brand-image

যুলহাজ্জ মাসের প্রথম দশকের ফযীলত ও কুরবানির মাসায়েল

811687155204.jpg
✎ যুলহাজ্জ মাসের প্রথম দশকের ফযীলত ও কুরবানির মাসায়েল
✤✤✤ আমাদের সমাজে এমনকি রাষ্ট্রীয়ভাবে অনেক আমলকে ইবাদত হিসেবে অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। যেমন- ঈদে মিলাদুন্নবী শবে বরাত, শবে মিরাজ প্রভৃতি। যা পালন কিংবা উদযাপনের শারঈ কোনো ভিত্তি নেই। এ ছাড়া ফযীলত বর্ণনায় সমাজে জাল ও দুর্বল সানাদ ভিত্তিক আমলের বই অনেক মাসজিদে অধ্যয়ন করা হয়। অথচ শরীয়তসম্মত ফযীলতপূর্ণ কিছু আমল ও মৌসুম রয়েছে, যার আলোচনা সচরাচর শোনা যায় না। তেমনি একটি মৌসুম হলো যুলহাজ্জ মাস। আল্লাহ সুবহানাহু তা'য়ালা তাঁর বান্দাদেরকে ক্ষমা করার অনেকগুলো সুযোগ ও ওসীলাহ দিয়েছেন, যুলহাজ্জ মাস তন্মধ্যে অন্যতম। ✤✤✤
🔰 যুলহাজ্জ মাসের প্রথম দশকের ফযীলত:🔰
》》 যুলহাজ্জ মাসের ফযীলত সম্পর্কে কুরআন ও সহীহ হাদীসের কতক দলীল • আল্লাহ তা'য়ালা বলেন: “কসম (ফজরের) ভোর বেলার। কসম দশ রাতের।” [সূরা আল-ফাজর : ১-২] ইবনু কাসীর রহ. বলেন, এর দ্বারা যুলহাজ্জ মাসের দশ দিন উদ্দেশ্য ।
► আল্লাহ তা'য়ালা বলেন: “তারা যেন নির্দিষ্ট দিনসমূহে আল্লাহর নাম স্মরণ করে।” [সূরা আল-হাজ্জ : ২৮] ইবনু আব্বাস বলেন, এর দ্বারা যুলহাজ্জ মাসের দশ দিন উদ্দেশ্য।
► আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস হতে বর্ণিত। নাবী কারীম (সা) বলেছেন: “যুলহাজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনের আমলের চেয়ে অন্য কোনো দিনের আমল আল্লাহর নিকট উত্তম নয়।” সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, জিহাদও কি (উত্তম) নয়? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন: “জিহাদও নয়। তবে সেই ব্যক্তি ব্যতীত, যে নিজের জান ও মালের ঝুঁকি নিয়ে জিহাদে যায় এবং কিছুই নিয়ে ফিরে আসে না।” [সহীহুল বুখারী, হা. ৯৬৯, ইবনে মাজাহ, হা. ১৭২৭]
► ইবনু হাজার রহ. বলেন, যুলহাজ্জ মাসের দশ দিনের ফযীলতের তাৎপর্যের ক্ষেত্রে এটা স্পষ্ট যে, এসময়ে মৌলিক ইবাদতগুলোর সমন্বয় ঘটে থাকে। অর্থাৎ-তাকবীর (আল্লাহর বড়োত্ব), তাহমীদ (আল্লাহর প্রশংসা), সলাত, সিয়াম, সাদাকাহ, হাজ্জ ও কুরবানী, যা অন্যসময় একই সাথে আদায় করা হয় না। [ফাতহুল বারী, ২য় খণ্ড, ৪৬০ পৃষ্ঠা]
🔰 আমাদের করণীয়:🔰
