরী আর পরিপন্থী । কোন কবর বা সমাধিসৌধ, শহীদ মিনার বা স্মৃতিসৌধ, শিখা অনির্বাণ বা শিখা চিরন্তন প্রভৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করাও একই পর্যায়ে পড়ে।
অনুরূপভাবে সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহ হল সাহাবায়ে কেরামকে গালি দেওয়া। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “তোমরা আমার সাহাবীগণকে গালি দিয়ো না। কেননা (তাঁরা এমন উচ্চ মর্যাদার অধিকারী যে) তোমাদের কেউ যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, তবুও তাঁদের এক মুদ বা অর্ধ মুদ [১ মুদ= আনুমানিক ৬২৫ গ্রাম]-এর সমান সাওয়াব পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না” । (সহীহুল বুখারী: ৩৬৭৩ ও সহীহ মুসলিম: ২৫৪১)
তাছাড়া শোকের নামে দিবস পালন করা, বুক চাপড়ানো ও মাতম করা ইসলামী রীতি নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে শোকে কাতর হয়ে নিজ মুখে আঘাত করে, কাপড় ছিড়ে ফেলে ও জাহেলী যুগের মতো মাতম করে” (সহীহুল বুখারী: ১২৯৭ ও সহীহ মুসলিম: ১০৩)। অধিকন্তু, ঐসব শোকসভা বা শোক মিছিলে বাড়াবাড়ি করে সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তার পার্থক্য ভুলে হুসাইনের কবরে রূহের আগমন কল্পনা করা, সেখানে সিজদা করা, মাথা ঝুঁকানো, প্রার্থনা নিবেদন করা ইত্যাদি
পরিষ্কারভাবে শিরকের নামান্তর।

📃 আশুরায় আমাদের করণীয়

আশুরা উপলক্ষ্যে মুহাররামের ৯ ও ১০ তারিখ সওম পালন ছাড়া অন্য বিশেষ কোন ইবাদত নেই। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যখন আশুরার দিন সওম পালন করেন এবং লোকদেরকে সওম পালনের নির্দেশ দেন, তখন সাহাবীগণ বললেন, হে রাসূল (সা.) ! ইয়াহুদ এবং নাসারা এ দিনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ইন্‌শা আল্লাহ আগামী বছর আমরা ৯ তারিখেও সওম পালন করব । বর্ণনাকারী বলেন, , আগামী বছর আসার আগেই রাসূলুল্লাহ (সা.) মৃত্যু বরণ করেন । (সহীহ মুসলিম: ১১৩৪ ও ১৯১৬)
তবে হুসাইন (রা.) সহ সকল মৃত মুসলিমের জন্য 'আমভাবে দু'আ করা দূষণীয় নয় । সালাফগণ হুসাইন এর মর্মান্তিক মৃত্যুতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন । কিন্তু তাতে বাড়াবাড়ি করে শী'আদের ন্যায় ঐদিনকে শোক দিবস মনে করেন না। দুঃখ প্রকাশের ইসলামী রীতি হল: “ইন্না লিল্লা-হি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন' পাঠ করা (বাক্বারাহ ১৫৬) ও তাঁদের মুক্তির জন্য দু'আ করা । একথা সন্দেহাতীত যে, আশুরার সওমের সাথে হুসাইন (রা.) বিন আলী এর জন্ম বা মৃত্যুর কোন সম্পর্ক নেই। হুসাইন (রা.) এর জন্ম মদীনায় ৪র্থ হিজরীতে এবং মৃত্যু ইরাকের কুফা নগরীর নিকটবর্তী কারবালায় ৬১ হিজরীতে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মৃত্যুর ৫০ বছর পর ।
(ইবনু হাজার, আল-ইসাবাহ (২/৬৭-৭২, জীবনী: ১৭২৯)
সুতরাং শাহাদাতে হুসাইনের নিয়্যাতে পূর্ববর্ণিত সকল শিরকী ও বিদ'আতী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হবে এবং অন্যকে বিরত থাকার উপদেশ দিতে হবে। এদিনে সওম পালনকারী শাহাদাতে হুসাইনের নিয়্যাত করলে সওমের সওয়াবও পাবে না; বরং গুনাহগার হবে। কারণ, কারবালার ঘটনার ৫০ বছর পূর্বেই ইসলাম পূর্ণতা লাভ করেছে এবং অহীর আগমনও বন্ধ হয়ে গেছে। বনী ইসরাঈলের অসংখ্য নবী নিজ কওমের লোকদের হাতে নিহত হয়েছেন। মুসলমানদের প্রাণপ্রিয় খলীফা হযরত ওমর (রা.) মসজিদে নববীতে ফজরের সালাতরত অবস্থায়, উসমান ৮৩ বছরের বৃদ্ধ বয়সে নিজ গৃহে কুরআন তিলাওয়াতরত অবস্থায়, হযরত আলী (রা.) ফজরের জামা'আতে যাওয়ার পথে অতর্কিত আক্রান্ত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। হাসান (৩-৪৯হিঃ)-কে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। [আল-বিদায়াহ ৮/৪৪] আশারায়ে মুবাশশারাহর অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব হযরত ত্বালহা ও যুবায়ের মর্মান্তিকভাবে শহীদ হন। তাঁদের কারো মৃত্যু হুসাইন (রা.) -এর মৃত্যুর চাইতে কম দুঃখজনক ও মর্মান্তিক ছিল না। কিন্তু কারো জন্য দিনক্ষণ নির্ধারণ করে মাতম করা ও সরকারি ছুটি ঘোষণা করে শোকদিবস পালন করার কোন রীতি সাহাবী ও তাবেয়ীদের যুগে ছিল না। ইসলামী শরী'আতে এসব নিষিদ্ধ ।
প্রকৃতপক্ষে, এ দিনটি মূসা (আ) ও তাঁর কওমের নাজাতের দিন। দুঃখ-কষ্ট থেকে পরিত্রাণ লাভের পর তাওহীদ ভিত্তিক সুখময় জীবনে পদার্পণের দিন। আল্লাহর শত্রু ফিরআউনের পতনের দিন। অত্যাচারীর করাল গ্রাস থেকে মুমিনের মুক্তির দিন। শত্রুর কবল থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে স্রষ্টার উদ্দেশ্যে মুমিনের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন। এতদভিন্ন অবান্তর কিছু ফযীলত ও শোকের নামে অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত থাকা বাঞ্ছনীয়। উপরন্তু, নবীদের রেখে যাওয়া সুন্নাতকে কোন এক সাহাবীর মৃত্যুর শোক পালনের মাধ্যমে তুচ্ছ করা ঈমানী চেতনারও পরিপন্থী। আল্লাহ আমাদেরকে সকল প্রকার শিরকী ও বিদ'আতী কর্মকাণ্ড থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন।
আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে শুব্বানের দাওয়াতী কাজে অংশ গ্রহণ করুন!
(বিকাশ পার্সোনাল) ০১৭৬৫ ৮১২২৬১
জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীস বাংলাদেশ
৭৯/ক/৩, উত্তর যাত্রাবাড়ি, ঢাকা-১২০৪,
[email protected], www.shubbanbd.org, Facebook: /shubban◈ ◈ ◈ আশুরায়ে মুহাররাম : করণীয় ও বর্জনীয় ◈ ◈ ◈

একদিকে জ্ঞানের স্বল্পতা অন্যদিকে মীর মোশাররফ হোসেন এর সাহিত্যরসে সমৃদ্ধ অথচ ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক রসদে পূর্ণ বিখ্যাত উপন্যাস 'বিষাদ সিন্ধু'র ব্যাপক জনপ্রিয়তার কল্যাণে ভারত উপমহাদেশের মুসলিমগণ ১০ই মুহাররামকে কেবল কারবালার মর্মান্তিক ইতিহাস হিসেবেই জানে। এ অঞ্চলে শীআদের সংখ্যা কম হলেও ওইদিনে সর্বত্র হুসাইন (রা.) এর শহীদ হওয়ার যে মর্মান্তিক ও হৃদয়স্পর্শী আলোচনা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ও পুলিশী প্রহরায় শোক মিছিলসহ নানা অনুষ্ঠান সাধারণ মানুষের কোমল হৃদয়ে দাগ কেটেছে। উপরন্তু, সুন্নী মুসলিমদের মধ্যেও বেশ কিছু ভণ্ড পীর-মুরীদ ও মাজারীরা এ দিনটাতে তাদের মাজার-খানকা দরবারী আয়োজনে উৎসবমুখর করে তোলে। ফলে অনেকেই এটাকে এখন ধর্মীয় একটি অনুষ্ঠান হিসেবেই বিবেচনা করে থাকে। এমতাবস্থায়, আগুরা বা ১০ই মুহাররাম কী? তা সর্বসাধারণকে জানানো আমাদের ঈমানী দাবী বলে মনে করছি।
مُحَرَّم(মুহাররাম) হিজরী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। চারটি পবিত্র মাসের মধ্যে এটি একটি (সহীহুল বুখারী: ৩১৯৭)। মুহাররাম শব্দটি "আরবী, যার অর্থ পবিত্র, সম্মানিত। প্রাচীনকাল থেকে এ মাসটি পবিত্র মাস হিসেবে গণ্য। অনুরূপ, عَاشُوْرَاء শব্দটিও আরবি, যার অর্থ দশমী বা ১০ম দিন। বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন মুহাররামের ১০ম তারিখকে আশুরা বলা হয়ে থাকে।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নাবী কারীম (সা.) যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় আসলেন তখন মদীনার ইহুদীদেরকে আশুরার সওম রাখতে দেখে তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা এদিনে কেন সওম রাখ"? উত্তরে তারা বলল, এ দিনটা অত্যন্ত পবিত্র ও সম্মানিত। কেননা, এই দিনে আল্লাহ তাআলা মূসা (আ) ও বানী ইসরাঈলকে ফেরআউনের কবল হতে পরিত্রাণ দিয়েছিলেন। এ কারণে আমরা সওমের মাধ্যমে ঈদ বা খুশি পালন করি, যেন তার স্মরণ সবসময় বিদ্যমান থাকে। রাসূলুল্লাহ বললেন, “মূসা (আ)-এর বিজয়ের দিন পালনে আমরা তোমাদের থেকে বেশী হকদার।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ নিজে সওম রাখলেন এবং সাহাবায়ে কিরামকে সপ্তম রাখার নির্দেশ দিলেন। (সহীহুল বুখারী: ২০০৪, ৩৩৯৭ ও সহীহ মুসলিম: ১১৩০)