► উল্লিখিত আলোচনায় এটা প্রতীয়মান হয় যে, যুলহাজ্জ মাসের প্রথম দশ দিনে দান-সাদাকাহ, নফল সলাত, সিয়াম, কুরআন তিলাওয়াত, যিকর, তাকবীর-তাহলীল, তাসবীহ-তাহমীদ ও ক্ষমা প্রার্থনাসহ সকল প্রকার সৎ আমল বেশি বেশি করা অন্য যে-কোনো মাসের তুলনায় উত্তম। সুতরাং এই সময়ে একনিষ্ঠভাবে তাওবা করা, তাকবীর-তাহলীল, তাসবীহ-তাহমীদ ও ইস্তিগফার করা, ফরয ও ওয়াজিব আমলসমূহ আদায়ে যত্নবান হওয়া, ও কুরবানীসহ বেশি বেশি সৎ আমল করা দরকার।
অপরদিকে, যে ব্যক্তি কুরবানী করার নিয়ত করবেন তিনি যুলহাজ্জ মাসে প্রবেশ করলে কুরবানী করার পূর্ব পর্যন্ত চুল, নখ ইত্যাদি কর্তন করা থেকে বিরত থাকবেন [ সহীহ মুসলিম, হা. ১৯৭৭, মুসনাদে আহমাদ, হা. ২৬৪৭৪]। তবে যদি কেউ না জেনে ভুল করে কর্তন করে ফেলে, তাহলে তিনি ইস্তিগফার করবেন।
🔰 আরাফাহ দিবস (৯ই যুলহাজ্জ) এর আমল🔰
■ দুআ: যুলহাজ্জ মাসের নবম দিন হাজ্জের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রুকন আদায়ের নিমিত্তে হাজীগণ আরাফার মাঠে অবস্থান করেন। এদিনটিই আরাফার দিবস হিসেবে পরিচিত। আরাফার দিনটি মুসলিম মিল্লাতের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই দিনে ইসলামকে আল্লাহ তা'য়ালা পরিপূর্ণতার ঘোষণা দিয়েছেন। যে কারণে ইহুদিরা উমার এর নিকট আফসোস করে বলেছিল, “আপনারা এমন একটি আয়াত তিলাওয়াত করে থাকেন, যা আমাদের ওপর অবতীর্ণ হলে আমরা সে দিনটিকে ঈদের দিন বানিয়ে নিতাম।” (সহীহুল বুখারী, হা. ৪৬০৬)। রাসূলুল্লাহ বলেছেন: আরাফাহ দিবসের দুআই হলো শ্রেষ্ঠ দুআ । আর আমার পূর্ববর্তী নাবীগণ এবং আমি যা বলেছি, তার মাঝে শ্রেষ্ঠ কালিমা হচ্ছে (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা-শারিকালাহু লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হাম্দু ওয়াহুয়া 'আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বদির) [তিরমিযী- ৩৫৮৫, সহীহ] এ আমলটি আরাফাবাসীসহ সকলের জন্য প্রযোজ্য।
■ সওম: আরাফার দিবসে হাজীগণ ব্যতীত সকলকে সওম পালনের গুরুত্বারোপ করে রাসূলুল্লাহ বলেন: “আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী, তা (আরাফার সওম) পূর্ববর্তী এক বছর ও পরবর্তী এক বছরের গুনাহের কাফ্ফারা (মোচনকারী) হবে।” (সহীহ মুসলিম, হা. ১১৬৩, ১৬৬২) সুতরাং দুই বছরের পাপ মোচনের এ সুবর্ণ সুযোগ গ্রহণ করা উচিত!
🔰 তাকবীর পাঠ 🔰
যুলহাজ্জ মাসের নতুন চাঁদ উদয় হলে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত সকল স্থানে সব সময় তাকবির পাঠ করা এবং ৯ তারিখ সকাল থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত ফরয সলাতের পরে তাকবির পাঠ করা। যেমনটি করতেন আবু হুরায়রাহ ও ইবনু উমর । [সহীহুল বুখারী, কিতাবু সলাতিল ঈদাইন, তাশরিকের দিনসমূহের ফযীলত অধ্যায়| তাকবিরের শব্দগুলো হচ্ছে, “আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ” [মুসান্নাফ আবী শাইবাহ, হা. ৫৬৫০, সহীহ
ঈদুল আযহার সলাত: যুলহাজ্জ মাসের ১০ তারিখ সূর্য উদিত হয়ে এক বর্ণা পরিমাণ উপরে ওঠার পরপরই আযান ও ইকামত ছাড়াই অতিরিক্ত বারো তাকবিরে ঈদের দুই রাক'আত সলাত আদায় করা সুন্নাত। প্রথম রাক'আতে তাকবিরে তাহরীমার পর অতিরিক্ত সাত তাকবির ও দ্বিতীয় রাক'আতে ক্বিরাতের পূর্বে অতিরিক্ত পাঁচ তাকবির। সলাতের পর খুতবা প্রদান করা। (সহীহুল বুখারী, হা. ৯৬৩, সহীহ মুসলিম- ৮৮৫, আবু দাউদ, হা. ১১৪৯-১১৫১, সহীহ)
🔰 কুরবানির মাসায়েল 🔰
কুরবানির অর্থ: আরবী “কুরবান” শব্দটি ফার্সি বা উর্দুতে “কুরবানী” রূপে পরিচিত হয়েছে। এর অর্থ হলো: নৈকট্য অর্জন ও উৎসর্গ করা। শব্দটির আরবী সমার্থক শব্দ 'উযহিয়্যাহ'। ইসলামী পরিভাষায়: আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে শারঈ পদ্ধতিতে যুলহাজ্জ মাসের ১০ তারিখ সকাল থেকে ১৩ তারিখ সন্ধ্যা পর্যন্ত যে (নির্বাচিত) পশু জবাই করা হয় তাকে কুরবানী বলে । (আল মুফাস্সাল ফি আহকা-মিল উযহিয়্যাহ- ১/৯)
🔰 কুরবানির জন্য নিয়ত করা:🔰
সকল ইবাদতের ভিত্তি হচ্ছে নিয়ত। বিশুদ্ধ নিয়ত ছাড়া কোনো ইবাদতই আল্লাহ তা'য়ালা কবুল করেন না। অনুরূপভাবে কুরবানির বিশুদ্ধ নিয়ত ছাড়া আল্লাহ তা'য়ালা কুরবানীকেও কবুল করবেন না। আল্লাহর ঘোষণা: “কুরবানির পশুর গোশত এবং রক্ত কিছুই আল্লাহর নিকটে পৌঁছে না, বরং তোমাদের তাক্বওয়াই কেবলমাত্র তাঁর নিকটে পৌঁছে।” (সূরা আল হাজ্জ : ৩৭)
🔰 কুরবানী করার উদ্দেশ্য: 🔰
সারা বছর গোশত খাওয়ার জন্য কিংবা লোক নিন্দার ভয়ে অথবা নিছক সামাজিকতা রক্ষার জন্য এ কুরবানী নয়; বরং প্রকৃতপক্ষে একজন মুসলিমের কুরবানির উদ্দেশ্য নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলি হওয়া বাঞ্চনীয়:
১. আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা;
২. ইবরাহীম (আ.) এর সুন্নাতকে জীবিত রাখা;
৩. পরিবার-পরিজন ও গরীব-মিসকিনকে আনন্দিত করা;
৪. আল্লাহ তা'য়ালা জীব-জন্তুকে আমাদের অনুগত করে দিয়েছেন। এই নেয়ামতের জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা । (সূরা আল-হাজ্জ : ২৮) (মিনহাজুল মুসলিম, পৃষ্ঠা ৩১৮)