📃 আশুরার সওয়ের সীলত:

১. আশুরার সওম ফির'আউনের কবল থেকে মূসা (আ) এর নাজাতের শুকরিয়া হিসেবে পালিত হয়।
২. এই সওম মূসা (আ) ও মুহাম্মাদী শরী'আতে চালু ছিল। আইয়ামে জাহেলিয়াতেও আশুরার সওম পালিত হত। (সহীহুল বুখারী: ২০০২)
৩. ২য় হিজরীতে রমাযানের সওম ফরয হওয়ার আগ পর্যন্ত এই সওম সকল মুসলিমের জন্য পালনীয় নিয়মিত সপ্তম হিসেবে গণ্য হত। ৪. এই সওমের ফযীলত হিসেবে বিগত এক বছরের গোনাহ মাফের কথা বলা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম: ১১৬২)
৫. এ ছাড়াও রমাযানের সপ্তমের পর মুহাররামের সওমকে শ্রেষ্ঠ সওম হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম: ১১৬৩)

📃 আশুরার প্রচলিত বিদ'আতসমূহ, যা বর্জন করতেই হবে

আশুরা উপলক্ষে মুসলিম দাবীদার ভ্রান্ত একটি দল শী'আ ও তাদের দ্বারা প্রভাবিত কতিপয় সুন্নী মিলে অগণিত শিরকী ও বিদ'আতী কর্মে লিপ্ত হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে কোটি টাকার অপচয় করা হয়। সরকারিভাবেও বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালিত হয়। মূসা (আ) এর খুশির বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ রাসূলের (সা.) সাওম পালনের এ দিনটিতে ৬১ হিজরীতে কাকতালীয়ভাবে তাঁর দৌহিত্র হুসাইন (রা.) শাহাদাত বরণ করেন। পরবর্তীকালে (৩৫২ হিজরীতে) শী'আ শাসক আহমাদ বিন বুইয়া দায়লামী ওরফে "মুইযযুদ্দৌলা" ১০ মুহাররামকে শোক দিবস ঘোষণা করে। এদিনে শীআদের অন্যতম কর্মসূচি হলো তাষিয়া প্রদর্শন করা। যার অর্থ-শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করা। তবে বিশেষ অর্থে শব্দটি হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত লাভের বিষাদময় স্মৃতিকে স্মরণ করে শী'আ সম্প্রদায়ের ওই দিনে তাঁর সমাধির প্রতীক বানিয়ে সেটা নিয়ে মিছিল করে শোক প্রকাশ করাকে বুঝায়। শী'আ মতবাদের উদ্ভব ইরাক ও ইরানে হলেও সেখানে এরূপ শোকমিছিলে তাযিয়া বহন করা হয় না। বাংলাদেশে মুঘল আমলে বিশেষত শাহ্ সুজা (১৬৩৯-১৬৫৯) বাংলার সুবেদার থাকাকালে শী'আদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। সম্ভবত, তখনই এখানে তাযিয়া মিছিলের প্রচলন হয়। [বাংলা পিডিয়া]
এভাবে তাষিয়ার নামে হুসাইন (রা.) এর ভুয়া ও বানোয়াট কবর তৈরি করে আমাদের দেশে প্রতিবছর রাজধানীসহ প্রায় প্রতিটি জেলার রাজপথে শোক মিছিল করা হয়। ঐ ভূয়া কবরে হুসাইনের রূহ হাযির হয়, ধারণা করে তাকে সালাম করা হয়। তার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে সিজদাহ করা হয়, মনোবাঞ্ছা পূরণ করার জন্য প্রার্থনা করা হয়। বুক চাপড়ানো হয়, বুকের কাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয়। “হায় হোসেন, হায় হোসেন” বলে মাতম করা হয়। লোহার শিকল ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে পেট ও পিঠে অনবরত আঘাত করে সারা শরীর রক্তাক্ত করা হয়। শিশুদের মাথায় আঘাত করে লাল রক্তে রঞ্জিত করা হয়।
আবার কোথাও কোথাও রক্তের নামে লাল রং ছিটানো হয়। রাস্তা-ঘাট রঙ-বেরঙের সাজে সাজানো হয়। হুসাইন (রা.) এর নামে “হাঁস/মোরগ পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে যুবক-যুবতীরা পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঐ বরকতের মোরগ ধরার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। সুসজ্জিত অশ্বারোহী দল লাঠি-তীর-বল্লম নিয়ে মিছিল করে কারবালা যুদ্ধের মহড়া দেয়। কালো পোষাক পরিধান বা কালো ব্যাজ ধারণ করে মিছিলের সম্মুখভাগে নারীরাও অংশ নেয়। আবার অনেকে শোকের মাস ভেবে এই মাসে বিয়ে-শাদী করা অন্যায় মনে করে। ঐ দিন অনেকে পানি পান করা এমনকি শিশুকে দুধ পান করানোও অন্যায় ভাবে।
অপরদিকে, উগ্র শী'আরা আয়েশা (রা.) এর নামে বেঁধে রাখা একটি বকরীকে লাঠিপেটা করে ও অস্ত্রাঘাতে রক্তাক্ত করে বদলা নেয় ও উল্লাসে ফেটে পড়ে। তাদের ধারণা- রাসূলের ইন্তিকালের পর আলী (রা.) খলীফা হতে পারেননি আয়েশা (রা) এর ষড়যন্ত্রের কারণে (নাউযুবিল্লাহ!)। একইভাবে ওমর, উসমান, মুআবিয়া, মুগীরা বিন শু'বা রাযিয়াল্লাহু 'আনহুম প্রমুখ সম্মানিত সাহাবীদেরকে এসময় বিভিন্নভাবে গালি দেওয়া হয়। এ ছাড়াও রেডিও-টিভি, পত্র-পত্রিকা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একথা বুঝানোর চেষ্টা করা হয় যে, আশুরায়ে মুহাররামের মূলবিষয় হল- ‘শাহাদাতে হুসাইন' (রা.) বা 'কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা' । অথচ প্রকৃত সত্য এসব থেকে অনেক দূরে।
আশুরা উপলক্ষে প্রচলিত উপর্যুক্ত বিদ'আতী অনুষ্ঠানাদির কোন অস্তিত্ব কিংবা শী'আ আক্বীদা কোন প্রমাণ সাহাবায়ে কেরামের যুগে পাওয়া যায় না। আল্লাহ ব্যতীত কাউকে সিজদা করা যেমন হারাম, তাযিয়ার নামে ভূয়া কবর যিয়ারত করাও তেমনি হারাম। এতদ্ব্যতীত কোনরূপ শোকগাঁথা বা মর্সিয়া অনুষ্ঠান বা শোকমিছিল ইসলামী শরী আর পরিপন্থী । কোন কবর বা সমাধিসৌধ, শহীদ মিনার বা স্মৃতিসৌধ, শিখা অনির্বাণ বা শিখা চিরন্তন প্রভৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করাও একই পর্যায়ে পড়ে।
অনুরূপভাবে সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহ হল সাহাবায়ে কেরামকে গালি দেওয়া। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “তোমরা আমার সাহাবীগণকে গালি দিয়ো না। কেননা (তাঁরা এমন উচ্চ মর্যাদার অধিকারী যে) তোমাদের কেউ যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, তবুও তাঁদের এক মুদ বা অর্ধ মুদ [১ মুদ= আনুমানিক ৬২৫ গ্রাম]-এর সমান সাওয়াব পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না” । (সহীহুল বুখারী: ৩৬৭৩ ও সহীহ মুসলিম: ২৫৪১)
তাছাড়া শোকের নামে দিবস পালন করা, বুক চাপড়ানো ও মাতম করা ইসলামী রীতি নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে শোকে কাতর হয়ে নিজ মুখে আঘাত করে, কাপড় ছিড়ে ফেলে ও জাহেলী যুগের মতো মাতম করে” (সহীহুল বুখারী: ১২৯৭ ও সহীহ মুসলিম: ১০৩)। অধিকন্তু, ঐসব শোকসভা বা শোক মিছিলে বাড়াবাড়ি করে সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তার পার্থক্য ভুলে হুসাইনের কবরে রূহের আগমন কল্পনা করা, সেখানে সিজদা করা, মাথা ঝুঁকানো, প্রার্থনা নিবেদন করা ইত্যাদি
পরিষ্কারভাবে শিরকের নামান্তর।

📃 আশুরায় আমাদের করণীয়

আশুরা উপলক্ষ্যে মুহাররামের ৯ ও ১০ তারিখ সওম পালন ছাড়া অন্য বিশেষ কোন ইবাদত নেই। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যখন আশুরার দিন সওম পালন করেন এবং লোকদেরকে সওম পালনের নির্দেশ দেন, তখন সাহাবীগণ বললেন, হে রাসূল (সা.) ! ইয়াহুদ এবং নাসারা এ দিনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ইন্‌শা আল্লাহ আগামী বছর আমরা ৯ তারিখেও সওম পালন করব । বর্ণনাকারী বলেন, , আগামী বছর আসার আগেই রাসূলুল্লাহ (সা.) মৃত্যু বরণ করেন । (সহীহ মুসলিম: ১১৩৪ ও ১৯১৬)
তবে হুসাইন (রা.) সহ সকল মৃত মুসলিমের জন্য 'আমভাবে দু'আ করা দূষণীয় নয় । সালাফগণ হুসাইন এর মর্মান্তিক মৃত্যুতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন । কিন্তু তাতে বাড়াবাড়ি করে শী'আদের ন্যায় ঐদিনকে শোক দিবস মনে করেন না। দুঃখ প্রকাশের ইসলামী রীতি হল: “ইন্না লিল্লা-হি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন' পাঠ করা (বাক্বারাহ ১৫৬) ও তাঁদের মুক্তির জন্য দু'আ করা । একথা সন্দেহাতীত যে, আশুরার সওমের সাথে হুসাইন (রা.) বিন আলী এর জন্ম বা মৃত্যুর কোন সম্পর্ক নেই। হুসাইন (রা.) এর জন্ম মদীনায় ৪র্থ হিজরীতে এবং মৃত্যু ইরাকের কুফা নগরীর নিকটবর্তী কারবালায় ৬১ হিজরীতে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মৃত্যুর ৫০ বছর পর ।
(ইবনু হাজার, আল-ইসাবাহ (২/৬৭-৭২, জীবনী: ১৭২৯)
সুতরাং শাহাদাতে হুসাইনের নিয়্যাতে পূর্ববর্ণিত সকল শিরকী ও বিদ'আতী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হবে এবং অন্যকে বিরত থাকার উপদেশ দিতে হবে। এদিনে সওম পালনকারী শাহাদাতে হুসাইনের নিয়্যাত করলে সওমের সওয়াবও পাবে না; বরং গুনাহগার হবে। কারণ, কারবালার ঘটনার ৫০ বছর পূর্বেই ইসলাম পূর্ণতা লাভ করেছে এবং অহীর আগমনও বন্ধ হয়ে গেছে। বনী ইসরাঈলের অসংখ্য নবী নিজ কওমের লোকদের হাতে নিহত হয়েছেন। মুসলমানদের প্রাণপ্রিয় খলীফা হযরত ওমর (রা.) মসজিদে নববীতে ফজরের সালাতরত অবস্থায়, উসমান ৮৩ বছরের বৃদ্ধ বয়সে নিজ গৃহে কুরআন তিলাওয়াতরত অবস্থায়, হযরত আলী (রা.) ফজরের জামা'আতে যাওয়ার পথে অতর্কিত আক্রান্ত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। হাসান (৩-৪৯হিঃ)-কে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। [আল-বিদায়াহ ৮/৪৪] আশারায়ে মুবাশশারাহর অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব হযরত ত্বালহা ও যুবায়ের মর্মান্তিকভাবে শহীদ হন। তাঁদের কারো মৃত্যু হুসাইন (রা.) -এর মৃত্যুর চাইতে কম দুঃখজনক ও মর্মান্তিক ছিল না। কিন্তু কারো জন্য দিনক্ষণ নির্ধারণ করে মাতম করা ও সরকারি ছুটি ঘোষণা করে শোকদিবস পালন করার কোন রীতি সাহাবী ও তাবেয়ীদের যুগে ছিল না। ইসলামী শরী'আতে এসব নিষিদ্ধ ।
প্রকৃতপক্ষে, এ দিনটি মূসা (আ) ও তাঁর কওমের নাজাতের দিন। দুঃখ-কষ্ট থেকে পরিত্রাণ লাভের পর তাওহীদ ভিত্তিক সুখময় জীবনে পদার্পণের দিন। আল্লাহর শত্রু ফিরআউনের পতনের দিন। অত্যাচারীর করাল গ্রাস থেকে মুমিনের মুক্তির দিন। শত্রুর কবল থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে স্রষ্টার উদ্দেশ্যে মুমিনের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন। এতদভিন্ন অবান্তর কিছু ফযীলত ও শোকের নামে অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত থাকা বাঞ্ছনীয়। উপরন্তু, নবীদের রেখে যাওয়া সুন্নাতকে কোন এক সাহাবীর মৃত্যুর শোক পালনের মাধ্যমে তুচ্ছ করা ঈমানী চেতনারও পরিপন্থী। আল্লাহ আমাদেরকে সকল প্রকার শিরকী ও বিদ'আতী কর্মকাণ্ড থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন।
আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে শুব্বানের দাওয়াতী কাজে অংশ গ্রহণ করুন!
(বিকাশ পার্সোনাল) ০১৭৬৫ ৮১২২৬১
জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীস বাংলাদেশ
৭৯/ক/৩, উত্তর যাত্রাবাড়ি, ঢাকা-১২০৪,
[email protected], www.shubbanbd.org, Facebook: /shubban◈ ◈ ◈ আশুরায়ে মুহাররাম : করণীয় ও বর্জনীয় ◈ ◈ ◈

একদিকে জ্ঞানের স্বল্পতা অন্যদিকে মীর মোশাররফ হোসেন এর সাহিত্যরসে সমৃদ্ধ অথচ ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক রসদে পূর্ণ বিখ্যাত উপন্যাস 'বিষাদ সিন্ধু'র ব্যাপক জনপ্রিয়তার কল্যাণে ভারত উপমহাদেশের মুসলিমগণ ১০ই মুহাররামকে কেবল কারবালার মর্মান্তিক ইতিহাস হিসেবেই জানে। এ অঞ্চলে শীআদের সংখ্যা কম হলেও ওইদিনে সর্বত্র হুসাইন (রা.) এর শহীদ হওয়ার যে মর্মান্তিক ও হৃদয়স্পর্শী আলোচনা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ও পুলিশী প্রহরায় শোক মিছিলসহ নানা অনুষ্ঠান সাধারণ মানুষের কোমল হৃদয়ে দাগ কেটেছে। উপরন্তু, সুন্নী মুসলিমদের মধ্যেও বেশ কিছু ভণ্ড পীর-মুরীদ ও মাজারীরা এ দিনটাতে তাদের মাজার-খানকা দরবারী আয়োজনে উৎসবমুখর করে তোলে। ফলে অনেকেই এটাকে এখন ধর্মীয় একটি অনুষ্ঠান হিসেবেই বিবেচনা করে থাকে। এমতাবস্থায়, আগুরা বা ১০ই মুহাররাম কী? তা সর্বসাধারণকে জানানো আমাদের ঈমানী দাবী বলে মনে করছি।
مُحَرَّم(মুহাররাম) হিজরী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। চারটি পবিত্র মাসের মধ্যে এটি একটি (সহীহুল বুখারী: ৩১৯৭)। মুহাররাম শব্দটি "আরবী, যার অর্থ পবিত্র, সম্মানিত। প্রাচীনকাল থেকে এ মাসটি পবিত্র মাস হিসেবে গণ্য। অনুরূপ, عَاشُوْرَاء শব্দটিও আরবি, যার অর্থ দশমী বা ১০ম দিন। বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন মুহাররামের ১০ম তারিখকে আশুরা বলা হয়ে থাকে।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নাবী কারীম (সা.) যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় আসলেন তখন মদীনার ইহুদীদেরকে আশুরার সওম রাখতে দেখে তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা এদিনে কেন সওম রাখ"? উত্তরে তারা বলল, এ দিনটা অত্যন্ত পবিত্র ও সম্মানিত। কেননা, এই দিনে আল্লাহ তাআলা মূসা (আ) ও বানী ইসরাঈলকে ফেরআউনের কবল হতে পরিত্রাণ দিয়েছিলেন। এ কারণে আমরা সওমের মাধ্যমে ঈদ বা খুশি পালন করি, যেন তার স্মরণ সবসময় বিদ্যমান থাকে। রাসূলুল্লাহ বললেন, “মূসা (আ)-এর বিজয়ের দিন পালনে আমরা তোমাদের থেকে বেশী হকদার।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ নিজে সওম রাখলেন এবং সাহাবায়ে কিরামকে সপ্তম রাখার নির্দেশ দিলেন। (সহীহুল বুখারী: ২০০৪, ৩৩৯৭ ও সহীহ মুসলিম: ১১৩০)

📃 আশুরার সওয়ের সীলত:

১. আশুরার সওম ফির'আউনের কবল থেকে মূসা (আ) এর নাজাতের শুকরিয়া হিসেবে পালিত হয়।
২. এই সওম মূসা (আ) ও মুহাম্মাদী শরী'আতে চালু ছিল। আইয়ামে জাহেলিয়াতেও আশুরার সওম পালিত হত। (সহীহুল বুখারী: ২০০২)
৩. ২য় হিজরীতে রমাযানের সওম ফরয হওয়ার আগ পর্যন্ত এই সওম সকল মুসলিমের জন্য পালনীয় নিয়মিত সপ্তম হিসেবে গণ্য হত। ৪. এই সওমের ফযীলত হিসেবে বিগত এক বছরের গোনাহ মাফের কথা বলা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম: ১১৬২)
৫. এ ছাড়াও রমাযানের সপ্তমের পর মুহাররামের সওমকে শ্রেষ্ঠ সওম হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম: ১১৬৩)