🔰 কুরবানির বিধান: 🔰
কুরবানী মুসলিমদের জন্য একটি শি‘আর তথা নিদর্শন। এটা আল্লাহ তা'য়ালার নৈকট্য অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। কুরবানির বিধান কী? এ বিষয়ে ওলামায়ে কিরামের মাঝে মতানৈক্য রয়েছে। ইমাম আবু হানিফা, শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ ও ইমাম আহমাদ বিন হাম্বালের (রহিমাহুমুল্লাহ) এক বর্ণনা মতে, প্রত্যেক স্বচ্ছল ব্যক্তির উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। (আল-মুগনী, ইবনে কুদামাহ, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩৬৭)। অপর দিকে ইমাম মালেক, শাফেয়ী, আহমাদ বিন হাম্বালের অপর বর্ণনাসহ অধিকাংশ ওলামায়ে কিরাম এবং সাহাবীদের আমল ও মত অনুযায়ী সচ্ছল ব্যক্তির উপরে কুরবানী করা ওয়াজিব নয় বরং সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। (সহীহ ফিকহুস সুন্নাহ, ২/৩৩২-৩৩৩)
🔰 কুরবানির পশুর গুণাবলি 🔰
কুরবানির পশু সুঠাম, সুন্দর, মোটা ও নিখুঁত হওয়া উত্তম। (ইবনে মাজাহ, হা ৩১২২, সহীহ) চার প্রকার প্রাণী দ্বারা কুরবানী করা বৈধ নয়: ১. স্পষ্ট ল্যাংড়া । ২. স্পষ্ট কানা। ৩. স্পষ্ট রোগা। ৪. অন্তিম বার্ধক্যে উপনীত (আবু দাউদ, হা. ২৮০২; ইবনে মাজাহ, হা. ৩১৪৪, সহীহ) এ ছাড়াও অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত বা ত্রুটিযুক্ত প্রাণী দ্বারা কুরবানী করা মাকরূহ। (সহীহ ফিকহুস সুন্নাহ, ২/337)
🔰 কুরবানির অন্যান্য মাসায়েল: 🔰
ক. কুরবানির পশু ৪ প্রকার:১. উট; ২. গরু; ৩. ছাগল; ৪. দুম্বা (ভেড়া ছাগলের আর মহিষ গরুর অন্তর্ভুক্ত হবে) প্রত্যেকটি নর ও মাদী (সূরা আল-আনআম : ১৪৩-১৪৪)। এগুলো ব্যতীত অন্য পশু দিয়ে কুরবানী করা বৈধ নয়। কারণ অন্যগুলোর ব্যাপারে কুরআন এবং হাদীসে কোনো দলীল বর্ণিত হয়নি। (সহীহ ফিকহুস সুন্নাহ, ২/৩৩৪-৩৩৫)
খ. কুরবানির পশুর বয়স: রাসূলুল্লাহ বলেছেন, “তোমরা মুসিন্নাহ পশু ব্যতীত যবেহ করবে না, তবে কষ্টকর হলে ৬ মাস বয়সের দুম্বা (ছাগল বা অন্য কিছু নয়) যবেহ করবে।” (সহীহ মুসলিম, হা. ১৯৬৩, আবু দাউদ, হা. ২৭৯৭, ইবনে মাজাহ, হা. ৩১৪১ )
🔰 পশু কুরবানির উপযুক্ত হওয়ার বয়স:🔰
১. ছাগল, দুম্বা এবং ভেড়া: ১ বছর পূর্ণ করে ২য় বছরে পদার্পণ করা। ২. গরু, মহিষ ২ বছর পূর্ণ করে ৩য় বছরে পদার্পণ করা । ৩. উট: ৫ বছর পূর্ণ করে ৬ষ্ঠ বছরে পদার্পণ করা। (সহীহ ফিকহুস সুন্নাহ, ২/৩৩৫ পৃষ্ঠা)
🔰 কুরবানী করার সময়:🔰