📃 আশুরার প্রচলিত বিদ'আতসমূহ, যা বর্জন করতেই হবে

আশুরা উপলক্ষে মুসলিম দাবীদার ভ্রান্ত একটি দল শী'আ ও তাদের দ্বারা প্রভাবিত কতিপয় সুন্নী মিলে অগণিত শিরকী ও বিদ'আতী কর্মে লিপ্ত হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে কোটি টাকার অপচয় করা হয়। সরকারিভাবেও বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালিত হয়। মূসা (আ) এর খুশির বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ রাসূলের (সা.) সাওম পালনের এ দিনটিতে ৬১ হিজরীতে কাকতালীয়ভাবে তাঁর দৌহিত্র হুসাইন (রা.) শাহাদাত বরণ করেন। পরবর্তীকালে (৩৫২ হিজরীতে) শী'আ শাসক আহমাদ বিন বুইয়া দায়লামী ওরফে "মুইযযুদ্দৌলা" ১০ মুহাররামকে শোক দিবস ঘোষণা করে। এদিনে শীআদের অন্যতম কর্মসূচি হলো তাষিয়া প্রদর্শন করা। যার অর্থ-শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করা। তবে বিশেষ অর্থে শব্দটি হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত লাভের বিষাদময় স্মৃতিকে স্মরণ করে শী'আ সম্প্রদায়ের ওই দিনে তাঁর সমাধির প্রতীক বানিয়ে সেটা নিয়ে মিছিল করে শোক প্রকাশ করাকে বুঝায়। শী'আ মতবাদের উদ্ভব ইরাক ও ইরানে হলেও সেখানে এরূপ শোকমিছিলে তাযিয়া বহন করা হয় না। বাংলাদেশে মুঘল আমলে বিশেষত শাহ্ সুজা (১৬৩৯-১৬৫৯) বাংলার সুবেদার থাকাকালে শী'আদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। সম্ভবত, তখনই এখানে তাযিয়া মিছিলের প্রচলন হয়। [বাংলা পিডিয়া]
এভাবে তাষিয়ার নামে হুসাইন (রা.) এর ভুয়া ও বানোয়াট কবর তৈরি করে আমাদের দেশে প্রতিবছর রাজধানীসহ প্রায় প্রতিটি জেলার রাজপথে শোক মিছিল করা হয়। ঐ ভূয়া কবরে হুসাইনের রূহ হাযির হয়, ধারণা করে তাকে সালাম করা হয়। তার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে সিজদাহ করা হয়, মনোবাঞ্ছা পূরণ করার জন্য প্রার্থনা করা হয়। বুক চাপড়ানো হয়, বুকের কাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয়। “হায় হোসেন, হায় হোসেন” বলে মাতম করা হয়। লোহার শিকল ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে পেট ও পিঠে অনবরত আঘাত করে সারা শরীর রক্তাক্ত করা হয়। শিশুদের মাথায় আঘাত করে লাল রক্তে রঞ্জিত করা হয়।
আবার কোথাও কোথাও রক্তের নামে লাল রং ছিটানো হয়। রাস্তা-ঘাট রঙ-বেরঙের সাজে সাজানো হয়। হুসাইন (রা.) এর নামে “হাঁস/মোরগ পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে যুবক-যুবতীরা পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঐ বরকতের মোরগ ধরার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। সুসজ্জিত অশ্বারোহী দল লাঠি-তীর-বল্লম নিয়ে মিছিল করে কারবালা যুদ্ধের মহড়া দেয়। কালো পোষাক পরিধান বা কালো ব্যাজ ধারণ করে মিছিলের সম্মুখভাগে নারীরাও অংশ নেয়। আবার অনেকে শোকের মাস ভেবে এই মাসে বিয়ে-শাদী করা অন্যায় মনে করে। ঐ দিন অনেকে পানি পান করা এমনকি শিশুকে দুধ পান করানোও অন্যায় ভাবে।
অপরদিকে, উগ্র শী'আরা আয়েশা (রা.) এর নামে বেঁধে রাখা একটি বকরীকে লাঠিপেটা করে ও অস্ত্রাঘাতে রক্তাক্ত করে বদলা নেয় ও উল্লাসে ফেটে পড়ে। তাদের ধারণা- রাসূলের ইন্তিকালের পর আলী (রা.) খলীফা হতে পারেননি আয়েশা (রা) এর ষড়যন্ত্রের কারণে (নাউযুবিল্লাহ!)। একইভাবে ওমর, উসমান, মুআবিয়া, মুগীরা বিন শু'বা রাযিয়াল্লাহু 'আনহুম প্রমুখ সম্মানিত সাহাবীদেরকে এসময় বিভিন্নভাবে গালি দেওয়া হয়। এ ছাড়াও রেডিও-টিভি, পত্র-পত্রিকা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একথা বুঝানোর চেষ্টা করা হয় যে, আশুরায়ে মুহাররামের মূলবিষয় হল- ‘শাহাদাতে হুসাইন' (রা.) বা 'কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা' । অথচ প্রকৃত সত্য এসব থেকে অনেক দূরে।
আশুরা উপলক্ষে প্রচলিত উপর্যুক্ত বিদ'আতী অনুষ্ঠানাদির কোন অস্তিত্ব কিংবা শী'আ আক্বীদা কোন প্রমাণ সাহাবায়ে কেরামের যুগে পাওয়া যায় না। আল্লাহ ব্যতীত কাউকে সিজদা করা যেমন হারাম, তাযিয়ার নামে ভূয়া কবর যিয়ারত করাও তেমনি হারাম। এতদ্ব্যতীত কোনরূপ শোকগাঁথা বা মর্সিয়া অনুষ্ঠান বা শোকমিছিল ইসলামী শরী আর পরিপন্থী । কোন কবর বা সমাধিসৌধ, শহীদ মিনার বা স্মৃতিসৌধ, শিখা অনির্বাণ বা শিখা চিরন্তন প্রভৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করাও একই পর্যায়ে পড়ে।
অনুরূপভাবে সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহ হল সাহাবায়ে কেরামকে গালি দেওয়া। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “তোমরা আমার সাহাবীগণকে গালি দিয়ো না। কেননা (তাঁরা এমন উচ্চ মর্যাদার অধিকারী যে) তোমাদের কেউ যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, তবুও তাঁদের এক মুদ বা অর্ধ মুদ [১ মুদ= আনুমানিক ৬২৫ গ্রাম]-এর সমান সাওয়াব পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না” । (সহীহুল বুখারী: ৩৬৭৩ ও সহীহ মুসলিম: ২৫৪১)
তাছাড়া শোকের নামে দিবস পালন করা, বুক চাপড়ানো ও মাতম করা ইসলামী রীতি নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে শোকে কাতর হয়ে নিজ মুখে আঘাত করে, কাপড় ছিড়ে ফেলে ও জাহেলী যুগের মতো মাতম করে” (সহীহুল বুখারী: ১২৯৭ ও সহীহ মুসলিম: ১০৩)। অধিকন্তু, ঐসব শোকসভা বা শোক মিছিলে বাড়াবাড়ি করে সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তার পার্থক্য ভুলে হুসাইনের কবরে রূহের আগমন কল্পনা করা, সেখানে সিজদা করা, মাথা ঝুঁকানো, প্রার্থনা নিবেদন করা ইত্যাদি
পরিষ্কারভাবে শিরকের নামান্তর।

📃 আশুরায় আমাদের করণীয়

আশুরা উপলক্ষ্যে মুহাররামের ৯ ও ১০ তারিখ সওম পালন ছাড়া অন্য বিশেষ কোন ইবাদত নেই। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যখন আশুরার দিন সওম পালন করেন এবং লোকদেরকে সওম পালনের নির্দেশ দেন, তখন সাহাবীগণ বললেন, হে রাসূল (সা.) ! ইয়াহুদ এবং নাসারা এ দিনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ইন্‌শা আল্লাহ আগামী বছর আমরা ৯ তারিখেও সওম পালন করব । বর্ণনাকারী বলেন, , আগামী বছর আসার আগেই রাসূলুল্লাহ (সা.) মৃত্যু বরণ করেন । (সহীহ মুসলিম: ১১৩৪ ও ১৯১৬)
তবে হুসাইন (রা.) সহ সকল মৃত মুসলিমের জন্য 'আমভাবে দু'আ করা দূষণীয় নয় । সালাফগণ হুসাইন এর মর্মান্তিক মৃত্যুতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন । কিন্তু তাতে বাড়াবাড়ি করে শী'আদের ন্যায় ঐদিনকে শোক দিবস মনে করেন না। দুঃখ প্রকাশের ইসলামী রীতি হল: “ইন্না লিল্লা-হি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন' পাঠ করা (বাক্বারাহ ১৫৬) ও তাঁদের মুক্তির জন্য দু'আ করা । একথা সন্দেহাতীত যে, আশুরার সওমের সাথে হুসাইন (রা.) বিন আলী এর জন্ম বা মৃত্যুর কোন সম্পর্ক নেই। হুসাইন (রা.) এর জন্ম মদীনায় ৪র্থ হিজরীতে এবং মৃত্যু ইরাকের কুফা নগরীর নিকটবর্তী কারবালায় ৬১ হিজরীতে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মৃত্যুর ৫০ বছর পর ।
(ইবনু হাজার, আল-ইসাবাহ (২/৬৭-৭২, জীবনী: ১৭২৯)
সুতরাং শাহাদাতে হুসাইনের নিয়্যাতে পূর্ববর্ণিত সকল শিরকী ও বিদ'আতী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হবে এবং অন্যকে বিরত থাকার উপদেশ দিতে হবে। এদিনে সওম পালনকারী শাহাদাতে হুসাইনের নিয়্যাত করলে সওমের সওয়াবও পাবে না; বরং গুনাহগার হবে। কারণ, কারবালার ঘটনার ৫০ বছর পূর্বেই ইসলাম পূর্ণতা লাভ করেছে এবং অহীর আগমনও বন্ধ হয়ে গেছে। বনী ইসরাঈলের অসংখ্য নবী নিজ কওমের লোকদের হাতে নিহত হয়েছেন। মুসলমানদের প্রাণপ্রিয় খলীফা হযরত ওমর (রা.) মসজিদে নববীতে ফজরের সালাতরত অবস্থায়, উসমান ৮৩ বছরের বৃদ্ধ বয়সে নিজ গৃহে কুরআন তিলাওয়াতরত অবস্থায়, হযরত আলী (রা.) ফজরের জামা'আতে যাওয়ার পথে অতর্কিত আক্রান্ত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। হাসান (৩-৪৯হিঃ)-কে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। [আল-বিদায়াহ ৮/৪৪] আশারায়ে মুবাশশারাহর অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব হযরত ত্বালহা ও যুবায়ের মর্মান্তিকভাবে শহীদ হন। তাঁদের কারো মৃত্যু হুসাইন (রা.) -এর মৃত্যুর চাইতে কম দুঃখজনক ও মর্মান্তিক ছিল না। কিন্তু কারো জন্য দিনক্ষণ নির্ধারণ করে মাতম করা ও সরকারি ছুটি ঘোষণা করে শোকদিবস পালন করার কোন রীতি সাহাবী ও তাবেয়ীদের যুগে ছিল না। ইসলামী শরী'আতে এসব নিষিদ্ধ ।
প্রকৃতপক্ষে, এ দিনটি মূসা (আ) ও তাঁর কওমের নাজাতের দিন। দুঃখ-কষ্ট থেকে পরিত্রাণ লাভের পর তাওহীদ ভিত্তিক সুখময় জীবনে পদার্পণের দিন। আল্লাহর শত্রু ফিরআউনের পতনের দিন। অত্যাচারীর করাল গ্রাস থেকে মুমিনের মুক্তির দিন। শত্রুর কবল থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে স্রষ্টার উদ্দেশ্যে মুমিনের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন। এতদভিন্ন অবান্তর কিছু ফযীলত ও শোকের নামে অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত থাকা বাঞ্ছনীয়। উপরন্তু, নবীদের রেখে যাওয়া সুন্নাতকে কোন এক সাহাবীর মৃত্যুর শোক পালনের মাধ্যমে তুচ্ছ করা ঈমানী চেতনারও পরিপন্থী। আল্লাহ আমাদেরকে সকল প্রকার শিরকী ও বিদ'আতী কর্মকাণ্ড থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন।
আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে শুব্বানের দাওয়াতী কাজে অংশ গ্রহণ করুন!
(বিকাশ পার্সোনাল) ০১৭৬৫ ৮১২২৬১
জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীস বাংলাদেশ
৭৯/ক/৩, উত্তর যাত্রাবাড়ি, ঢাকা-১২০৪,
[email protected], www.shubbanbd.org, Facebook: /shubban◈ ◈ ◈ আশুরায়ে মুহাররাম : করণীয় ও বর্জনীয় ◈ ◈ ◈

একদিকে জ্ঞানের স্বল্পতা অন্যদিকে মীর মোশাররফ হোসেন এর সাহিত্যরসে সমৃদ্ধ অথচ ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক রসদে পূর্ণ বিখ্যাত উপন্যাস 'বিষাদ সিন্ধু'র ব্যাপক জনপ্রিয়তার কল্যাণে ভারত উপমহাদেশের মুসলিমগণ ১০ই মুহাররামকে কেবল কারবালার মর্মান্তিক ইতিহাস হিসেবেই জানে। এ অঞ্চলে শীআদের সংখ্যা কম হলেও ওইদিনে সর্বত্র হুসাইন (রা.) এর শহীদ হওয়ার যে মর্মান্তিক ও হৃদয়স্পর্শী আলোচনা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ও পুলিশী প্রহরায় শোক মিছিলসহ নানা অনুষ্ঠান সাধারণ মানুষের কোমল হৃদয়ে দাগ কেটেছে। উপরন্তু, সুন্নী মুসলিমদের মধ্যেও বেশ কিছু ভণ্ড পীর-মুরীদ ও মাজারীরা এ দিনটাতে তাদের মাজার-খানকা দরবারী আয়োজনে উৎসবমুখর করে তোলে। ফলে অনেকেই এটাকে এখন ধর্মীয় একটি অনুষ্ঠান হিসেবেই বিবেচনা করে থাকে। এমতাবস্থায়, আগুরা বা ১০ই মুহাররাম কী? তা সর্বসাধারণকে জানানো আমাদের ঈমানী দাবী বলে মনে করছি।
مُحَرَّم(মুহাররাম) হিজরী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। চারটি পবিত্র মাসের মধ্যে এটি একটি (সহীহুল বুখারী: ৩১৯৭)। মুহাররাম শব্দটি "আরবী, যার অর্থ পবিত্র, সম্মানিত। প্রাচীনকাল থেকে এ মাসটি পবিত্র মাস হিসেবে গণ্য। অনুরূপ, عَاشُوْرَاء শব্দটিও আরবি, যার অর্থ দশমী বা ১০ম দিন। বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন মুহাররামের ১০ম তারিখকে আশুরা বলা হয়ে থাকে।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নাবী কারীম (সা.) যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় আসলেন তখন মদীনার ইহুদীদেরকে আশুরার সওম রাখতে দেখে তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা এদিনে কেন সওম রাখ"? উত্তরে তারা বলল, এ দিনটা অত্যন্ত পবিত্র ও সম্মানিত। কেননা, এই দিনে আল্লাহ তাআলা মূসা (আ) ও বানী ইসরাঈলকে ফেরআউনের কবল হতে পরিত্রাণ দিয়েছিলেন। এ কারণে আমরা সওমের মাধ্যমে ঈদ বা খুশি পালন করি, যেন তার স্মরণ সবসময় বিদ্যমান থাকে। রাসূলুল্লাহ বললেন, “মূসা (আ)-এর বিজয়ের দিন পালনে আমরা তোমাদের থেকে বেশী হকদার।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ নিজে সওম রাখলেন এবং সাহাবায়ে কিরামকে সপ্তম রাখার নির্দেশ দিলেন। (সহীহুল বুখারী: ২০০৪, ৩৩৯৭ ও সহীহ মুসলিম: ১১৩০)

📃 আশুরার সওয়ের সীলত:

১. আশুরার সওম ফির'আউনের কবল থেকে মূসা (আ) এর নাজাতের শুকরিয়া হিসেবে পালিত হয়।
২. এই সওম মূসা (আ) ও মুহাম্মাদী শরী'আতে চালু ছিল। আইয়ামে জাহেলিয়াতেও আশুরার সওম পালিত হত। (সহীহুল বুখারী: ২০০২)
৩. ২য় হিজরীতে রমাযানের সওম ফরয হওয়ার আগ পর্যন্ত এই সওম সকল মুসলিমের জন্য পালনীয় নিয়মিত সপ্তম হিসেবে গণ্য হত। ৪. এই সওমের ফযীলত হিসেবে বিগত এক বছরের গোনাহ মাফের কথা বলা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম: ১১৬২)
৫. এ ছাড়াও রমাযানের সপ্তমের পর মুহাররামের সওমকে শ্রেষ্ঠ সওম হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম: ১১৬৩)