উত্তম হলো ঈদুল আযহার দিন সূর্য উদিত হয়ে এক বর্ণা পরিমাণ উপরে ওঠার পর সলাত আদায় করে কুরবানী করা। অর্থাৎ ঈদুল ফিতরের তুলনায় ঈদুল আযহার সলাত দ্রুত আদায় করা। (সহীহ ফিকহুস সুন্নাহ, ২/৩৪০)
🔰 শরীকানা বা ভাগে কুরবানীঃ 🔰
মুসলিম জাতির কল্যাণার্থে আল্লাহ তা'য়ালা একই কাজ বিভিন্ন পদ্ধতিতে আদায় করার বিধান দিয়েছেন। ঠিক তারই সুবাদে আমরা উট, গরু, ছাগল, দুম্বা বা ভেড়া থেকে যে-কোনো একটি কুরবানী করতে পারি। আবার উট ও গরুতে এককভাবে কুরবানির পাশাপাশি শরীকানায়ও কুরবানী করতে পারি। যা মুসাফির এবং মুব্বীম উভয় অবস্থাতেই জায়েয।
১. জাবের এ হতে বর্ণিত। নাবী কারীম বলেছেন: “উট ও গরু সাত জনের পক্ষ থেকে কুরবানী করা বৈধ।" (সহীহ মুসলিম, হা. ২৮০৮; আবু দাউদ, হা. ১৩১৮) ইমাম তিরমিযী (রহ.) বলেছেন: ১টি পশুতে সাত জনের অংশগ্রহণের বৈধতা বিভিন্ন সাহাবায়ে কেরামের আমল দ্বারা প্রমাণিত এবং পরবর্তীতে ইমাম সুফিয়ান সাওরী, ইবনুল মুবারক, ইমাম শাফেঈ, আহমদ বিন হাম্বল সহ প্রমুখ ওলামায়ে কিরাম এর উপরই আমল করেছেন। (তিরমিযী, হা. ১৫০২)
৩. সৌদি আরবের ফাতওয়া বোর্ডের ফাতওয়া অনুযায়ী একটি উট এবং গরু সাত জনের পক্ষ থেকে কুরবানী করা যথেষ্ট হবে। চাই তারা একই পরিবারের হোক বা ভিন্ন পরিবারের হোক। (ফাতওয়া আল লাজনা আদ দায়েমা খণ্ড ১১, পৃষ্ঠা ৪০১ ) কেননা, পরিবারের পক্ষ থেকে একটি কুরবানীই যথেষ্ট। যদিও সে পরিবারের সদস্য সংখ্যা বেশি হয়। আর এ কথাও স্বতঃসিদ্ধ যে, পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের একই সাথে কুরবানী করার সামর্থ্য অর্জিত হওয়া সম্ভবপর নয়। তাই পরিবারের পক্ষ থেকে একজনের কুরবানী তার পুরো পরিবারের জন্য যথেষ্ট। এ ছাড়া স্বয়ং রাসূলুল্লাহ পুরো উম্মতের পক্ষ থেকে একটি আলাদা কুরবানী করেছেন মর্মে প্রমাণ রয়েছে। (আবু দাউদ, হা. ২৮১০)
উক্ত প্রমাণাদির আলোকে এটা প্রতীয়মান হয় যে, মুক্বীম এবং মুসাফির উভয় অবস্থাতেই শরীকানায় কুরবানী করার বৈধতা রয়েছে। আর শরীয়তে জায়েয প্রমাণিত কোনো বিষয়কে নিষিদ্ধ বা নাজায়েয বলা ধৃষ্টতার শামিল এবং মাকাসিদে শারীআহর পরিপন্থী। তবে উত্তম-এর দিক বিচারে শরীকানার চেয়ে একাকী কুরবানী করা নিঃসন্দেহে উত্তম।
এ ছাড়া সাতের কম তথা দুই, তিন, চার, পাঁচ এবং ছয় জন ব্যক্তির পক্ষ থেকে একটি পশুতে অংশগ্রহণ করাও জায়েয রয়েছে। (আল উম্ম: ২/২৪৪, বাদায়ে সানায়ে: ৫/৭১) ,
🔰 কুরবানির পশু জবাই করার নিয়ম ও দুআ: 🔰