📃 আশুরার প্রচলিত বিদ'আতসমূহ, যা বর্জন করতেই হবে

আশুরা উপলক্ষে মুসলিম দাবীদার ভ্রান্ত একটি দল শী'আ ও তাদের দ্বারা প্রভাবিত কতিপয় সুন্নী মিলে অগণিত শিরকী ও বিদ'আতী কর্মে লিপ্ত হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে কোটি টাকার অপচয় করা হয়। সরকারিভাবেও বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালিত হয়। মূসা (আ) এর খুশির বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ রাসূলের (সা.) সাওম পালনের এ দিনটিতে ৬১ হিজরীতে কাকতালীয়ভাবে তাঁর দৌহিত্র হুসাইন (রা.) শাহাদাত বরণ করেন। পরবর্তীকালে (৩৫২ হিজরীতে) শী'আ শাসক আহমাদ বিন বুইয়া দায়লামী ওরফে "মুইযযুদ্দৌলা" ১০ মুহাররামকে শোক দিবস ঘোষণা করে। এদিনে শীআদের অন্যতম কর্মসূচি হলো তাষিয়া প্রদর্শন করা। যার অর্থ-শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করা। তবে বিশেষ অর্থে শব্দটি হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত লাভের বিষাদময় স্মৃতিকে স্মরণ করে শী'আ সম্প্রদায়ের ওই দিনে তাঁর সমাধির প্রতীক বানিয়ে সেটা নিয়ে মিছিল করে শোক প্রকাশ করাকে বুঝায়। শী'আ মতবাদের উদ্ভব ইরাক ও ইরানে হলেও সেখানে এরূপ শোকমিছিলে তাযিয়া বহন করা হয় না। বাংলাদেশে মুঘল আমলে বিশেষত শাহ্ সুজা (১৬৩৯-১৬৫৯) বাংলার সুবেদার থাকাকালে শী'আদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। সম্ভবত, তখনই এখানে তাযিয়া মিছিলের প্রচলন হয়। [বাংলা পিডিয়া]
এভাবে তাষিয়ার নামে হুসাইন (রা.) এর ভুয়া ও বানোয়াট কবর তৈরি করে আমাদের দেশে প্রতিবছর রাজধানীসহ প্রায় প্রতিটি জেলার রাজপথে শোক মিছিল করা হয়। ঐ ভূয়া কবরে হুসাইনের রূহ হাযির হয়, ধারণা করে তাকে সালাম করা হয়। তার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে সিজদাহ করা হয়, মনোবাঞ্ছা পূরণ করার জন্য প্রার্থনা করা হয়। বুক চাপড়ানো হয়, বুকের কাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয়। “হায় হোসেন, হায় হোসেন” বলে মাতম করা হয়। লোহার শিকল ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে পেট ও পিঠে অনবরত আঘাত করে সারা শরীর রক্তাক্ত করা হয়। শিশুদের মাথায় আঘাত করে লাল রক্তে রঞ্জিত করা হয়।
আবার কোথাও কোথাও রক্তের নামে লাল রং ছিটানো হয়। রাস্তা-ঘাট রঙ-বেরঙের সাজে সাজানো হয়। হুসাইন (রা.) এর নামে “হাঁস/মোরগ পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে যুবক-যুবতীরা পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঐ বরকতের মোরগ ধরার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। সুসজ্জিত অশ্বারোহী দল লাঠি-তীর-বল্লম নিয়ে মিছিল করে কারবালা যুদ্ধের মহড়া দেয়। কালো পোষাক পরিধান বা কালো ব্যাজ ধারণ করে মিছিলের সম্মুখভাগে নারীরাও অংশ নেয়। আবার অনেকে শোকের মাস ভেবে এই মাসে বিয়ে-শাদী করা অন্যায় মনে করে। ঐ দিন অনেকে পানি পান করা এমনকি শিশুকে দুধ পান করানোও অন্যায় ভাবে।
অপরদিকে, উগ্র শী'আরা আয়েশা (রা.) এর নামে বেঁধে রাখা একটি বকরীকে লাঠিপেটা করে ও অস্ত্রাঘাতে রক্তাক্ত করে বদলা নেয় ও উল্লাসে ফেটে পড়ে। তাদের ধারণা- রাসূলের ইন্তিকালের পর আলী (রা.) খলীফা হতে পারেননি আয়েশা (রা) এর ষড়যন্ত্রের কারণে (নাউযুবিল্লাহ!)। একইভাবে ওমর, উসমান, মুআবিয়া, মুগীরা বিন শু'বা রাযিয়াল্লাহু 'আনহুম প্রমুখ সম্মানিত সাহাবীদেরকে এসময় বিভিন্নভাবে গালি দেওয়া হয়। এ ছাড়াও রেডিও-টিভি, পত্র-পত্রিকা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একথা বুঝানোর চেষ্টা করা হয় যে, আশুরায়ে মুহাররামের মূলবিষয় হল- ‘শাহাদাতে হুসাইন' (রা.) বা 'কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা' । অথচ প্রকৃত সত্য এসব থেকে অনেক দূরে।
আশুরা উপলক্ষে প্রচলিত উপর্যুক্ত বিদ'আতী অনুষ্ঠানাদির কোন অস্তিত্ব কিংবা শী'আ আক্বীদা কোন প্রমাণ সাহাবায়ে কেরামের যুগে পাওয়া যায় না। আল্লাহ ব্যতীত কাউকে সিজদা করা যেমন হারাম, তাযিয়ার নামে ভূয়া কবর যিয়ারত করাও তেমনি হারাম। এতদ্ব্যতীত কোনরূপ শোকগাঁথা বা মর্সিয়া অনুষ্ঠান বা শোকমিছিল ইসলামী শরী আর পরিপন্থী । কোন কবর বা সমাধিসৌধ, শহীদ মিনার বা স্মৃতিসৌধ, শিখা অনির্বাণ বা শিখা চিরন্তন প্রভৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করাও একই পর্যায়ে পড়ে।
অনুরূপভাবে সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহ হল সাহাবায়ে কেরামকে গালি দেওয়া। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “তোমরা আমার সাহাবীগণকে গালি দিয়ো না। কেননা (তাঁরা এমন উচ্চ মর্যাদার অধিকারী যে) তোমাদের কেউ যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, তবুও তাঁদের এক মুদ বা অর্ধ মুদ [১ মুদ= আনুমানিক ৬২৫ গ্রাম]-এর সমান সাওয়াব পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না” । (সহীহুল বুখারী: ৩৬৭৩ ও সহীহ মুসলিম: ২৫৪১)
তাছাড়া শোকের নামে দিবস পালন করা, বুক চাপড়ানো ও মাতম করা ইসলামী রীতি নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে শোকে কাতর হয়ে নিজ মুখে আঘাত করে, কাপড় ছিড়ে ফেলে ও জাহেলী যুগের মতো মাতম করে” (সহীহুল বুখারী: ১২৯৭ ও সহীহ মুসলিম: ১০৩)। অধিকন্তু, ঐসব শোকসভা বা শোক মিছিলে বাড়াবাড়ি করে সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তার পার্থক্য ভুলে হুসাইনের কবরে রূহের আগমন কল্পনা করা, সেখানে সিজদা করা, মাথা ঝুঁকানো, প্রার্থনা নিবেদন করা ইত্যাদি
পরিষ্কারভাবে শিরকের নামান্তর।

📃 আশুরায় আমাদের করণীয়

আশুরা উপলক্ষ্যে মুহাররামের ৯ ও ১০ তারিখ সওম পালন ছাড়া অন্য বিশেষ কোন ইবাদত নেই। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যখন আশুরার দিন সওম পালন করেন এবং লোকদেরকে সওম পালনের নির্দেশ দেন, তখন সাহাবীগণ বললেন, হে রাসূল (সা.) ! ইয়াহুদ এবং নাসারা এ দিনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ইন্‌শা আল্লাহ আগামী বছর আমরা ৯ তারিখেও সওম পালন করব । বর্ণনাকারী বলেন, , আগামী বছর আসার আগেই রাসূলুল্লাহ (সা.) মৃত্যু বরণ করেন । (সহীহ মুসলিম: ১১৩৪ ও ১৯১৬)
তবে হুসাইন (রা.) সহ সকল মৃত মুসলিমের জন্য 'আমভাবে দু'আ করা দূষণীয় নয় । সালাফগণ হুসাইন এর মর্মান্তিক মৃত্যুতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন । কিন্তু তাতে বাড়াবাড়ি করে শী'আদের ন্যায় ঐদিনকে শোক দিবস মনে করেন না। দুঃখ প্রকাশের ইসলামী রীতি হল: “ইন্না লিল্লা-হি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন' পাঠ করা (বাক্বারাহ ১৫৬) ও তাঁদের মুক্তির জন্য দু'আ করা । একথা সন্দেহাতীত যে, আশুরার সওমের সাথে হুসাইন (রা.) বিন আলী এর জন্ম বা মৃত্যুর কোন সম্পর্ক নেই। হুসাইন (রা.) এর জন্ম মদীনায় ৪র্থ হিজরীতে এবং মৃত্যু ইরাকের কুফা নগরীর নিকটবর্তী কারবালায় ৬১ হিজরীতে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মৃত্যুর ৫০ বছর পর ।
(ইবনু হাজার, আল-ইসাবাহ (২/৬৭-৭২, জীবনী: ১৭২৯)
সুতরাং শাহাদাতে হুসাইনের নিয়্যাতে পূর্ববর্ণিত সকল শিরকী ও বিদ'আতী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হবে এবং অন্যকে বিরত থাকার উপদেশ দিতে হবে। এদিনে সওম পালনকারী শাহাদাতে হুসাইনের নিয়্যাত করলে সওমের সওয়াবও পাবে না; বরং গুনাহগার হবে। কারণ, কারবালার ঘটনার ৫০ বছর পূর্বেই ইসলাম পূর্ণতা লাভ করেছে এবং অহীর আগমনও বন্ধ হয়ে গেছে। বনী ইসরাঈলের অসংখ্য নবী নিজ কওমের লোকদের হাতে নিহত হয়েছেন। মুসলমানদের প্রাণপ্রিয় খলীফা হযরত ওমর (রা.) মসজিদে নববীতে ফজরের সালাতরত অবস্থায়, উসমান ৮৩ বছরের বৃদ্ধ বয়সে নিজ গৃহে কুরআন তিলাওয়াতরত অবস্থায়, হযরত আলী (রা.) ফজরের জামা'আতে যাওয়ার পথে অতর্কিত আক্রান্ত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। হাসান (৩-৪৯হিঃ)-কে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। [আল-বিদায়াহ ৮/৪৪] আশারায়ে মুবাশশারাহর অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব হযরত ত্বালহা ও যুবায়ের মর্মান্তিকভাবে শহীদ হন। তাঁদের কারো মৃত্যু হুসাইন (রা.) -এর মৃত্যুর চাইতে কম দুঃখজনক ও মর্মান্তিক ছিল না। কিন্তু কারো জন্য দিনক্ষণ নির্ধারণ করে মাতম করা ও সরকারি ছুটি ঘোষণা করে শোকদিবস পালন করার কোন রীতি সাহাবী ও তাবেয়ীদের যুগে ছিল না। ইসলামী শরী'আতে এসব নিষিদ্ধ ।
প্রকৃতপক্ষে, এ দিনটি মূসা (আ) ও তাঁর কওমের নাজাতের দিন। দুঃখ-কষ্ট থেকে পরিত্রাণ লাভের পর তাওহীদ ভিত্তিক সুখময় জীবনে পদার্পণের দিন। আল্লাহর শত্রু ফিরআউনের পতনের দিন। অত্যাচারীর করাল গ্রাস থেকে মুমিনের মুক্তির দিন। শত্রুর কবল থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে স্রষ্টার উদ্দেশ্যে মুমিনের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন। এতদভিন্ন অবান্তর কিছু ফযীলত ও শোকের নামে অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত থাকা বাঞ্ছনীয়। উপরন্তু, নবীদের রেখে যাওয়া সুন্নাতকে কোন এক সাহাবীর মৃত্যুর শোক পালনের মাধ্যমে তুচ্ছ করা ঈমানী চেতনারও পরিপন্থী। আল্লাহ আমাদেরকে সকল প্রকার শিরকী ও বিদ'আতী কর্মকাণ্ড থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন।
আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে শুব্বানের দাওয়াতী কাজে অংশ গ্রহণ করুন!
(বিকাশ পার্সোনাল) ০১৭৬৫ ৮১২২৬১
জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীস বাংলাদেশ
৭৯/ক/৩, উত্তর যাত্রাবাড়ি, ঢাকা-১২০৪,
[email protected], www.shubbanbd.org, Facebook: /shubban◈ ◈ ◈ আশুরায়ে মুহাররাম : করণীয় ও বর্জনীয় ◈ ◈ ◈