কুরবানী করার সময় পশুর মাথা বাম কাতে এমনভাবে শোয়াতে হবে যেন জবাইকারী কিবলামুখী হয়ে জবাই করতে পারেন। (সুবুলুস সালাম : 8 / 179 ) তারপর কুরবানিদাতা কিবলামুখী হয়ে এই দুআ “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা হা-যা মিনকা ওয়া লাকা। আল্লাহুম্মা হা-যা 'আন্নী ওয়া'আন আহলে বায়তী” (মুগনী- ০৯/৪৫৬) অথবা “বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা তাকাব্বাল মিন্নী ওয়া মিন আহলে বায়তী” পড়ে নিজ হাতে বা অন্যকে দিয়ে ধারালো ছুরি দিয়ে যবেহ করবেন, যাতে প্রাণীর কষ্ট কম হয়।
কুরবানির গোশত বিতরণ এবং কসাইয়ের মজুরী নির্ধারণ: আল্লাহ তা'য়ালা বলেন: যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থান পর্যন্ত পৌঁছে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নাম স্মরণ করে তাঁর দেওয়া চতুষ্পদ জন্তু যবেহ করার সময়। অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার করো এবং দুঃস্থ-অভাবগ্রস্থকে আহার করাও।” [সূরা আল-হাজ্জ : ২৮] 44
আল্লাহ তা'য়ালা বলেন: “অতঃপর যখন তারা কাত হয়ে পড়ে যায় তখন তা থেকে তোমরা আহার করো এবং আহার করাও তাকে যে চায় না এবং যে চায় তাকে । এমনিভাবে আমি এগুলোকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছি, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।” [সূরা আল-হাজ্জ : ৩৬]
উক্ত নির্দেশনা অনুসারে আমাদের সমাজে প্রচলিত কুরবানির গোশত ৩ ভাগে বিভক্ত করার যে রীতি রয়েছে সেটা ওয়াজিব নয় বরং মুস্তাহাব। ১. এক ভাগ নিজ পরিবারের জন্য; ২. এক ভাগ প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের জন্য; ৩. এক ভাগ গরিব-মিসকীনদের সাদাকাহ করার জন্য। তবে এ ভাগগুলো সমানভাবেই করতে হবে এটা আবশ্যক নয়। (সহীহুল বুখারী, হা. ৫৫৬৯, সহীহ মুসলিম, হা. ১৯৭৪)
কুরবানির পশু জবাই করা কিংবা কাটা-বাছা বাবদ কুরবানির গোশত বা চামড়া থেকে কোনো রকম মজুরী প্রদান করা জায়েয নেই। (সহীহুল বুখারী: ১৭১৬-১৭১৭) বরং সাহাবীগণ নিজ পকেট থেকে তার পারিশ্রমিক প্রদান করতেন। (সহীহ মুসলিম- ১৩১৭) চামড়াটি নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করা বৈধ রয়েছে। অন্যথায়, সেটাও সাদাকাহ করতে হবে।
🔰 ঈদুল আযহার সুন্নাতসমূহঃ🔰
ঈদুল আযহার সুন্নাত হলো কোনো কিছু না খেয়ে ঈদগাহে যাওয়া। কারণ রাসূলুল্লাহ ঈদুল আযহায় ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে কোনো কিছু খেতেন না । ঈদের সলাত শেষে কুরবানি করার পর সেই পশুর কলিজা দিয়ে খাবার খেতেন। (তিরমিযী, হা. ৫৪২; ইবনে মাজাহ, হা. ১৭৫৬, সহীহ) রাসূলুল্লাহ ঈদের মাঠে যাওয়ার সময় এক পথে যেতেন এবং অন্য পথ দিয়ে ফিরতেন। (তিরমিযী, হা. ৫৪১, ইবনে মাজাহ, হা. ১৩০১, সহীহ) তাছাড়া ঈদের দিন গোসল করা ও সুগন্ধি ব্যবহার করা সুন্নাত। তাকবীর পাঠ করতে করতে পায়ে হেঁটে মাঠে যাওয়া এবং মুসলিম ভাইদের সাথে কুশল বিনিময় করা উত্তম। কুশল বিনিময়ে সাহাবীগণ এ দুআটি বলতেন: “তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা।” (ফাতহুল বারী- ২য় খন্ড, ৪৪৬ পৃষ্ঠা) এ ছাড়া ঈদের দিন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যাওয়া এবং তাদের খোঁজ-খবর নেওয়া উচিত।