একদিকে জ্ঞানের স্বল্পতা অন্যদিকে মীর মোশাররফ হোসেন এর সাহিত্যরসে সমৃদ্ধ অথচ ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক রসদে পূর্ণ বিখ্যাত উপন্যাস 'বিষাদ সিন্ধু'র ব্যাপক জনপ্রিয়তার কল্যাণে ভারত উপমহাদেশের মুসলিমগণ ১০ই মুহাররামকে কেবল কারবালার মর্মান্তিক ইতিহাস হিসেবেই জানে। এ অঞ্চলে শীআদের সংখ্যা কম হলেও ওইদিনে সর্বত্র হুসাইন (রা.) এর শহীদ হওয়ার যে মর্মান্তিক ও হৃদয়স্পর্শী আলোচনা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় ও পুলিশী প্রহরায় শোক মিছিলসহ নানা অনুষ্ঠান সাধারণ মানুষের কোমল হৃদয়ে দাগ কেটেছে। উপরন্তু, সুন্নী মুসলিমদের মধ্যেও বেশ কিছু ভণ্ড পীর-মুরীদ ও মাজারীরা এ দিনটাতে তাদের মাজার-খানকা দরবারী আয়োজনে উৎসবমুখর করে তোলে। ফলে অনেকেই এটাকে এখন ধর্মীয় একটি অনুষ্ঠান হিসেবেই বিবেচনা করে থাকে। এমতাবস্থায়, আগুরা বা ১০ই মুহাররাম কী? তা সর্বসাধারণকে জানানো আমাদের ঈমানী দাবী বলে মনে করছি।
مُحَرَّم(মুহাররাম) হিজরী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। চারটি পবিত্র মাসের মধ্যে এটি একটি (সহীহুল বুখারী: ৩১৯৭)। মুহাররাম শব্দটি "আরবী, যার অর্থ পবিত্র, সম্মানিত। প্রাচীনকাল থেকে এ মাসটি পবিত্র মাস হিসেবে গণ্য। অনুরূপ, عَاشُوْرَاء শব্দটিও আরবি, যার অর্থ দশমী বা ১০ম দিন। বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন মুহাররামের ১০ম তারিখকে আশুরা বলা হয়ে থাকে।
আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নাবী কারীম (সা.) যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় আসলেন তখন মদীনার ইহুদীদেরকে আশুরার সওম রাখতে দেখে তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা এদিনে কেন সওম রাখ"? উত্তরে তারা বলল, এ দিনটা অত্যন্ত পবিত্র ও সম্মানিত। কেননা, এই দিনে আল্লাহ তাআলা মূসা (আ) ও বানী ইসরাঈলকে ফেরআউনের কবল হতে পরিত্রাণ দিয়েছিলেন। এ কারণে আমরা সওমের মাধ্যমে ঈদ বা খুশি পালন করি, যেন তার স্মরণ সবসময় বিদ্যমান থাকে। রাসূলুল্লাহ বললেন, “মূসা (আ)-এর বিজয়ের দিন পালনে আমরা তোমাদের থেকে বেশী হকদার।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ নিজে সওম রাখলেন এবং সাহাবায়ে কিরামকে সপ্তম রাখার নির্দেশ দিলেন। (সহীহুল বুখারী: ২০০৪, ৩৩৯৭ ও সহীহ মুসলিম: ১১৩০)

📃 আশুরার সওয়ের সীলত:

১. আশুরার সওম ফির'আউনের কবল থেকে মূসা (আ) এর নাজাতের শুকরিয়া হিসেবে পালিত হয়।
২. এই সওম মূসা (আ) ও মুহাম্মাদী শরী'আতে চালু ছিল। আইয়ামে জাহেলিয়াতেও আশুরার সওম পালিত হত। (সহীহুল বুখারী: ২০০২)
৩. ২য় হিজরীতে রমাযানের সওম ফরয হওয়ার আগ পর্যন্ত এই সওম সকল মুসলিমের জন্য পালনীয় নিয়মিত সপ্তম হিসেবে গণ্য হত। ৪. এই সওমের ফযীলত হিসেবে বিগত এক বছরের গোনাহ মাফের কথা বলা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম: ১১৬২)
৫. এ ছাড়াও রমাযানের সপ্তমের পর মুহাররামের সওমকে শ্রেষ্ঠ সওম হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম: ১১৬৩)

📃 আশুরার প্রচলিত বিদ'আতসমূহ, যা বর্জন করতেই হবে

আশুরা উপলক্ষে মুসলিম দাবীদার ভ্রান্ত একটি দল শী'আ ও তাদের দ্বারা প্রভাবিত কতিপয় সুন্নী মিলে অগণিত শিরকী ও বিদ'আতী কর্মে লিপ্ত হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে কোটি টাকার অপচয় করা হয়। সরকারিভাবেও বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালিত হয়। মূসা (আ) এর খুশির বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ রাসূলের (সা.) সাওম পালনের এ দিনটিতে ৬১ হিজরীতে কাকতালীয়ভাবে তাঁর দৌহিত্র হুসাইন (রা.) শাহাদাত বরণ করেন। পরবর্তীকালে (৩৫২ হিজরীতে) শী'আ শাসক আহমাদ বিন বুইয়া দায়লামী ওরফে "মুইযযুদ্দৌলা" ১০ মুহাররামকে শোক দিবস ঘোষণা করে। এদিনে শীআদের অন্যতম কর্মসূচি হলো তাষিয়া প্রদর্শন করা। যার অর্থ-শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করা। তবে বিশেষ অর্থে শব্দটি হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাত লাভের বিষাদময় স্মৃতিকে স্মরণ করে শী'আ সম্প্রদায়ের ওই দিনে তাঁর সমাধির প্রতীক বানিয়ে সেটা নিয়ে মিছিল করে শোক প্রকাশ করাকে বুঝায়। শী'আ মতবাদের উদ্ভব ইরাক ও ইরানে হলেও সেখানে এরূপ শোকমিছিলে তাযিয়া বহন করা হয় না। বাংলাদেশে মুঘল আমলে বিশেষত শাহ্ সুজা (১৬৩৯-১৬৫৯) বাংলার সুবেদার থাকাকালে শী'আদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। সম্ভবত, তখনই এখানে তাযিয়া মিছিলের প্রচলন হয়। [বাংলা পিডিয়া]
এভাবে তাষিয়ার নামে হুসাইন (রা.) এর ভুয়া ও বানোয়াট কবর তৈরি করে আমাদের দেশে প্রতিবছর রাজধানীসহ প্রায় প্রতিটি জেলার রাজপথে শোক মিছিল করা হয়। ঐ ভূয়া কবরে হুসাইনের রূহ হাযির হয়, ধারণা করে তাকে সালাম করা হয়। তার সামনে মাথা ঝুঁকিয়ে সিজদাহ করা হয়, মনোবাঞ্ছা পূরণ করার জন্য প্রার্থনা করা হয়। বুক চাপড়ানো হয়, বুকের কাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয়। “হায় হোসেন, হায় হোসেন” বলে মাতম করা হয়। লোহার শিকল ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে পেট ও পিঠে অনবরত আঘাত করে সারা শরীর রক্তাক্ত করা হয়। শিশুদের মাথায় আঘাত করে লাল রক্তে রঞ্জিত করা হয়।
আবার কোথাও কোথাও রক্তের নামে লাল রং ছিটানো হয়। রাস্তা-ঘাট রঙ-বেরঙের সাজে সাজানো হয়। হুসাইন (রা.) এর নামে “হাঁস/মোরগ পুকুরে ছুঁড়ে ফেলে যুবক-যুবতীরা পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঐ বরকতের মোরগ ধরার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে। সুসজ্জিত অশ্বারোহী দল লাঠি-তীর-বল্লম নিয়ে মিছিল করে কারবালা যুদ্ধের মহড়া দেয়। কালো পোষাক পরিধান বা কালো ব্যাজ ধারণ করে মিছিলের সম্মুখভাগে নারীরাও অংশ নেয়। আবার অনেকে শোকের মাস ভেবে এই মাসে বিয়ে-শাদী করা অন্যায় মনে করে। ঐ দিন অনেকে পানি পান করা এমনকি শিশুকে দুধ পান করানোও অন্যায় ভাবে।
অপরদিকে, উগ্র শী'আরা আয়েশা (রা.) এর নামে বেঁধে রাখা একটি বকরীকে লাঠিপেটা করে ও অস্ত্রাঘাতে রক্তাক্ত করে বদলা নেয় ও উল্লাসে ফেটে পড়ে। তাদের ধারণা- রাসূলের ইন্তিকালের পর আলী (রা.) খলীফা হতে পারেননি আয়েশা (রা) এর ষড়যন্ত্রের কারণে (নাউযুবিল্লাহ!)। একইভাবে ওমর, উসমান, মুআবিয়া, মুগীরা বিন শু'বা রাযিয়াল্লাহু 'আনহুম প্রমুখ সম্মানিত সাহাবীদেরকে এসময় বিভিন্নভাবে গালি দেওয়া হয়। এ ছাড়াও রেডিও-টিভি, পত্র-পত্রিকা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একথা বুঝানোর চেষ্টা করা হয় যে, আশুরায়ে মুহাররামের মূলবিষয় হল- ‘শাহাদাতে হুসাইন' (রা.) বা 'কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা' । অথচ প্রকৃত সত্য এসব থেকে অনেক দূরে।
আশুরা উপলক্ষে প্রচলিত উপর্যুক্ত বিদ'আতী অনুষ্ঠানাদির কোন অস্তিত্ব কিংবা শী'আ আক্বীদা কোন প্রমাণ সাহাবায়ে কেরামের যুগে পাওয়া যায় না। আল্লাহ ব্যতীত কাউকে সিজদা করা যেমন হারাম, তাযিয়ার নামে ভূয়া কবর যিয়ারত করাও তেমনি হারাম। এতদ্ব্যতীত কোনরূপ শোকগাঁথা বা মর্সিয়া অনুষ্ঠান বা শোকমিছিল ইসলামী শরী আর পরিপন্থী । কোন কবর বা সমাধিসৌধ, শহীদ মিনার বা স্মৃতিসৌধ, শিখা অনির্বাণ বা শিখা চিরন্তন প্রভৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করাও একই পর্যায়ে পড়ে।
অনুরূপভাবে সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহ হল সাহাবায়ে কেরামকে গালি দেওয়া। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “তোমরা আমার সাহাবীগণকে গালি দিয়ো না। কেননা (তাঁরা এমন উচ্চ মর্যাদার অধিকারী যে) তোমাদের কেউ যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে, তবুও তাঁদের এক মুদ বা অর্ধ মুদ [১ মুদ= আনুমানিক ৬২৫ গ্রাম]-এর সমান সাওয়াব পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না” । (সহীহুল বুখারী: ৩৬৭৩ ও সহীহ মুসলিম: ২৫৪১)
তাছাড়া শোকের নামে দিবস পালন করা, বুক চাপড়ানো ও মাতম করা ইসলামী রীতি নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে শোকে কাতর হয়ে নিজ মুখে আঘাত করে, কাপড় ছিড়ে ফেলে ও জাহেলী যুগের মতো মাতম করে” (সহীহুল বুখারী: ১২৯৭ ও সহীহ মুসলিম: ১০৩)। অধিকন্তু, ঐসব শোকসভা বা শোক মিছিলে বাড়াবাড়ি করে সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তার পার্থক্য ভুলে হুসাইনের কবরে রূহের আগমন কল্পনা করা, সেখানে সিজদা করা, মাথা ঝুঁকানো, প্রার্থনা নিবেদন করা ইত্যাদি
পরিষ্কারভাবে শিরকের নামান্তর।

📃 আশুরায় আমাদের করণীয়

আশুরা উপলক্ষ্যে মুহাররামের ৯ ও ১০ তারিখ সওম পালন ছাড়া অন্য বিশেষ কোন ইবাদত নেই। আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যখন আশুরার দিন সওম পালন করেন এবং লোকদেরকে সওম পালনের নির্দেশ দেন, তখন সাহাবীগণ বললেন, হে রাসূল (সা.) ! ইয়াহুদ এবং নাসারা এ দিনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে থাকে। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ইন্‌শা আল্লাহ আগামী বছর আমরা ৯ তারিখেও সওম পালন করব । বর্ণনাকারী বলেন, , আগামী বছর আসার আগেই রাসূলুল্লাহ (সা.) মৃত্যু বরণ করেন । (সহীহ মুসলিম: ১১৩৪ ও ১৯১৬)
তবে হুসাইন (রা.) সহ সকল মৃত মুসলিমের জন্য 'আমভাবে দু'আ করা দূষণীয় নয় । সালাফগণ হুসাইন এর মর্মান্তিক মৃত্যুতে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন । কিন্তু তাতে বাড়াবাড়ি করে শী'আদের ন্যায় ঐদিনকে শোক দিবস মনে করেন না। দুঃখ প্রকাশের ইসলামী রীতি হল: “ইন্না লিল্লা-হি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন' পাঠ করা (বাক্বারাহ ১৫৬) ও তাঁদের মুক্তির জন্য দু'আ করা । একথা সন্দেহাতীত যে, আশুরার সওমের সাথে হুসাইন (রা.) বিন আলী এর জন্ম বা মৃত্যুর কোন সম্পর্ক নেই। হুসাইন (রা.) এর জন্ম মদীনায় ৪র্থ হিজরীতে এবং মৃত্যু ইরাকের কুফা নগরীর নিকটবর্তী কারবালায় ৬১ হিজরীতে, রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মৃত্যুর ৫০ বছর পর ।
(ইবনু হাজার, আল-ইসাবাহ (২/৬৭-৭২, জীবনী: ১৭২৯)
সুতরাং শাহাদাতে হুসাইনের নিয়্যাতে পূর্ববর্ণিত সকল শিরকী ও বিদ'আতী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে হবে এবং অন্যকে বিরত থাকার উপদেশ দিতে হবে। এদিনে সওম পালনকারী শাহাদাতে হুসাইনের নিয়্যাত করলে সওমের সওয়াবও পাবে না; বরং গুনাহগার হবে। কারণ, কারবালার ঘটনার ৫০ বছর পূর্বেই ইসলাম পূর্ণতা লাভ করেছে এবং অহীর আগমনও বন্ধ হয়ে গেছে। বনী ইসরাঈলের অসংখ্য নবী নিজ কওমের লোকদের হাতে নিহত হয়েছেন। মুসলমানদের প্রাণপ্রিয় খলীফা হযরত ওমর (রা.) মসজিদে নববীতে ফজরের সালাতরত অবস্থায়, উসমান ৮৩ বছরের বৃদ্ধ বয়সে নিজ গৃহে কুরআন তিলাওয়াতরত অবস্থায়, হযরত আলী (রা.) ফজরের জামা'আতে যাওয়ার পথে অতর্কিত আক্রান্ত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। হাসান (৩-৪৯হিঃ)-কে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। [আল-বিদায়াহ ৮/৪৪] আশারায়ে মুবাশশারাহর অন্যতম সেরা ব্যক্তিত্ব হযরত ত্বালহা ও যুবায়ের মর্মান্তিকভাবে শহীদ হন। তাঁদের কারো মৃত্যু হুসাইন (রা.) -এর মৃত্যুর চাইতে কম দুঃখজনক ও মর্মান্তিক ছিল না। কিন্তু কারো জন্য দিনক্ষণ নির্ধারণ করে মাতম করা ও সরকারি ছুটি ঘোষণা করে শোকদিবস পালন করার কোন রীতি সাহাবী ও তাবেয়ীদের যুগে ছিল না। ইসলামী শরী'আতে এসব নিষিদ্ধ ।
প্রকৃতপক্ষে, এ দিনটি মূসা (আ) ও তাঁর কওমের নাজাতের দিন। দুঃখ-কষ্ট থেকে পরিত্রাণ লাভের পর তাওহীদ ভিত্তিক সুখময় জীবনে পদার্পণের দিন। আল্লাহর শত্রু ফিরআউনের পতনের দিন। অত্যাচারীর করাল গ্রাস থেকে মুমিনের মুক্তির দিন। শত্রুর কবল থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে স্রষ্টার উদ্দেশ্যে মুমিনের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন। এতদভিন্ন অবান্তর কিছু ফযীলত ও শোকের নামে অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত থাকা বাঞ্ছনীয়। উপরন্তু, নবীদের রেখে যাওয়া সুন্নাতকে কোন এক সাহাবীর মৃত্যুর শোক পালনের মাধ্যমে তুচ্ছ করা ঈমানী চেতনারও পরিপন্থী। আল্লাহ আমাদেরকে সকল প্রকার শিরকী ও বিদ'আতী কর্মকাণ্ড থেকে বেঁচে থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন।
আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে শুব্বানের দাওয়াতী কাজে অংশ গ্রহণ করুন!
(বিকাশ পার্সোনাল) ০১৭৬৫ ৮১২২৬১
জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীস বাংলাদেশ
৭৯/ক/৩, উত্তর যাত্রাবাড়ি, ঢাকা-১২০৪,
[email protected], www.shubbanbd.org, Facebook: /shubban

Facebbok