🔰 ঈদের দিন বর্জনীয় কর্মসমূহ:🔰
ঈদ মুসলিমদের স্বতন্ত্র বৃহত্তম একটি উৎসব। এই দিনে অমুসলিমদের সাথে সাদৃশ্য হয় এমন যে-কোনো কাজ থেকে প্রত্যেক মুসলিমকে বিরত থাকতে হবে। ঈদের দিনকে কবর যিয়ারতের জন্য নির্দিষ্ট করা যাবে না। নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হবে। গান-বাজনা
ও যে কোন অশ্লীলতাকে পরিহার করতে হবে।
🔰 আমাদের আহবান :🔰
১. কুরবানির শিক্ষাই হলো আল্লাহকে খুশি করার জন্য তার দ্বীনের পথে যে-কোনো ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতে সার্বিকভাবে নিজেকে প্রস্তুত রাখা।
২. করোনা নামক মহামারির ফলে বিশ্ববাসী পর্যুদস্ত। অভাবী ও কর্মহীন মানুষের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। এই কঠিন পরিস্থিতিতে নিজের সাধ্যমতো গরীব ও অসহায়দের সাহায্যে এগিয়ে আসুন। ত্যাগ ও কুরবানির পরীক্ষা আপনার সামনে হাজির।
৩. এটা মনে করতে হবে যে, পশু কুরবানী মূলত মানুষের মনের মাঝে যে পশুত্বের ভাব রয়েছে সেটাকেই কুরবানী করা।
৪. কুরবানী কেন্দ্রিক সকল প্রকার ভুল-ভ্রান্তি, লৌকিকতা এবং সামাজিকতার ভয়কে দূরে ঠেলে দিয়ে, আসুন ! আমরা সকলেই রাসূলুল্লাহ এর দেখানো পদ্ধতিতে এবং আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে তাঁরই জন্য কুরবানী করি।
৫. গোটা বিশ্ব থেকে লাখ লাখ মুসলিম হাজ্জ পালনের জন্য মক্কার কাবায় সমবেত হওয়ার মৌসুম এটা। বিশ্বের তাওহীদপন্থীদের অপূর্ব এক মিলনমেলা। মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের প্রতীক এই হাজ্জ। আমাদের দেশসহ সারাবিশ্ব থেকে যারা কা'বায় আছেন বা যাচ্ছেন, হে আল্লাহ তুমি সকলের সুস্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও হাজ্জের কবুলিয়াত দান করো ।
পরিশেষে, দেশের সকল ধর্মপ্রাণ মুসলিম ভাই ও বোনের প্রতি “জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীস বাংলাদেশ” এর পক্ষ থেকে পবিত্র ঈদুল আযহার অগ্রিম শুভেচ্ছা রইল। তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম ।
জমঈয়ত শুব্বানে আহলে হাদীস বাংলাদেশ
৭৯/ক/৩, উত্তর যাত্রাবাড়ি, ঢাকা-১২০৪।
আপনার সর্বপ্রকার সহযোগিতা প্রেরণ করুন
(বিকাশ পার্সোনাল) ০১৭৬৫-৮১২২৬১

Facebook